হেনরি রাইডার হ্যাগার্ড এর লিটল ফ্লাওয়ার (Little Flower) রূপান্তর মেহেদী হাসান
লিটল ফ্লাওয়ার (Little Flower)
হেনরি রাইডার হ্যাগার্ড
রূপান্তরঃ মেহেদী হাসান
“লিটল ফ্লাওয়ার” গল্পটি প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল ১৯২০ সালে। এটা স্যার হেনরি রাইডার হ্যাগার্ডের 'স্মিথ অ্যান্ড দ্য ফারাওস, অ্যান্ড আদার টেলস' বইয়ের একটি গল্প। এই সংগ্রহে মোট ছয়টি গল্প আছে। গল্পগুলো হলো: 'স্মিথ অ্যান্ড দ্য ফারাওস', 'মাগেপা দ্য বাক', 'দ্য ব্লু কার্টেন্স', 'দ্য লিটল ফ্লাওয়ার', 'ওনলি আ ড্রিম' এবং 'বারবারা হু কেম ব্যাক'। বইটিতে 'লিটল ফ্লাওয়ার' হচ্ছে চতুর্থ গল্প। পূর্বের তিনটি গল্প আমার টাইমলাইনে পাবেন। পড়ে দেখতে পারেন।
----------------------------------------------
পর্বঃ এক
রেভারেন্ড থমাস বুল ছিলেন পাথরের মত দৃঢ় চরিত্রের একজন মানুষ, তার কল্পনাশক্তি ছিলো না বললেই চলে। ভালো বংশের, ভালো মেধার, ভালো নীতির এবং ভালো খ্যাতির অধিকারী এই মানুষটির নাম থমাসের বদলে জন বুল হওয়া উচিত ছিল কারণ তিনি ছিলেন ব্রিটিশ মধ্যবিত্ত শ্রেণীর একজন আদর্শ প্রতিনিধি। স্বভাবগতভাবে তিনি ছিলেন সত্যিকারের একজন ধার্মিক মানুষ এবং তার মনের ভারসাম্যের কারণে অন্যদের মতো তিনি নানান দুর্বলতায় ভুগতেন না। জীবনের একেবারে শুরুতেই তিনি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন যে আধ্যাত্মিক বিষয়গুলো পার্থিব বিষয়ের চেয়ে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ, আর যেহেতু অনন্তকাল সময়ের চেয়ে অনেক দীর্ঘ, তাই আধ্যাত্মিকতার প্রতি নিজেকে উৎসর্গ করা এবং জাগতিক বিষয়গুলোকে নিজের পথে চলতে দেওয়াই হবে বুদ্ধিমানের কাজ। পুরস্কার এবং ধর্মীয় মতবাদে দৃঢ়ভাবে বিশ্বাসী এমন অনেক ভালো মানুষ আছেন যারা এই বাস্তব দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করেন। তাদের জন্য,
"হাজার গুণে ফিরে আসবে প্রতিদান।" — এটা তাদের প্রিয় স্তোত্রের একটি প্রিয় পংক্তি।
এটা সত্যি যে আধ্যাত্মিকতার ব্যাপারে তার ধারণা ছিল সীমিত! না, বরং বলা উচিত, এটা ছিল অসীম কারণ তার চারপাশে থাকা যা কিছুই তাকে শেখানো হোক না কেন, তিনি কোনরূপ সন্দেহ বা প্রশ্ন ছাড়াই তা গ্রহণ করতেন। বাল্যকালে বড় বড় পিল গিলে ফেলার দক্ষতার জন্য তিনি বিখ্যাত ছিলেন।
"ভেবো না," তিনি তার দুর্বল ভাই-বোনদের বলতেন, বিশেষত একটি বোনকে যার গলার গঠন এমন ছিল যে তাকে এই পিলগুলো কাঁচি দিয়ে কেটে নিতে হতো, "ভেবো না, গিলে ফেলো!"
জীবনের অন্য সব ক্ষেত্রেও থমাস একই কাজ করতেন; তিনি ভাবতেন না, গিলে ফেলতেন। এইভাবে বিশ্বাসের বিষয়গুলোতে সন্দেহ পোষণ করে যদি অন্য সকল তরুণরা "রূপকথা" নিয়ে কথা বলত অর্থাৎ যখন তারা তাদের আদিমাতা হাওয়া (আঃ)-এর এই পৃথিবীতে আগমনের সঠিক পদ্ধতি, ইয়ুশা ইবনে নুন (আঃ) এর জন্য সূর্য আসলেই স্থির ছিল কিনা বা নূহ (আঃ) তার নৌকায় অগণিত জীবজন্তুর জোড়া নিয়ে আরারাত পর্বতের চূড়ায় ভেসে উঠেছিলেন কিনা, অথবা ইউনুস (আঃ) পাচন রসকে অগ্রাহ্য করে তিমির পেটে তিন দিন বেঁচে থাকার মতো বিষয়ে সন্দেহ প্রকাশ করত, থমাস তখন করুণার হাসি দিয়ে তাদের দিকে তাকিয়ে মন্তব্য করতেন যে, মূসা (আঃ) আর অন্যান্য স্বীকৃত নবীদের লেখাই তার জন্য যথেষ্ট।
আসলে স্কুলে থাকার সময় তার সম্পর্কে একটা গল্প প্রচলিত ছিল যেটা তার এই মনোভাবের চমৎকার উদাহরণ হতে পারে। পড়াশোনার বোঝা হালকা করার জন্য একজন খুব বিখ্যাত ভূতত্ত্ববিদকে তার হাউসে বক্তৃতা দেওয়ার জন্য আনা হয়েছিল। তিনি তরুণ শ্রোতাদের আগ্রহী করে তোলা আর পৃথিবীর শিলাগুলিকে তাদের নিজস্ব ধর্মনিরপেক্ষ গল্প বলার শিল্পে পারদর্শী ছিলেন। এই বিশিষ্ট মানুষটি অসাধারণভাবে বক্তৃতা দিয়েছিলেন। তিনি দেখিয়েছিলেন কীভাবে কোনো সন্দেহ ছাড়াই প্রমাণিত হয় যে আমরা পৃথিবীতে বাস করি। কোটি কোটি বছর ধরে টিকে থাকা মহাকাশের সমুদ্রে ভাসমান একটি ধূলিকণার ন্যায় আমাদের এই পৃথিবী কীভাবে অগণিত যুগের বিবর্তনীয় পরিবর্তনের মাধ্যমে এটা শেষ পর্যন্ত মানুষের বসবাসের উপযোগী হয়ে উঠেছে। যারা সম্ভবত নিজেরাই কমপক্ষে দশ লাখ বছর ধরে এখানে বসবাস করছে, চলাফেরা করেছে।
আকর্ষণীয় এই গল্পের শেষে ছেলেদের প্রশ্ন করার জন্য আমন্ত্রণ জানানো হলো। থমাস বুল নামে একজন বড়সড়, ভুরু কুঁচকানো যুবক সাথে সাথে উঠে দাঁড়াল আর তাদের বিখ্যাত ও বয়স্ক অতিথি সেই বিশ্বব্যাপী খ্যাতিসম্পন্ন মানুষটির কাছে জানতে চাইলো, তিনি কেন রূপকথার গল্প বলে তাদের হাসানোর চেষ্টা করছেন?
বৃদ্ধ ভদ্রলোক খুব আগ্রহ নিয়ে তার চশমা লাগিয়ে এই অদ্ভুত ছেলেটিকে পর্যবেক্ষণ করে বললেন, "আমি নিজেও স্পষ্টভাষী, আর আমি তাদের পছন্দ করি যারা দৃঢ় বিশ্বাস থেকে স্পষ্ট কথা বলে; কিন্তু, আমার তরুণ বন্ধু, তুমি কেন মনে করো যে আমি রূপকথার গল্প বলছি?"
"কারণ বাইবেল তাই বলেছে," থমাস নির্ভীকভাবে উত্তর দিল। "বাইবেল আমাদের বলেছে পৃথিবী ছয় দিনে সৃষ্ট হয়েছে, লক্ষ কোটি বছরে নয়, আর সূর্য চাঁদ তারা আকাশে রাখা হয়েছে পৃথিবীকে আলো দেওয়ার জন্য; এছাড়া মানুষ সৃষ্ট হয়েছে খ্রিস্টপূর্ব চার হাজার বছরে। তাই হয় আপনি ভুল, স্যার, নয়তো বাইবেল ভুল, আর আমি বাইবেলের পক্ষে।"
বিশিষ্ট বিজ্ঞানী তার চশমা খুলে সাবধানে রেখে দিলেন, তারপর বললেন:
"অত্যন্ত যুক্তিপূর্ণ কথা। অনুরোধ করি যুবক, আমার বা অন্যদের নগণ্য অনুমানগুলো যেন তোমার বিশ্বাসে বাধা না দেয়। তবে আমি মনে করি, পৃথিবী খ্রিস্টপূর্ব চার হাজার বছরে শুরু হয়েছিল বলে যিনি বলেছিলেন, সেটা বাইবেল নয় বরং আর্চবিশপ উশার ছিলেন। আমার মনে হয় তুমি একদিন নিজের পথে একজন মহান মানুষ হতে পারবে। তবে আমি পরামর্শ দেব, বিতর্কে একটু ভদ্রতার মিষ্টতা মাখালে ভালো হয়।"
এরপর আর কোনো প্রশ্ন করা হল না, আর সভাটি বিশৃঙ্খলভাবে ভেঙে গেল।
এসব থেকে বোঝা যায়, যেহেতু আমরা কেউই নিখুঁত নই, থমাসের মধ্যেও দুর্বলতা ছিল। উদাহরণস্বরূপ, তার ছিল তথাকথিত "বদমেজাজ", এছাড়া নিজের এবং নিজের সামর্থ্য সম্পর্কে তার একটা উঁচু ধারণা ছিল।
যথাসময়ে থমাস বুল ধর্মতত্ত্বের ছাত্র হলেন। এমন ছাত্র খুব কমই ছিল। তিনি ডানে বামে তাকাতেন না, দিনে আট ঘন্টা পড়াশোনা করতেন আর প্রতিটি বিষয়ে সর্বোচ্চ ডিগ্রি নিয়েছিলেন। তারপর তিনি পুরোহিত পদে নিযুক্ত হলেন। এই সময়ে তিনি হঠাৎ করে একজন কলোনিয়াল বিশপের ধারাবাহিক কিছু উপদেশ শুনলেন যা তার মনকে মিশনারি কাজের দিকে উৎসাহিত করলো। এটা ঘটেছিল যখন তিনি ইস্ট এন্ডের একটি প্যারিশে ডিকন হিসেবে কাজ করছিলেন এবং পশ্চিমা বর্বরতার সঙ্গে পরিচিত হয়েছিলেন।
তিনি তার বন্ধুবান্ধব ও উর্ধ্বতনদের সাথে পরামর্শ করলেন যে তার সত্যিকারের কাজ পৃথিবীর দূর দূরান্তে পৌঁছে দিলে কেমন হয়? সবাই একবাক্যে উত্তর দিলেন, তারা তাই মনে করে; তাদের এই একতা দেখে মনে হল যে তারা আন্তরিকভাবে সম্মত হয়নি বরং তার থেকে মুক্তি পেতে মরিয়া হয়ে আছে। হয়তো তারা সত্যিই তাই চেয়েছিল; অথবা হয়তো তারা মনে করেছিল এই প্রচণ্ড জ্ঞানী মানুষটির জন্য এই সংকীর্ণ দেশ উপযুক্ত নয়।
কিন্তু আরেকজনের সঙ্গেও পরামর্শ করতে হয়েছিল কারণ এতদিনে রেভারেন্ড থমাস বুল লন্ডনের একজন মৃত ব্যবসায়ীর একমাত্র কন্যার সঙ্গে বাগদান করেছিলেন—আসলে তিনি ছিলেন একজন বড় মাপের দোকানদার। এই সম্মানিত নাগরিক, মিস্টার হামফ্রিজ, জীবনের শেষ দিকে দ্বিতীয় বিয়ে করেছিলেন এবং বেছে নিয়েছিলেন তার চেয়ে কিছুটা উঁচু শ্রেণীর একজন সুন্দরী আর বেশ ফ্যাশনেবল মহিলাকে, যিনি নিজেও ছিলেন বিধবা। দ্বিতীয় স্ত্রীর গর্ভে তার কোনো সন্তান হয়নি, তার কন্যা ডরকাস ছিল প্রথম স্ত্রীর গর্ভজাত সন্তান। মিস্টার হামফ্রিজ একটি অদ্ভুত উইল করেছিলেন; তিনি তার বিপুল সম্পত্তির সবটাই তার তরুণী বিধবা স্ত্রীর জন্য রেখে গিয়েছিলেন, আর তার কন্যা ডরকাসের জন্য বছরে মাত্র তিনশো পাউন্ডের একটি ভাতা নির্ধারণ করেছিলেন।
তবে মৃত্যুর একদিন আগে তিনি উইলে একটা শর্ত যোগ করেছিলেন যা মিসেস হামফ্রিজকে খুব রাগিয়েছিল, শর্তে বলা হয়েছিলো, যদি তিনি পুনরায় বিয়ে করেন তাহলে সম্পত্তির তিন-চতুর্থাংশ তৎক্ষণাৎ ডরকাসের কাছে চলে যাবে এবং তার স্ত্রীর মৃত্যুর পরে ডরকাস বা তার উত্তরাধিকারীরা পুরো সম্পত্তি পাবে।
এই উইলের ব্যবস্থাপনার ফলাফল ছিল একটি বাড়ি, যদিও সেটা বেশ বড়ই ছিল, কিন্তু মিসেস হামফ্রিজ এবং তার সৎ মেয়ে ডরকাসের জন্য সেটা যথেষ্ট হলো না। ডরকাস ছিল উল্টানো নাক, হালকা খয়েরী রঙের নরম চুল আর অস্পষ্ট মুখাবয়বের একটি নম্র মেজাজের ভীরু মেয়ে। তবুও তার মনের মধ্যে সৎ মায়ের ফ্যাশনেবল চলাফেরার বিরুদ্ধে একটি প্রতিবাদের চেতনা জাগ্রত ছিল। শেষ পর্যন্ত সে তার তিনশো পাউন্ড বার্ষিক আয় নিয়ে ইস্ট এন্ডে গিয়ে ভালো কাজকর্ম করার সিদ্ধান্ত নিল—দৃঢ়ভাবে স্থির করেছিল নিজের জন্য একটা পেশা গড়ে তুলবে, যদিও এ কাজের জন্য সে মোটেও উপযুক্ত ছিল না।
এভাবেই ডরকাসের সঙ্গে রেভারেন্ড থমাস বুলের পরিচয় হল। প্রথমবার সে তার ভবিষ্যৎ স্বামীকে দেখেই সম্পূর্ণরূপে মুগ্ধ হয়ে গেল। তিনি তখন মিম্বরে ছিলেন, আর সত্যিই সেখানে তার বলিষ্ঠ দেহ, বড় কালো চোখ, আর দৃঢ় চেহারা নিয়ে তাকে খুব সুদর্শন লাগছিল। তাছাড়া সে তার নিজস্ব জোরালো ভঙ্গিতে চমৎকার বক্তৃতা দিচ্ছিলেন।
বক্তৃতায় তিনি আধুনিক মহিলাদের—বিশেষ করে উচ্চশ্রেণির আধুনিক মহিলাদের চারিত্রিক দোষত্রুটি আর ক্ষুদ্র মন-মানসিকতার নিন্দা করছিলেন, যাদের সম্পর্কে তার আসলে কোনো ধারণাই ছিল না। এই বিষয়টি ইস্ট এন্ডের জনসাধারণের কাছে বেশ আকর্ষণী ছিল। তিনি দেখিয়েছিলেন কীভাবে এই বিলাসী ধরনের মহিলারা মূল্যহীন, তারা পোশাক আর অন্যান্য আরও নিষিদ্ধ আনন্দের প্রতি কতটা মনোযোগ দেয়। তিনি তাদের তুলনা করেছিলেন ফ্লোরেন্সের মহিলাদের সঙ্গে, যাদের স্যাভোনারোলা (যদিও মনে মনে থমাস নিজের সাথে সেই সংকীর্ণ মানুষগুলোর মিল খুঁজে পেত) বলে তিরস্কার করেছিলেন যতক্ষণ না তারা অনুতপ্ত হয়ে কাঁদতে লাগলো এবং তাদের অলংকার ও সাজসজ্জা পুড়িয়ে দেওয়ার জন্য স্তূপ করে রাখল।
তারা তাদের জীবন নিয়ে কী করে, তিনি জিজ্ঞেস করলেন। তাদের দশ হাজারের মধ্যে একজনও কি এমন আছে যে বিলাসিতা ত্যাগ করে পৃথিবীর অন্ধকার স্থানে আলো ছড়াতে যাবে বা অন্তত নিজেকে কষ্ট দিয়ে হলেও অন্যদের সাহায্য করবে? এভাবে তিনি তিরিশ মিনিট ধরে বলে গেলেন।
ডরকাস শুনতে শুনতে তার সৎ মায়ের কথা ভেবে মনে করছিল এসব কথা কতটা আশ্চর্যজনকভাবে সত্য। রেভারেন্ড যদি ডরকাসের সৎ মাকে ব্যক্তিগতভাবে চিনতেন, তবে এর চেয়ে নিশ্চয়ই ভালো বর্ণনা দিতে পারতেন না। এটাও নিশ্চিত যে মিসেস হামফ্রিজ আর তার বন্ধুরা কোনো ধরনের আলো ছড়ানোর কোনো ইচ্ছা রাখেন না, যদি না সেটা তাদের নিজেদের চোখ আর গয়নার ঝলকানি হয়।
তিনি যে উচ্চতর জীবনের ছবি আঁকলেন তা কত মহৎ, আত্মত্যাগ আর উঁচু লক্ষ্যের জীবন! সে এই উচ্চতর জীবন যাপন করতে চায়, কারণ সত্যি বলতে সে ছিল ধার্মিক প্রেরণায় পূর্ণ একটি ভালো হৃদয়ের মেয়ে; শুধু দুর্ভাগ্যবশত সে জানত না কীভাবে সেটা সম্ভব।
তখনই তার মনে একটা অনুপ্রেরণা এল; সে মিস্টার বুলের সাথে পরামর্শ করবে।
সে তাই করল, আর এর ফলাফল তিন মাসের মধ্যে তারা বাগদান করল, আর ছয় মাসের মধ্যে বিয়ে।
বাগদানের সেই উত্তেজনাপূর্ণ সপ্তাহগুলোতে তারা একমত হল (যদিও ডরকাসের কিছুটা দ্বিধা ছিল) যে যথাসময়ে তারা মিশনারি হয়ে পৌত্তলিকদের ধর্মান্তরিত করতে আফ্রিকা যাবে; যাকে ডরকাস "কালো আফ্রিকা" বলে চিনত। তবে তার আগে তাদের প্রস্তুতি নিতে হবে; তাদের দুই জনকেই দীর্ঘ প্রশিক্ষণের মধ্য দিয়ে যেতে হবে; সোয়াহিলি আর জুলুর মতো বিভিন্ন বর্বর ভাষা শিখতে হবে।
ওহ! বেচারি ডরকাস। সে খুব একটা বুদ্ধিমতী ছিল না এবং ভাষা শেখার কোনো প্রতিভাও তার মধ্যে ছিল না। একসময় সে সেই বর্বর উপ-ভাষাগুলোকে ঘৃণা করতে আরম্ভ করল। তবুও অনিচ্ছাসত্ত্বেও সে বীরাঙ্গনার মতো সেগুলো শিখতে থাকল এবং শেষ পর্যন্ত বুদ্ধিমত্তা ও ব্যবহারিক দূরদর্শিতায় শুধু গৃহস্থালীর বিষয়ে প্রয়োজনীয় শব্দ ও বাক্যগুলো শিখে ফেলল, যেমন, "আগুন জ্বালাও", "কেটলিতে পানি ফোটাও", "বোন, তুমি কি কাঠ কেটেছ?", "রান্নাঘরের কুঁড়েতে এত হৈচৈ বন্ধ করো।", "সিংহ যদি আমাদের গরু খায়, তাহলে আমাকে জাগিয়ো" ইত্যাদি।
বিয়ের পর এক বছরেরও বেশি সময় ধরে এই প্রাথমিক প্রস্তুতি চলতে থাকল। থমাস ঘোড়ার মতো খাটতেন, যদিও এটা সত্য যে ডরকাস আনুসাঙ্গিক কাজের চাপে সোয়াহিলি আর জুলু ব্যাকরণের প্রতি তার মনোযোগ কমিয়ে দিয়েছিল। বিশেষভাবে যখন তাদের প্রথম সন্তানের জন্ম হল—মায়ের মতোই খয়েরী চুলের ফুটফুটে একটি মেয়ে, থমাস তার নাম রাখল তাবিথা এবং পরবর্তী বছরগুলোতে সে এই গল্পের "লিটল ফ্লাওয়ার বা ছোট্ট ফুল" হয়ে উঠল। তারপর চলে যাওয়ার সময় ঘনিয়ে এলে আরেকটি ঘটনা ঘটল। ডরকাসের সৎ মা মিসেস হামফ্রিজ, লেন্টের সময় একটি নাচের অনুষ্ঠানে গিয়ে ঠান্ডা লাগিয়ে ফুসফুসে প্রদাহে আক্রান্ত হলেন এবং মারা গেলেন।
থমাস যাকে প্রভুর ইচ্ছা বলেছিলেন, এই ঘটনার ফলে ডরকাস হঠাৎ ধনী হয়ে গেল। বছরে তার আয় প্রায় দুই হাজার পাউন্ড, কারণ তার বাবা তার ধারনার চেয়েও অনেক বেশি ধনী ছিলেন। এখন প্রলোভন তাকে পেয়ে বসল। সে নিজেকে প্রশ্ন করল, কেন থমাসকে আফ্রিকায় গিয়ে কালো মানুষদের শিক্ষা দিতে হবে, যখন তার প্রতিভা আর সম্পদ কাজে লাগিয়ে সে ঘরেই আরামে থেকে খুব শীঘ্রই একজন বিশপ, অথবা অন্তত একজন ডিন হতে পারে?
খুব সাহস করে সে এই বিষয়টি তার স্বামীর কাছে তুলল, কিন্তু বুঝল যে তার মাথা দিয়ে পাথরের দেয়াল ভাঙার চেষ্টা করা তার পরিকল্পনা পরিবর্তন করানোর চেয়ে সহজ হত। তিনি ধৈর্য সহকারে তার কথা শুনলেন—তারপর ঠান্ডা গলায় বললেন যে তিনি তার কথায় বিস্মিত হয়েছেন।
"যখন তুমি গরিব ছিলে" তিনি বলে চললেন, "তুমি এই সেবার জন্য নিজেকে উৎসর্গ করেছিলে, আর এখন আমরা ধনী হয়েছি বলে, তুমি বিশ্বাসঘাতক হয়ে মিশরের মাংসের হাঁড়ির পিছনে ছুটতে চাও? আমাকে আর কখনো এই বিষয়ে কিছু বলতে যেওনা।"
"কিন্তু আমাদের মেয়ের কথা একবার ভাবো" ডরকাস চেঁচিয়ে উঠল। "আফ্রিকা গরম, ওর জন্য উপযুক্ত নাও হতে পারে।"
"স্বর্গ তার দেখাশোনা করবে," তিনি উত্তর দিলেন।
"আমি ঠিক সেই ভয়টাই পাচ্ছি," ডরকাস কাঁদতে কাঁদতে বলল।
তারপর তাদের প্রথম ঝগড়া হল, যার মধ্যে স্বীকার করতেই হবে, সে দুয়েকটি কটু কথা বলে ফেলেছিল। উদাহরণস্বরূপ, সে বলল যে তিনি বিদেশে যেতে চান তার আসল কারণ হল তিনি দেশে তার সহকর্মী পাদ্রিদের, বিশেষ করে তার ঊর্ধ্বতনদের কাছে অপ্রিয়, যাদের তিনি ক্তৃতা আর তিরস্কার করতে পছন্দ করতেন।
এই ঝগড়ার শেষ হল তার সম্পূর্ণ পরাজয়ের মধ্য দিয়ে, ভাঙা ডানার প্রজাপতির মতো যা বাগানের রোলারের পথে পড়ে যায়। তিনি দাঁড়িয়ে তার ওপরে ঝুঁকে পড়লেন।
"ডরকাস," তিনি বললেন, "তুমি যা ইচ্ছে করো। চাইলে এখানে থাকো, তোমার টাকা আর বিলাসিতা উপভোগ করো। আমি পরের মাসের প্রথমেই আফ্রিকার উদ্দেশ্যে জাহাজে চড়ব। তুমি দুর্বল বলে কি আমি শক্তিশালী হওয়া বন্ধ করে দেব?"
"না, তা মনে করি না," সে কাঁদতে কাঁদতে উত্তর দিল, আর পরাজয় মেনে নিল।
অবশেষে তারা জাহাজে চড়লেন।
"তোমাকে নিজের সন্তানের দেখাশোনা করা শিখতে হবে," তিনি বললেন; এই মন্তব্যে ডরকাস একটু মুখ বাঁকাল।
পর্বঃ দুই
মিস্টার এবং মিসেস বুলের পরবর্তী আট বছরের জীবনযাত্রা তেমন কোনো মন্তব্যের দাবি রাখে না। তাবিথা প্রথমদিকে শারীরিকভাবে বেশ দুর্বল ছিল এবং প্রায় সর্বদাই ডাক্তারের সংস্পর্শে থাকতে হতো। তারা ঘুরে ঘুরে আফ্রিকার বিভিন্ন উপকূলীয় শহরে বাস করতে থাকে, যেখানে থমাস তার স্বাভাবিক উৎসাহ ও আন্তরিকতার সাথে কাজ করতেন। তিনি বিভিন্ন ভাষা শিখে যথেষ্ট নিখুঁতভাবে বলতে পারতেন (যদিও ডরকাস তা কখনোই পারেনি) এবং মিশনারি কাজের সাথে সম্পর্কিত স্থানীয় পরিস্থিতির সঙ্গে নিজেকে ভালোভাবে পরিচিত করাতেন।
অন্য কিছুতে তার তেমন কোনো আগ্রহ ছিল না; এমনকি আদিবাসীদের ইতিহাস বা তাদের অদ্ভুত সংস্কৃতির প্রতিও না কারণ বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তাদের নিজস্ব একটি গোপন সংস্কৃতি ছিল। "সবকিছু শেষ হয়ে গেছে," তিনি বলতেন, "এই আদিবাসীরা হচ্ছে কালো ও বর্বর অতীতের একটি উল্টানো পাতা," এখন তার কাজ হচ্ছে নতুন পাতায় নতুন কিছু লেখা। সম্ভবত এই কারণেই থমাস বুল সত্যিকার অর্থে কখনই জুলু, বাসুতো, সোয়াহিলি বা অন্য কোনো কালো চামড়ার পুরুষ, মহিলা, বা শিশুর মনের গভীরে প্রবেশ করতে বা তাদের বুঝতে পারেননি। তার কাছে তারা ছিল শুধুই আগুনে পোড়া কাঠ এবং পাপী, যাদের উদ্ধার করতে হবে এবং তিনি ভয়ানক উদ্যমের সঙ্গে তাদের উদ্ধারের কাজে লেগে যেতেন।
তার স্ত্রী, যদিও তার শব্দভাণ্ডার এখনো খুব সীমিত ছিল এবং প্রায়শই ইংরেজি বা ডাচ শব্দ দিয়ে বাক্য পূর্ণ করতে হতো—এই কালো মানুষদের সঙ্গে মিলেমিশে চলতে পারতো।
"জানো থমাস," সে বলত, "তাদের নানা রকম সুন্দর ধারণা আছে যা আমরা বুঝি না, আর তারা তাদের মতো করে বেশ ভালো, শুধু তাদের পথটা কী সেটা তোমাকে খুঁজে বের করতে হবে।"
"আমি খুঁজে বের করেছি," তিনি কঠিন গলায় বলতেন; "এটা একটা খুবই মন্দ পথ, ধ্বংসের পথ। আমি চাই না তুমি সেই ধূর্ত কালো পরিচারিকা মেয়েটার সাথে এত বন্ধুত্ব করো যে তিনবার মুখ খুললে অন্তত একবার মিথ্যা বলে।”
বাকি সময়ে ডরকাস মোটামুটি আরামেই ছিল, কারণ তাদের সম্পদের দরুন যে শহরেই তারা থাকতো সেখানে সবসময় একটা সুন্দর বাড়ি ভাড়া নিতে পারত; যেখানে সে টেনিস পার্টি এবং এমনকি ছোটখাটো লাঞ্চ বা ডিনারের আয়োজন করতে পারত। বিশেষ করে যদি তার স্বামী দূরে যেতেন—যেমন তিনি প্রায়ই উপ-দেশীয় অঞ্চল পরিদর্শনে যেতেন অথবা অসুস্থ বা ছুটিতে থাকা অন্য কোনো মিশনারির দায়িত্ব পালন করতেন। সত্যি বলতে আফ্রিকাকে ডরকাসের বেশ ভালো লাগতে শুরু করেছিল কারণ সে ছিল একটা শীতকাতর মেয়ে যে আফ্রিকার প্রচুর সর্বব্যাপী রোদকে ভালোবাসত এবং সে অনেক বন্ধু বানিয়েছিল; বিশেষত যুবকদের মধ্যে, যাদের কাছে তার অসহায়ত্ব ও কিছুটা বিষণ্ণ মুখ বেশ আকর্ষণীয় ছিল।
মহিলারাও তাকে পছন্দ করত কারণ সে ছিল দয়ালু এবং দারিদ্র্য বা অন্য কোনো দুর্দশার ক্ষেত্রে সাহায্যের জন্য সবসময় প্রস্তুত থাকতো। ভাগ্যক্রমে, সে ছিল নিজের মালিক কারণ তার সম্পত্তি কোনো বিয়ের চুক্তি দ্বারা বাঁধা ছিল না। তাছাড়া, এটি ট্রাস্টিদের হাতে ছিল, তাই মূল সম্পত্তি অন্য কোথাও হস্তান্তর করা যেত না। অতএব তার নিজস্ব হিসাব ও চেকবুক ছিল এবং অতিরিক্ত অর্থ সে যেমন চাইত তেমন খরচ করত। একাধিক গরিব মিশনারির স্ত্রী এটা জানত এবং তাকে আশীর্বাদপ্রাপ্ত বলত, কারণ তার দানের ফলে তারা আবার ইংল্যান্ডের উপকূল দেখতে পেত অথবা অসুস্থ সন্তানকে চিকিৎসার জন্য দেশে পাঠাতে পারত। কিন্তু এই ভালো কাজগুলোর কথা ডরকাস তার স্বামীর কাছে সবসময় গোপনই রাখত।
বছরের পর বছর এভাবেই কেটে গেল, তারা সামগ্রিকভাবে খুব একটা অসুখী ছিল না কারণ সময় গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে শিশু তাবিথা পরিবেশের সাথে অভ্যস্ত হয়ে অনেক শক্তিশালী হয়ে উঠল। এতদিনে, যদিও ডরকাস তার স্বামীকে ভালোবাসত, সব বিষয়ে অথবা অন্তত বেশিরভাগ বিষয়ে তার আদেশ-নিষেধ মানত—সে বুঝতে পেরেছিল যে তার এবং তার স্বামীর মধ্যে গঠনগত পার্থক্য অনেক। সে জানত যে সে নিজে প্রকৃতপক্ষে তার স্বামীর চেয়ে এমনকি বেশিরভাগ মানুষের চেয়েও উঁচু জাতের। সবার মতো সেও তার ন্যায়পরায়ণতা, উদ্দেশ্যের দৃঢ়তা এবং তার অপ্রতিরোধ্য শক্তির প্রশংসা করত এবং বিশ্বাস করত যে তার ভাগ্যে মহান কিছু রয়েছে। তবুও সত্যি বলতে, যা সে প্রায়শই হাঁটু গেড়ে অনুতাপের সাথে স্বীকার করত, সামগ্রিকভাবে সে তার স্বামীর মাঝে মাঝে অনুপস্থিতির সময় অনেক বেশি খুশি বা অন্তত আরাম বোধ করত। যার উল্লেখ আগে করা হয়েছে, এই সময়ে সে তার বন্ধুদের চায়ের আমন্ত্রণ জানাতে পারত এবং তাদের সাথে গল্পগুজবে মেতে উঠতে পারত।
এটা শুধু বলা বাকি যে তার ছোট্ট মেয়ে তাবিথা, যাকে সে সংক্ষেপে ট্যাবি বলে ডাকতো—এই ছোট্ট মেয়েটি তার অবিরাম আনন্দের উৎস ছিল; বিশেষত যেহেতু তার আর কোনো সন্তান ছিল না। ট্যাবি ছিল ফর্সা চুলের বুদ্ধিমতী একটি উজ্জ্বল ছোট্ট মেয়ে; কৌশল ও নিজস্ব ইচ্ছাশক্তিতে সে ছিল তার মায়ের একটি উন্নত সংস্করণ, কিন্তু সব দিক থেকেই বাবার সঙ্গে তার কোনো মিল ছিল না। সবাই তাবিথাকে ভালোবাসত, এবং তাবিথাও সবাইকে ভালোবাসত। এমনকি আদিবাসীরা তাকে পূজাও করত। কাফ্রিদের এবং তাবিথার মধ্যে ছিল কোনো শক্তিশালী প্রাকৃতিক সহানুভূতির বন্ধন। তারা একে অপরকে বুঝত।
অবশেষে আঘাতটি এল।
জুলুল্যান্ডের সীমানার কাছাকাছি দেশটি পর্তুগিজ অঞ্চল হিসেবে পরিচিত, সেখানে ছিল মিশ্র জুলু এবং বাসুতো রক্তের একটি উপজাতি যাদের বলা হত আমা-সিসা, অর্থাৎ সিসার মানুষ। এখন জুলু ভাষায় "সিসা" শব্দটির একটি বিশেষ অর্থ আছে যার অনুবাদ হতে পারে "দূরে পাঠানো"। বলা হয় যে তারা এই নামটি পেয়েছিল কারণ জুলু রাজারা যখন এই পুরো অঞ্চলের ওপর কর্তৃত্ব করত তখন তারা রাজকীয় গবাদি পশুর বড় বড় পাল অন্য মানুষদের তত্ত্বাবধানে পাঠাত বা তাদের ভাষায় সিসা করত, অর্থাৎ আমরা ইংরেজিতে যাকে বলি "অ্যাজিস্টেড বা লালন-পালনের জন্য অন্যের তত্ত্বাবধানে রাখা।
তবে কেউ কেউ এর আরেকটি কারনের কথাও বলত। এই উপজাতি অঞ্চলে একটি নির্দিষ্ট স্থান ছিল যার কথা আমরা পরে আরও শুনব, যেখানে এই জুলু রাজারা তাদের আইন বা রীতিনীতির বিরুদ্ধে অপরাধীদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করতেন। এই ধরনের লোকদেরও গবাদি পশুর মতো "দূরে পাঠিয়ে দেওয়া" হতো। এই দুটি কারণের যেকোনো একটি থেকে, বা হয়তো দুটো থেকেই গোষ্ঠীটি মূলত তার এই নাম পেয়েছিল।
এটা খুব বড় উপজাতি ছিল না, সম্ভবত এতে তিনশো পঞ্চাশটি পরিবার ছিল, বা সব মিলিয়ে প্রায় দুই হাজারের কম মানুষ। এরা সম্ভবত শান্তিপ্রিয় ও পরিশ্রমী বাসুতো বংশের বংশধর যাদের উপর কিছু সংখ্যক প্রভাবশালী জুলু যোদ্ধা প্রতিহিংসাবসত পুরুষদের হত্যা করে বাসুতো মহিলা ও তাদের গবাদি পশুগুলো দখল করে নিয়েছিল। ফলস্বরূপ, এই ছোট জনগোষ্ঠীর মধ্যে দুটি ধারা হয়ে যায়। একটি যুদ্ধবাজ ধরনের, যারা প্রকৃতপক্ষে জুলুই রয়ে গিয়েছিল এবং অন্যটি নম্র এবং প্রগতিশীল বাসুতো ধরনের, যারা ছিল সংখ্যাগরিষ্ঠ।
এই সিসা উপজাতির মধ্যে মিশনারিরা কয়েক বছর ধরে কাজ করে আসছিল এবং সামগ্রিকভাবে ফলাফল সন্তোষজনক ছিল। তাদের অর্ধেকেরও বেশি খ্রিস্টান ধর্মে দীক্ষিত হয়েছিল। একটি গির্জা তৈরি হয়েছিল; কমবেশি আধুনিক কৃষিব্যবস্থা চালু করা হয়েছিল আর বেশিরভাগ মানুষ লিঙ্গ অনুযায়ী প্যান্ট বা স্কার্ট পরত। তবে সম্প্রতি বহুবিবাহের পুরানো প্রথায় সমস্যা দেখা দিয়েছিল। মিশনারিরা একাধিক স্ত্রী রাখার পক্ষপাতি ছিলেন না যেখানে এই উপজাতির জুলুরা তাদের বহুবিবাহের পুরানো অধিকার নিয়ে জেদ ধরেছিল।
বিরোধটি শেষ পর্যন্ত প্রকৃত যুদ্ধে গড়ায়, যার ফলে গির্জা ও স্কুল পুড়ে যায়, সেই সঙ্গে মিশনারির বাড়িও। এই সমস্যার কারণে ভদ্রলোকটি বৃষ্টির মধ্যে খোলা আকাশের নিচে থাকতে বাধ্য হয় কারণ তখন বর্ষাকাল চলছিল। ঠাণ্ডা লেগে হঠাৎ করে তার হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মারা যান, ইতোপূর্বে তিনি বাতজ্বরে ভুগছিলেন। মৃত্যুটা হয়েছিল তার নতুন বাসস্থানে যাওয়ার পর পরই, যেটা ছিল কিছুটা উন্নত ধরনের আঞ্চলিক কুঁড়েঘর।
এই ঘটনার পরে গোত্রপ্রধান কোসার কাছ থেকে একটি আবেদন এল। তার নামটা সম্ভবত জুলু শব্দ কুস থেকে এসেছে, যার অর্থ প্রধান বা সেনাপতি। আবেদনটি গির্জার কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠানো হয়েছিল, যেখানে নতুন একজন শিক্ষক পাঠানোর জন্য অনুরোধ করা হয়েছিল যিনি মৃত ব্যক্তির স্থলাভিষিক্ত হবেন এবং গির্জা ও স্কুল পুনর্নির্মাণ করবেন। দূতেরা বলেছিল, এটা না হলে গোত্রটি আবার পৌত্তলিকতায় ফিরে যাবে, কারণ মেনজি নামে এক বুড়ো ওঝার নেতৃত্বে জুলু ও খ্রিস্টান-বিরোধী দল শক্তিশালী হচ্ছে এবং দিন দিন তাদের প্রভাব বাড়ছে।
এই আবেদন উপেক্ষা করা যেত না, কারণ এতদিন সিসারা ছিল অন্ধকার জগতে একটি আলোর বিন্দু। আশেপাশের জুলু বংশোদ্ভূত বেশিরভাগ মানুষ এখনও পৌত্তলিক রয়ে গেছে। সেই আলো নিভে গেলে সম্ভবত তারা পৌত্তলিকই রয়ে যাবে, কিন্তু আলো জ্বলতে থাকলে হয়তো অন্য ফলাফল আশা করা যেত—কারণ ছোট্ট একটি স্ফুলিঙ্গ থেকেও বিশাল অগ্নিকাণ্ড ঘটতে পারে। তাই এই জটিল ও নাজুক পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য উপযুক্ত ব্যক্তির খোঁজ করা হল, আর শেষ পর্যন্ত দায়িত্ব পরল রেভারেন্ড থমাস বুলের ওপর।
প্রথমবার তার নাম উঠতেই সবাই সমর্থন জানাল। তারা বলল, উনিই সবচেয়ে উপযুক্ত—সাহসী, দৃঢ়চেতা, জেসুইটদের মতো আগুনঝরা উদ্দীপনায় ভরপুর (যদিও বলার অপেক্ষা রাখে না যে তিনি জেসুইটদের ঘৃণা করতেন, যেমনটা বিড়াল সরিষাকে ঘৃণা করে)। কোনো ওঝাই তাকে ভয় দেখাতে পারবে না। তার ওপর, পৃথিবীতেই তিনি অনেক সম্পদের মালিক হওয়ায় হয়তো কোনো পারিশ্রমিক চাইবেন না, বরং গির্জা পুনর্নির্মাণে বিপুল অর্থ অনুদান দেবেন। এটা ব্যাখ্যা করা প্রয়োজন যে মিশনের নিজেরই তেমন কোনো সঞ্চয় ছিল না, তাই এই বিষয়টি উপেক্ষা করার উপায় নেই।
যাবতীয় সমস্যা ও অসুবিধার কথা সততার সাথে কিন্তু কূটনৈতিকভাবে বোঝানোর পর থমাসকে ডেকে পদটির প্রস্তাব দেওয়া হল। তিনি এক মিনিটও দ্বিধা করলেন না, অথবা বড়জোর পাঁচ মিনিট; প্রায় সঙ্গে সঙ্গে রাজি হয়ে গেলেন। মনে হল এতদিন তিনি যা খুঁজছিলেন সেই আহ্বান এসে গেছে। পর্তুগিজ অঞ্চলের সেই নির্জন স্থানে তিনি কারও হস্তক্ষেপ ছাড়া একজন ছোট বিশপের মতো সম্পূর্ণ নিজের মতো থাকবেন। সব বিষয়ে নিজের মতো করে চলতে পারবেন, যা সভ্য এলাকায় তিনি পারেন না। এখানে কিছু বয়স্ক ভদ্রলোক আছেন যারা সবসময় তাদের আদিবাসী অভিজ্ঞতার কথা বলতেন, তারা ক্রমাগত তার কাজে বাধা দেওয়া সহ তার সাহসী পরিকল্পনাগুলো নস্যাৎ করে দিতেন। ওখানে অবস্থা ভিন্ন হবে। তিনি নিজের চাকা বানাবেন আর ওঝা ও তার অনুসারীদের সেই লোহার চাকার তলায় পিষে গুঁড়ো করে দেবেন। তিনি জানালেন যে তিনি এখনই যেতে চান। আর শুধু তাই নয়, গির্জা ও অন্যান্য পোড়া ভবনগুলো পুনর্নির্মাণের জন্য এক হাজার পাউন্ড দান করারও প্রতিশ্রুতি দিলেন।
বুল চলে যাওয়ার পর ডিন মন্তব্য করলেন, "বুলের পক্ষে দানটা বেশ উদার।"
"হ্যাঁ," অন্য একজন প্রভাবশালী ব্যক্তি বললেন, "তবে আমার মনে হয় এই অঙ্গীকারটা শর্তসাপেক্ষ ভাবতে হবে। আমি জানি যে, টাকাটা মিসেস বুলের।"
"সম্ভবত তিনি এই বন্ডে সই করে দেবেন কারণ তিনি একজন উদারমনা মহিলা," ডিন বললেন, "আর যাই হোক আমাদের ভাই বুল নিশ্চয়ই সেই বিপজ্জনক মেনজি আর তার দলবলের পেট থেকে হাওয়া বের করে দেবেন।"
"আপনি কি তাই মনে করেন?" অন্যজন জিজ্ঞাসা করলেন। আমি ততটা নিশ্চিত নই। আমি বুড়ো মেনজির সাথে দেখা করেছি, সে খুব শক্ত একটা বাদাম—যার খোসা ভাঙা সহজ নয়। বরং সে-ই হয়ত তার পেট থেকে হাওয়া বের করে দেবে। বুল যতই ভালো আর দুর্দান্ত হোক, আমার মনে হয় তিনি আদিবাসীদের ঠিকমতো বোঝেন না, বা এটা বোঝেন না যে তাদের তাড়ানোর চেয়ে নেতৃত্ব দেওয়াটা সহজ।"
"হয়তো আপনার কথাই ঠিক," ডিন বললেন, "কিন্তু এই সিসাদের ক্ষেত্রে এটা বরং হবসনের পছন্দের মতো ব্যাপার, তাই না?"
এভাবে বিষয়টি নিষ্পত্তি হল, আর যথাসময়ে থমাস সিসা স্টেশনের প্রধান পুরোহিত হিসেবে নিয়োগপত্র পেলেন।
কয়েকদিন পর তিনি বাড়ি ফিরলেন—যদিও তার পরের সপ্তাহে ফেরার কথা ছিল। থমাস এতটাই ব্যস্ত ছিলেন যে তিনি তার স্ত্রীর স্নেহপূর্ণ অভিবাদন খুব একটা লক্ষ্য করলেন না। এমনকি তার স্ত্রী ও তাবিথা দুজনেই যে চমৎকার আর মিশনারি-অনুপযোগী পোশাক পরে আছে সেটাও তার দৃষ্টি এড়িয়ে গেল। ডরকাসকেও বেশ চিন্তিত দেখাচ্ছিল, আসলে সে বিকেলে কয়েকজন তরুণ-তরুণী, স্থানীয় অফিসার আর মেয়েদের টেনিস খেলার জন্য আমন্ত্রণ জানিয়েছিল আর কয়েকজনকে রাতের খাবারের জন্য থাকতে বলেছিলো। এখন সে ভাবছিল তার কঠোর স্বামী এই খবরটি কীভাবে নেবেন। তিনি হয়তো রেগে যাবেন আর বক্তৃতা দেবেন; রাগ আর বক্তৃতা—দুটো একসাথে হলে সেটা মোটেই মনোরম হয় না।
স্বাস্থ্য আর একজন অসুস্থ ব্যক্তি নিয়ে কিছু আনুষ্ঠানিক জিজ্ঞাসাবাদ হল। ডরকাস তাকে আশ্বস্ত করল যে তারা দুজনেই বেশ ভালো আছে, বিশেষত তাবিথা, আর নির্দেশ মতো সে অসুস্থ মহিলাকে দেখতেও গেছে।
"আর সে কেমন আছে, প্রিয়?" তিনি জিজ্ঞেস করলেন।
"জানি না, প্রিয়," সে উত্তর দিল। "আসলে, বাড়িতে গিয়ে দরজায় রেক্টরের স্ত্রী মিসেস টমলির সাথে দেখা হল, আর তিনি বেশ স্পষ্ট করেই বললেন যে তিনি আর তার স্বামী এই ব্যাপারটা দেখভাল করছেন। তোমার দেওয়া সাহায্যের জন্য কৃতজ্ঞ হলেও তারা মনে করেন আমাদের আর কষ্ট করার প্রয়োজন নেই, কারণ রোগীটি তাদেরই প্যারিশের।"
"তাই নাকি?" থমাস ভ্রু কুঁচকে বললেন। "সব মিলিয়ে দেখতে গেলে—আচ্ছা, ঠিক আছে থাক।"
ডরকাস এতেই বেশ খুশি হল, কারণ সে জানত যে স্বামীর সদয় হৃদয়কে কেউ কেউ অন্যের ব্যক্তিগত ব্যাপারে হস্তক্ষেপ বলে মনে করত—আসলে অঞ্চলটা ছিল বেশ বিপজ্জনক।
"আজ বিকেলের একটা ব্যবস্থা নিয়ে তোমাকে কিছু বলার আছে," সে নার্ভাসভাবে বলল।
মিস্টার বুল তখন এক গ্লাস পানি খাচ্ছিলেন (তিনি মদ্যপান ও ধূমপান করতেন না, তার একটি অভিযোগ ছিল যে তার স্ত্রী পলিনের কারণে সামান্য ওয়াইন পান করা জরুরি মনে করত)—গ্লাসটা নামিয়ে রেখে বললেন:
"তোমার বিকেলের ব্যবস্থার কথা থাক, প্রিয়; এগুলো পরেও করতে পারবে। আসলে আমার তোমাকে কিছু বলার আছে, খুব গুরুত্বপূর্ণ কিছু। আমার আহ্বান এসেছে।"
"তোমার আহ্বান, প্রিয়। কী আহ্বান? আমি জানতাম না তুমি কাউকে আশা করছ—আর যাইহোক——।" সে আর বলতে পারল না, কারণ স্বামী তার কথায় বাধা দিয়েছে।
"বোকামি কোরো না, ডরকাস। আমি বলেছি আহ্বান—কোন ব্যক্তির কথা বলিনি।"
"ওহ! আমি বুঝেছি, আমাকে মাফ করো, আমি এত বোকা হয়েছি। তারা কি তোমাকে বিশপ বানিয়েছে?"
"একজন বিশপ——?"
"মানে একজন ডিন, বা আর্চডিকন, বা এ জাতীয় কিছু!" সে বিভ্রান্তভাবে বলল।
"না, ডরকাস, তারা তা করেনি। এখনও পদোন্নতির আশা করা ঠিক হবে না, যদিও আমি ভেবেছিলাম—কিন্তু থাক, নিশ্চয়ই অন্যদের আরও ভালো দাবি আর দীর্ঘ সময়ের সেবা আছে। তবে আমাকে একটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে সম্মানিত করা হয়েছে।"
"সত্যিই, প্রিয়। কী দায়িত্ব?"
"আমাকে সিসা স্টেশনের প্রধান পুরোহিত হিসেবে মনোনীত করা হয়েছে।"
"ও-ওহ! আর সেটা কোথায়? এটা কি ডারবানের কাছাকাছি, নাকি ম্যারিটজবার্গের কাছাকাছি কোথাও?"
"আমি এখনও ঠিক জানি না, তবে শুনেছি জুলুল্যান্ডের এশোয়ে থেকে প্রায় ছয় দিনের পথ, কিন্তু পর্তুগিজ অঞ্চলের সীমানার ওপারে। আসলে নিশ্চিত নই যে পুরো পথটাই পায়ে হেঁটে যাওয়া যায় কিনা, অন্তত যখন নদীতে বন্যার পানি থাকে। তখন দড়িতে ঝোলানো ঝুড়িতে করে একটা নদী পার হতে হয়, অথবা নদীতে খুব বেশি পানি না থাকলে ছোট নৌকায় কাজ চলে যায়। যদিও এই মৌসুমে ঝুড়ি বেশি ব্যবহৃত হয়।"
"হায় আল্লাহ! থমাস, তুমি কি আমাকে আর ট্যাবিকে সেন্ট পলের মতো ঝুড়িতে করে পার করাতে চাও? আর তুমি কি ভুলে গেছ যে আমরা এই বাড়িটা আরেক বছরের জন্য ভাড়া নিয়েছি?
"অবশ্যই চাই। মিশনারিদের পরিবারকে কষ্টসহ্য করার জন্য প্রস্তুত থাকতে হয়, যদিও এটা সত্য যে এখন পর্যন্ত পরিস্থিতি তোমাকে এসব থেকে দূরে রেখেছে। তাই এখন শুরু করাটাই ঠিক হবে, যখন তাবিথা তার বয়সী যে কোনো শিশুর মতোই শক্তিশালী হয়ে উঠেছে। বাড়ির ব্যাপারে আমি একদম ভুলেই গিয়েছিলাম। এটা আবার ভাড়া দিতে হবে নতুবা লোকসানটা আমাদেরই সহ্য করতে হবে, যেটা সৌভাগ্যক্রমে আমরা সহজেই বহন করতে পারি।"
ডরকাস তার দিকে তাকিয়ে আর কিছুই বলল না কারণ সে কোন কথা খুঁজে পাচ্ছিল না, তাই তিনি তাড়াতাড়ি বলে চললেন।
যাই হোক, প্রিয়, তোমার নাম করে আমি একটু স্বাধীনতা নিয়েছি। শুনেছি সিসার গির্জাটা বেশ সুন্দর ছিল এবং আমার একজন পূর্বসূরি ইংল্যান্ড থেকে প্রভাব বা সম্পর্কের মাধ্যমে অনুদান সংগ্রহ করে সেটা তৈরি করেছিলেন। সেটা সম্প্রতি মিশন হাউসের সঙ্গে পুড়ে গেছে। এখন নতুন বাড়ির জন্য অপেক্ষা করতে হবে; অবশ্য এক বা দুই বছর স্থানীয় কুঁড়েঘরে কোনোরকমে থাকতে পারব, কিন্তু স্পষ্টতই আমাদের একটা গির্জা দরকার, এবং মিশনের অর্থাভাব থাকায় তারা এ ব্যাপারে সাহায্য করতে পারবে না। এই পরিস্থিতিতে আমি এক হাজার পাউন্ড দান করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছি, যা গির্জা এবং বাড়ি পুনর্নির্মাণের খরচ মেটাবে বলে ধারণা করা যায়।
উত্তরের অপেক্ষায় তিনি থামলেন, কিন্তু ডরকাস এখনও কিছু না বলায় তিনি আবার শুরু করলেন।
"তোমার কি মনে আছে, তুমি খুব সম্প্রতি আমাকে বলেছিলে যে তোমার কাছে দেড় হাজার পাউন্ড জমা আছে। তাই আমি নিশ্চিত ছিলাম যে তুমি এর মধ্যে এক হাজার পাউন্ড দিতে কার্পণ্য করবে না যাতে আমি এই ঐশ্বরিক দায়িত্ব পালন করতে পারি।"
"ওহ!" ডরকাস বলল। "আসলে আমি সেই এক হাজার পাউন্ড বা তার বেশিরভাগটাই অন্য কাজে খরচ করার পরিকল্পনা করেছিলাম। এখানে কিছু মানুষ আছে যাদের আমি সাহায্য করতে চেয়েছিলাম, তবে সৌভাগ্যবশত তাদের এ কথা বলিনি; এক্ষেত্রে তাদের টাকা এবং ছুটি ছাড়াই কাটাতে হবে। আর বাচ্চাদেরও স্কুলে পাঠানো যাবে না। আর যাইহোক, এই দূরের জায়গায় ট্যাবির শিক্ষাটা কীভাবে হবে?"
"দুঃখিত, প্রিয়, কিন্তু শেষ পর্যন্ত ব্যক্তিগত বিলাসিতা, দানশীলতাসহ সব কিছু পবিত্র প্রয়োজনের কাছে নতি স্বীকার করতে হবে, তাই আমি ডিনকে লিখব যে প্রয়োজনের সময় অর্থ পাওয়া যাবে। আর আমরা দুজন মিলে অন্তত আগামী কয়েক বছরের জন্য ট্যাবির লেখাপড়ার দায়িত্ব নেব।"
"হ্যাঁ, থমাস, যেহেতু তুমি তোমার কথা দিয়েছ, টাকা আমি দেব কিন্তু যদি তুমি আমাকে বাকি ৫০০ পাউন্ড রেখে দিতে বল তাহলে আমি পরামর্শ দেব যে আমি ট্যাবিকে নিয়ে এখানেই থাকি যেন সে কলেজে পড়তে পারে; আর তুমি এই বর্বরদের মধ্যে আমাদের থাকার জন্য একটি জায়গা তৈরি করো।"
"প্রিয়," টমাস উত্তর দিলেন, "তুমি কী চাইছ সেটা ভেবে দেখো। তুমি সম্পূর্ণ সুস্থ আর আমাদের সন্তানও তাই। তাহলে এটা কি চরম কেলেঙ্কারি হবে না যে তুমি এখানে বিলাসিতায় থাকবে আর তোমার স্বামী সিসাদের মধ্যে গুরুতর সমস্যার মুখোমুখি হতে যাবে? কারণ আমি তোমাকে এখনই বলে দিচ্ছি যে সমস্যাগুলো অত্যন্ত গুরুতর। এই জনগোষ্ঠীর মধ্যে মেনজি নামে এক কুখ্যাত ওঝা আছে, যে সম্ভবত মিশন হাউস পুড়িয়েছে, এবং সম্ভবত গির্জাও কারণ সে বলেছিল যে একজন অবিবাহিত পুরোহিতের জন্য এত বড় বাড়িতে একা থাকাটা হাস্যকর। এটা অবশ্যই তার বর্বর ক্রোধের জন্য একটা ধূর্ত অজুহাত; কিন্তু যদি আরেকজন আপাতদৃষ্টিতে অবিবাহিত মানুষ আসে, সে হয়তো আবার এই যুক্তি ও তার প্রয়োগ দেখাবে। এছাড়া প্রায়ই এই বর্বররা মনে করে যে যে অবিবাহিত পুরুষ অবশ্যই পাগল! তাই একেবারে শুরু থেকে তুমি এবং শিশুটির আমার সঙ্গে থাকা একান্ত জরুরি।"
"ওহ! তাই নাকি?" ডরকাস রাগে লাল হয়ে বলল। "ঠিক আছে, আমি দুঃখিত যে এই মুহূর্তে আমাকে একটু যেতে হবে কারণ আজ বিকেলে আমার একটা টেনিস পার্টি আছে। গ্যারিসনের অফিসাররা আসছেন সাথে প্রায় আধা ডজন মেয়ে, আর আমাকে চায়ের ব্যবস্থা করতে যেতে হবে।"
"একটা টেনিস পার্টি! সেই প্রভুবিমুখ অফিসার এবং মেয়েদের জন্য টেনিস পার্টি?" তার স্বামী চিৎকার করে বললেন। "আমি তোমার জন্য লজ্জিত, ডরকাস; তোমার উচ্চতর বিষয় নিয়ে ব্যস্ত থাকা উচিত।"
"জানো, থমাস," সে লাফিয়ে উঠে উত্তর দিল, "আমিও তোমার জন্য লজ্জিত হতে চাই, তোমার মনে হয় নিজের রাগ সামলানো নিয়ে ব্যস্ত থাকা উচিত। তুমি আমার সঙ্গে পরামর্শ না করে কিছু অদ্ভুত মিশন গ্রহণ করেছ, আমার সঙ্গে পরামর্শ না করে আমার এক হাজার পাউন্ডের প্রতিশ্রুতি দিয়েছ, আর এখন তুমি আমাকে তিরস্কার করছ কারণ আমি কয়েকজন তরুণ-তরুণীকে টেনিস খেলতে এবং রাতের খাবারে খেতে আমন্ত্রণ জানিয়েছি। এটা অখ্রিস্টান, এটা নিষ্ঠুর, এটা—অত্যন্ত খারাপ!" এবং আবার বসে পড়ে সে কান্নায় ফেটে পড়ল।
রেভারেন্ড থমাস যিনি ততক্ষণে সত্যিই প্রচণ্ড রাগে ফুঁসছেন, কী বলবেন বা করবেন বুঝতে না পেরে চারদিকে তাকালেন। দুর্ভাগ্যবশত তার চোখ পড়ল ম্যান্টেলপিসের ওপর রাখা একটা সিগারেটের প্যাকেটের ওপর।
"এই জিনিসগুলো এখানে কী করছে?" তিনি জিজ্ঞেস করলেন। "আমি ধূমপান করি না, তাই এগুলো আমার জন্য হতে পারে না। আমাদের টাকা—দুঃখিত, তোমার টাকা, যা অন্য দিকে এত প্রয়োজন, সেই অফিসারদের এবং অলস মেয়েদের জন্য এই অপ্রয়োজনীয় জিনিসগুলো কিনতে নষ্ট হচ্ছে? ওহ ধিক্কার—সব শয়তানের কাছে যাক।" তিনি সিগারেটগুলো বের করে খোলা জানালা দিয়ে ছুঁড়ে ফেললেন, সাদা টিউবগুলো চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল যা বাইরের কিছু কাফ্রি সঙ্গে সঙ্গে কুড়ানো শুরু করল।
তারপর তিনি বাড়ি থেকে ছুটে বেরিয়ে গেলেন, আর ডরকাস তার পার্টির জন্য প্রস্তুত হতে গেল। কিন্তু প্রথমে সে একজন চাকরকে পাঠাল আরেকটা সিগারেটের প্যাকেট কিনে আনতে। এটা ছিল রেভারেন্ড থমাস বুলের কঠোর শাসনের বিরুদ্ধে তার প্রথম বিদ্রোহ।
হেনরি রাইডার হ্যাগার্ড এর দ্য ব্লু কার্টেনস (The Blue Curtains) রূপান্তর মেহেদী হাসান
“দ্য ব্লু কার্টেনস” গল্পটি প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল ১৯২০ সালে। এটা স্যার হেনরি রাইডার হ্যাগার্ডের 'স্মিথ অ্যান্ড দ্য ফারাওস, অ্যান্ড আদার টেলস' বইয়ের একটি গল্প। এই সংগ্রহে মোট ছয়টি গল্প আছে। গল্পগুলো হলো: 'স্মিথ অ্যান্ড দ্য ফারাওস', 'মাগেপা দ্য বাক', 'দ্য ব্লু কার্টেন্স', 'দ্য লিটল ফ্লাওয়ার', 'ওনলি আ ড্রিম' এবং 'বারবারা হু কেম ব্যাক'। বইটিতে 'দ্য ব্লু কার্টেনস' হচ্ছে তৃতীয় গল্প।
---------------------------------------------------------
পর্বঃ এক
তার রেজিমেন্টে সবাই তাকে 'বোতল' বলে ডাকত, যদিও কেউ জানতো না ঠিক কি কারনে তাকে এই নামে ডাকা হয়। তবে গুজব ছিল হ্যারো স্কুলে তার নাকের আকৃতির জন্য তাকে এই ডাকনাম দেওয়া হয়েছিল। যদিও তার নাকটা বোতলের মতো ছিল না, শুধু নাকের ডগাটা গোলাকার, বড় আর মোটা ছিল। কিন্তু সত্যি বলতে এই ডাকনাম আরও পুরনো—অর্থাৎ নামটা তার শৈশব থেকেই ছিল। যখন কাউকে ডাকনাম দেওয়া হয় তখন দুটো জিনিস বোঝায়। প্রথমত সে মিশুক আর হাসিখুশি এবং দ্বিতীয়ত সে খুব ভালো মানুষ। আমাদের গল্পের নায়ক বোতলের মধ্যে এ দুটো গুণই রয়েছে। তার আসল নাম জন জর্জ পেরিট। এখানে তার রেজিমেন্টের নাম বলার প্রয়োজন নেই। তার মতো দয়ালু আর ভালো মানুষ খুব কমই দেখা যায়। তবে তার চেহারা? মোটা গোল নাক, ঝোপালো ভ্রুর নিচে বসানো হালকা ধূসর বর্ণের ছোট ছোট চোখ আর বড় একটি মুখ—এগুলোকে সুন্দর বলা যায় না। কিন্তু সে ছিল লম্বা ও শক্তিশালী এবং শান্ত স্বভাবের।
বহু বছর আগে বোতল প্রেমে পড়েছিল; পুরো রেজিমেন্টই তা জানত কারণ তার প্রেম ছিল স্পষ্ট আর গভীর। তার সুন্দর করে গোছানো কোয়ার্টারের বিছানার উপরে এক তরুণীর ছবি ঝুলত; সবাই জানত এটাই সেই মেয়ে। রেজিমেন্টের সদস্যরা যখনই এই ছবিটি দেখত, তাদের মনে কোন সন্দেহ থাকত না যে তাদের সহযোদ্ধার রুচি কতটা চমৎকার। সেই রঙ্গিন ছবিটা ঝাপসা হলেও বোঝা যেত মিস ম্যাডেলিন স্পেন্সারের একটি সুন্দর চেহারা এবং একজোড়া বিস্ময়কর চোখ রয়েছে। তবে শোনা যেত তার কাছে একটি পয়সাও নেই এবং আমাদের নায়কেরও খুব বেশি কিছু ছিল না, তাই ব্যাটালিয়নের বিবাহিত মহিলারা প্রায়ই বলত "মিস্টার পেরিট বিয়ে করলে কীভাবে সংসার চালাবেন?"
এই সময়ে রেজিমেন্টটি নাটালের ম্যারিটজবার্গে ছিল এবং যেহেতু তাদের বিদেশি দায়িত্ব শেষ হয়ে এসেছিল তাই তারা ভেবেছিল হয়ত শিগগিরই দেশে ফিরে যাবে।
এক সকালে বোতল ম্যারিটজবার্গ গ্যারিসনের সেই সময়কার অস্থায়ী সেনা দলের শিকারি কুকুরের দল নিয়ে হরিণ শিকারে গিয়েছিল। শিকারটা বেশ উপভোগ্য ছিল! খোলা মাঠে সাত-আট মাইল দৌড়ে তারা সত্যিই একটা সুন্দর ওরিবে হরিণ শিকার করে ফেলল। এমনটা খুব কমই হত তাই বোতল খুব আনন্দ আর গর্ব নিয়ে হরিণটা স্যাডেলের পেছনে বেঁধে ফিরছিল। শিকার শুরু হয়েছিল ভোরে। শিকারি দলটি সকাল ন’টার সময় ধুলোমাখা চার্চ স্ট্রিটের ছায়াযুক্ত পথে ঘর্মাক্ত আর ক্লান্ত অবস্থায় ঘোড়া দৌড়িয়ে ফিরছিল আর তখনই হঠাৎ গভর্নমেন্ট হাউসের পেছনের কেল্লা থেকে একটি বন্দুকের আওয়াজ ইংরেজ মেইলের আগমন ঘোষণা করল।
এক চিলতে হাসি মুখে নিয়ে বোতল তার ঘরের দিকে এগিয়ে গেল। তার কাছে ইংরেজ মেইল মানেই ম্যাডেলিনের একটা বা দুইটা চিঠি আর সম্ভবত দেশে ফেরার খুশির খবর! সে নিজের কোয়ার্টারে চলে গেল—গোসল করে পোশাক পাল্টাল; তারপর নাস্তার জন্য মেস-হাউসে নামল। সে আশা করছিল হয়ত চিঠিগুলো ইতোমধ্যে এসে গেছে। কিন্তু মেইলটা বেশ ভারী ছিল ফলে সে আরাম করে নাস্তা শেষ করে বারান্দায় বসে একটা পাইপ ধরাল। বাঁশ আর ক্যামেলিয়া গাছের ছায়ায় বারান্দাটা ছিল বেশ আরামদায়ক। অবশেষে অর্ডারলি চিঠির ব্যাগ নিয়ে হাজির হল।
বোতল সাথে সাথেই বারান্দা সংলগ্ন ঘরে ঢুকে শান্তভাবে দাঁড়িয়ে রইল কারণ সে কখনোই নিজের আবেগ প্রকাশ করত না। আর মেস সার্জেন্ট ধীরে ধীরে, বেশ অগোছালোভাবে চিঠিগুলো বাছাই করছিল। অবশেষে বোতল তার প্যাকেট হাতে পেল যার মধ্যে শুধু কিছু খবরের কাগজ আর একটা মাত্র চিঠি। সে কিছুটা হতাশ মনে আবার বারান্দায় চলে এলো। সে আশা করেছিল শুধু তার প্রেমিকা নয় বরং তার একমাত্র ভাইও তার কাছ চিঠি লিখবে। ধীর ও সুচিন্তিত মনের মানুষ বোতল পাইপটি আবার ধরাল—কারণ সে জানে আনন্দকে একটু বিলম্বিত করালে তা বরং আরও বেড়ে যায়। লাল ফুলে ফুলে উজ্জ্বল ক্যামেলিয়া গাছের সামনে বড় চেয়ারে গা এলিয়ে বসে বোতল চিঠিটা খুলে পড়তে আরম্ভ করল:
"আমার প্রিয় জর্জ——"
"হায় আল্লাহ!” মনে মনে চমকে উঠল সে, "এটা কী হলো? ও তো আমায় সবসময় 'ডার্লিং বোতল' বলে ডাকে!"
"আমার প্রিয় জর্জ," সে আবার পড়তে শুরু করল, "আমি জানি না কিভাবে এই চিঠি শুরু করব—আমি কাঁদতে কাঁদতে কাগজটাই দেখতে পাচ্ছি না; আর যখন ভাবি তুমি এই ভয়ানক দেশে বসে এটা পড়ছ, তখন আরও বেশি কান্না পায়। থাক! বরং সোজাসুজিই বলি—সব শেষ, আমাদের মধ্যে সব শেষ, আমার প্রিয়, প্রিয় বুড়ো বোতল।"
"সব শেষ!" বোতল নিজের মনে ফুঁপিয়ে উঠল।
"আমি সত্যিই জানি না কীভাবে এই করুণ গল্পটি বলব" বোতল আবার চিঠিতে ফিরে এলো "কিন্তু বলতেই হবে তাই আমি মনে করি শুরু থেকেই বলা ভাল। এক মাস আগে আমি, বাবা ও খালার সাথে অ্যাথার্টনের হান্ট বল-এ গিয়েছিলাম এবং সেখানে আমার দেখা হয় স্যার আলফ্রেড ক্রস্টনের সঙ্গে—একজন মধ্যবয়স্ক ভদ্রলোক যিনি আমার সঙ্গে কয়েকবার নাচলেন। আমার তাকে তেমন একটা পছন্দ হয়নি। তবে তিনি নিজেকে খুবই আকর্ষণীয় করে উপস্থাপন করেছিলেন। বাড়ি ফিরে খালা (তুমি তো তার বিরক্তিকর অভ্যাস সম্পর্কে জানো) আমাকে বললেন যে আমি তাকে জয় করে নিয়েছি। পরদিন ভদ্রলোক বাড়িতে এলেন। বাবা তাকে ডিনারে আমন্ত্রণ জানালেন এবং তিনি আমার পাশের চেয়ারেই বসলেন। যাওয়ার আগে বললেন হ্রদে ট্রাউট মাছ ধরার জন্য তিনি জর্জ ইনে থাকতে আসছেন। এরপর থেকে প্রায় প্রতিদিনই তিনি এখানে আসতে লাগলেন আর আমি যখনই হাঁটতে বেরুতাম—তিনি সবসময় আমার সাথে দেখা করতেন আর সত্যি বলতে বেশ ভালো ব্যবহার করতেন। অবশেষে একদিন তিনি আমাকে বিয়ের প্রস্তাব দিলেন। আমি খুব রেগে গিয়ে তাকে বললাম যে আমি একজন আর্মি অফিসারের সঙ্গে বাগদান করেছি যিনি এখন দক্ষিণ আফ্রিকায় আছেন। তিনি হেসে বললেন, দক্ষিণ আফ্রিকা এখান থেকে অনেক দূরে। সেদিন সন্ধ্যায় বাবা আর খালা আমাকে বোঝাতে শুরু করলেন।
প্রিয় বোতল, তুমি জানো তারা কেউই আমাদের বাগদান পছন্দ করত না আর তারা বলল—আমাদের সম্পর্কটা একদমই হাস্যকর এবং এমন প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করা মানে আমি পাগল হয়ে গেছি। এভাবে চলতেই থাকলো কারন তিনি নাছোড়বান্দা আর শেষ পর্যন্ত প্রিয়, আমাকে হার মানতেই হলো কারণ ওরা আমাকে একটুও শান্তি দেয়নি। বাবা কেঁদে কেঁদে বললেন এই বিয়ে তার জীবন বদলে দেবে। তাই আমি রাজি হয়েছি আর এখন মনে হয় আমি বাগদান করেছি।
প্রিয়, প্রিয় জর্জ, আমার ওপর রাগ কোরো না। এটা আমার দোষ নয় আর আমি মনে করি আমরা শেষ পর্যন্ত বিয়ে করতে পারতাম না কারণ আমাদের টাকাপয়সার পরিমান অনেক কম। আমি তোমাকে ভালোবাসি কিন্তু কিছুই করতে পারছি না। আমাকে ভুলে যেও না। অন্য কাউকে বিয়ে করো না—অন্তত এখনই নয় কারন এটা ভাবলেই আমার কষ্ট হয়। আমাকে চিঠি লিখে জানিও তুমি আমাকে ভুলবে না এবং তুমি আমার উপর রাগ করোনি। তুমি কি তোমার চিঠিগুলো ফেরত চাও? যদি তুমি আমার চিঠিগুলো পুড়িয়ে ফেলো তাহলেই হবে। বিদায়, প্রিয়! আমি কত কষ্ট পাচ্ছি তুমি যদি তা জানতে! খালার মতো সম্পত্তি ও হীরের কথা বলা সহজ কিন্তু সেগুলো তোমার অভাব পূরণ করতে পারবে না।
বিদায়, প্রিয়। মাথা এতটাই ধরেছে যে আর লিখতে পারছি না।
তোমারই,
“ম্যাডেলিন স্পেন্সার।”
জর্জ পেরিট ওরফে বোতল, চিঠিটা পড়া শেষ করে আবারও একবার পড়ল তারপর অভ্যস্ত নিয়মে সযত্নে ভাঁজ করে পকেটে রাখল। অতঃপর লাল ক্যামেলিয়া ফুলগুলোর দিকে তাকিয়ে রইলো—মনে হচ্ছে সেগুলো হাতের নাগালে নয় বরং অনেক অনেক দূরে। একদম কুয়াশাচ্ছন্ন ও ঘোলাটে।
"এটা অনেক বড় আঘাত" সে মনে মনে বলল। "বেচারি ম্যাডেলিন! ও কত কষ্ট পাচ্ছে!"
কিছুক্ষণ পর সে উঠে দাঁড়াল এবং কিছুটা অস্থিরভাবে কোয়ার্টারের দিকে হেটে গেল। তাকে খুবই বিপর্যস্ত দেখাচ্ছিল। নিজের ঘরে গিয়ে এক টুকরো চিঠির কাগজ নিয়ে দ্রুত লিখতে শুরু করল কারন আউটগোয়িং মেইলটা ধরতে হবে:
"আমার প্রিয় ম্যাডেলিন,
তোমার চিঠি পেয়েছি যেখানে তুমি আমাদের বাগদান ভেঙে দিয়েছ। তুমি নিশ্চয়ই অনেক কষ্ট পাচ্ছ তাই আমি নিজের কথা বলতে চাই না তবু বলতেই হয় এটা আমার জন্য বড় এক আঘাত। আমি এত বছর ধরে তোমাকে ভালোবেসেছি, মনে হয় ছোটবেলা থেকেই; আর এখন তোমাকে হারানো সত্যিই কষ্টের। আমি ভেবেছিলাম দেশে ফিরলে হয়তো কোনো মিলিশিয়া রেজিমেন্টে অ্যাডজুট্যান্টের পদ পাব এবং তখন আমরা বিয়ে করতে পারব। বছরে পাঁচশো পাউন্ডে হয়তো চালিয়ে নিতাম যদিও তোমাকে তোমার অভ্যস্ত আরাম-আয়েশ ছেড়ে দিতে বলার কোনো অধিকার আমার নেই কিন্তু প্রেমে পড়লে মানুষ একটু স্বার্থপর হয়েই যায়। যাই হোক, এখন সব শেষ কারণ তোমার জীবনে বাধা হয়ে দাঁড়ানোর কথা আমি ভাবতেও পারি না।
প্রিয় ম্যাডেলিন, আমি তোমাকে খুব ভালোবাসি আর তুমি এত সুন্দর ও নাজুক যে একজন দরিদ্র সাব-অলটার্নের স্ত্রী হওয়া তোমার জন্য যুতসই নয়। আমি সত্যি বলছি, আমি চাই তুমি সুখী হও। তোমাকে বেশি বেশি আমার কথা ভাবতে বলব না কারণ তাতে হয়তো তোমার কষ্টই বাড়বে। তবে কখনো কখনো একা থাকলে যদি পুরনো এই প্রেমিকের কথা একটু মনে পড়ে, আমি খুশি হব—কারণ আমি নিশ্চিত যে কেউই তোমাকে আমার চেয়ে বেশি ভালোবাসতে পারবে না। কথা দিলাম, আমি তোমায় ভুলব না এবং অন্য কাউকে বিয়েও করব না। মেইল ধরতে হলে এখনই চিঠিটা শেষ করতে হবে; আমার আর কিছু বলার নেই। এটা খুব কঠিন একটি পরীক্ষা—খুবই; কিন্তু দুর্বল হলে চলবে না। আর এই ভেবে আমি সান্ত্বনা পাই যে তুমি নিজের উন্নতি করছ। বিদায়, প্রিয় ম্যাডেলিন। আল্লাহ তোমার মঙ্গল করুন, এটাই আমার চিরদিনের প্রার্থনা।
"জে. জি. পেরিট।"
চিঠিটা শেষ করে তাড়াহুড়োয় পাঠিয়ে দিয়েছে এমন সময় বাইরে জোরে একটা ডাক শোনা গেল, "বোতল, বোতল, বন্ধু আমার, আয়, আনন্দ কর—আদেশ এসে গেছে—আমরা দু'সপ্তাহের মধ্যে রওনা হবো!" এই কথাগুলো বলতে বলতে সেই কণ্ঠের মালিক ঘরে ঢুকল। সেও একজন সাব-অলটার্ন আর বোতলের ঘনিষ্ঠ বন্ধু।
"কিরে, তোকে তো আনন্দিত দেখাচ্ছে না" বলল সে। বোতলের মুখটা মলিন আর হতভম্ব দেখাচ্ছিল।
"না, তেমন কিছু না। তাহলে তুই দুই সপ্তাহ পরে যাচ্ছিস?" বোতল বলল।
" 'তুই যাচ্ছিস?' মানে কী? আমরা সবাই যাচ্ছি! কর্নেল থেকে ড্রামার ছেলে পর্যন্ত!" বন্ধুটা বলল।
"আমি মনে হয় না যাব, জ্যাক" বোতল একটু ইতস্তত উত্তর দিল।
"কী বলছিস, বন্ধু? তুই কি পাগল হয়ে গেছিস? নাকি বেশি গিলে ফেলেছিস?" জ্যাক জিজ্ঞেস করল।
"না, মোটেও না। আমার মাথা ঠিক আছে। অন্য কিছুও খাইনি!" বোতল বলল।
"তাহলে কী বলতে চাস?" জ্যাক জানতে চাইল।
"মানে, সংক্ষেপে বললে, আমি চাকরি ছেড়ে দিচ্ছি। এই জায়গার আবহাওয়া আমার ভালো লাগে। আমি চাষবাস করব।" বোতল বলল।
"চাকরি ছাড়বি? চাষবাস করবি? এই ভয়ানক জায়গায়? তুই নিশ্চয় মাতাল!" জ্যাক বলল।
"না, সত্যিই।" বোতল বলল।
"আর বিয়ের কী হবে? তোর বাগদত্তা মেয়েটির কী হবে? তুই তো তাকে দেখার জন্য এত উৎসুক ছিলিস। সেও কি চাষবাস করবে?" জ্যাক উৎসুক হয়ে জিজ্ঞেস করলো।
বোতলের মুখটা আরও মলিন হয়ে গেল।
"না, দেখ, আমাদের সম্পর্ক শেষ। আমি এখন আর বাগদান করা নই।" বোতল বলল।
"ওহ, তাই" জ্যাক অস্বস্তিতে চলে গেল।
পর্বঃ ২
চাকরি ছাড়ার পর আজ প্রায় বারো বছর হতে চলল; আর এই বারো বছরে বোতলের জীবনে অনেক কিছুই ঘটে গেছে। এর মধ্যে সম্প্রতি এমনও হয়েছে, তার একমাত্র বড় ভাই অপ্রত্যাশিতভাবে ব্যারোনেট উপাধি আর বছরে আট হাজার পাউন্ড পেয়ে গেল এবং বোতল নিজেও পেল কয়েকশো পাউন্ডের একটি মাঝারি কিন্তু তার একার জন্য যথেষ্ট সম্পত্তি। খবরটা যখন তার কাছে পৌঁছায়, তখন সে কেপ কলোনির বাসুটো যুদ্ধের একটিতে স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর ক্যাপ্টেন ছিল। সে যুদ্ধে তার দায়িত্ব শেষ করে বড় ভাইয়ের অনুরোধে এবং নিজ দেশ দেখার তীব্র আকাঙ্ক্ষায় প্রায় চৌদ্দ বছর পর কমিশন ছেড়ে ইংল্যান্ডে ফিরে আসে।
আর এভাবেই এই গল্পের পরের দৃশ্যগুলো দক্ষিণ আফ্রিকার মাঠে বা আধা-শহুরে ঔপনিবেশিক কলোনির কোন সাদা বাড়িতে নয় বরং চিত্রায়িত হবে অ্যালবানির সবচেয়ে আরামদায়ক কোন ঘরে যেখানে বাস করেন বোতলের সেই অবিবাহিত বড় ভাই, স্যার ইউস্টেস পেরিট।
কোন এক নভেম্বরের রাতে উষ্ণ ফায়ারপ্লেসের সামনে একটি আরামদায়ক চেয়ারে বসে আছে বোতল। চেহারাটা আগের তুলনায় আরও বড়, আরও কুৎসিত আর লাজুক হয়েছে—উপরন্তু গালে রয়েছে আসেগাই-এর আঘাতের দাগ। ঠিক বিপরীতে বসে মাঝে মাঝে স্নেহময় কৌতূহলে চশমার ফাঁক দিয়ে তাকিয়ে তাকে দেখছে তার ভাই। স্যার ইউস্টেস পেরিটের বয়স ত্রিশ থেকে পঞ্চাশের মধ্যে হবে, লন্ডন-সুলভ চেহারার একদম আলাদা ধাঁচে গড়া একজন সত্যিকারের ভদ্রলোক। অত্যন্ত উজ্জ্বল চোখ আর চমৎকার দৈহিক গড়ন দেখে মনে হয় তার বয়স ত্রিশের কাছাকাছি।
কিন্তু যখন আপনি তাকে কাছে থেকে চিনতে পারবেন; তার জীবনের অভিজ্ঞতা জানতে পারবেন, বিশ্বজগত সম্পর্কে তার গভীর জ্ঞান মাপতে পারবেন এবং তার কথায় ছড়িয়ে থাকা মজার অথচ গভীর সাইনিক হাস্যরস বুঝতে পারবেন—ঠিক তখনই আপনার মনে হবে তার জন্ম আরও অনেক আগে হয়েছে। বাস্তবে তার বয়স চল্লিশের কম তো হবেই না এবং তিনি জীবনের সুযোগগুলো বিচক্ষণতার সাথে ব্যবহার করে নিজেকে তরুণ আর অভিজ্ঞ রেখেছেন।
"প্রিয় জর্জ" স্যার ইউস্টেস তার ভাইকে সম্বোধন করে বললেন, "অনেক বছর এমন আনন্দ হয়নি"—তিনি ঠিক করেছেন এই দীর্ঘ বিচ্ছেদের পর "বোতল" ডাকনামটা আর ব্যবহার করবেন না।
"কী—কীসের আনন্দ?" বোতল জিজ্ঞেস করল।
"অবশ্যই তোকে আবার দেখার আনন্দ। জাহাজে তোকে দেখেই চিনে ফেলেছিলাম। তুই একটুও বদলাসনি, যদি না ওজন বাড়াকে বদলানো বলে।"
"তুমিও তো বদলাওনি, ইউস্টেস। যদি না ওজন কমাকে বদলানো বলে। তোমার কোমর আগে অনেক প্রসস্থ ছিল, জানো তো।"
"আহ জর্জ, তখন তো আমি বিয়ার খেতাম;" ইউস্টেস বললেন, "এখন বুঝি, সেটা কতটা বোকামি ছিল। আসলে, বয়স বাড়ার সাথে সাথে সকল বোকামিই আমি বুঝতে পেরেছি।"
"শুধু জীবন ছাড়া, তাই না?" বোতল বলল।
"ঠিক বলেছিস—জীবন ছাড়া। আমি আমাদের হতভাগা কাজিনদের মতো হতে চাই না" ইউস্টেস দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন। তারপর হেসে যোগ করলেন, "তবে তাদের দয়ার জন্যই আমরা এখন এত ভালো আছি।" তারপর দুজন চুপ করে গেল।
"চৌদ্দ বছর অনেক দীর্ঘ সময়, জর্জ" ইউস্টেস বললেন, "তোর নিশ্চয় অনেক কষ্ট করতে হয়েছে।"
"হ্যাঁ, বেশ কষ্টই করেছি। জানো তো, আমি অনেক যুদ্ধে লড়েছি" বোতল বলল।
"এবং সম্ভবত কিছুই অর্জন করতে পারিসনি?"
"ওহ, হ্যাঁ; আমি খাবার আর থাকার জায়গা পেয়েছি—এতটুকুই তো আমার যোগ্যতা।"
স্যার ইউস্টেস চশমা দিয়ে তার ভাইয়ের দিকে সন্দিগ্ধ চোখে তাকালেন। "তুই বড্ড বিনয়ী" তিনি বললেন, "এটা ঠিক না। জীবনে উন্নতি করতে চাইলে নিজের সম্পর্কে ভালো ধারণা রাখতে হয়।"
"আমি উন্নতি চাই না। আমি শুধু খেয়ে-পরে বেঁচে থাকতে পারলেই খুশি আর আমি বিনয়ী কারণ অনেক ভালো মানুষকে আমি আরও খারাপ অবস্থায় দেখেছি।"
"কিন্তু এখন তোর রোজগারের দরকার নেই। তুই কী করতে চাস? শহরে থাকবি? আমি তোকে সম্ভ্রান্ত মানুষদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতে পারি। তোর গালের ওই দাগ নিয়ে তুই সবার কাছে হিরো হয়ে যাবি। শোন, দাগের গল্পটা আমাকে একদিন বলিস। আর যদি আমার কিছু হয়, তুই উপাধি আর যাবতীয় সম্পত্তি সব পাবি। এটাই তোর জন্য যথেষ্ট হবে।"
বোতল অস্বস্তিতে চেয়ারে নড়েচড়ে বসল। "ধন্যবাদ, ইউস্টেস; কিন্তু সত্যি বলতে আমি এসব চাই না। আমি বরং আবার দক্ষিণ আফ্রিকায় ফিরে স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীতে যোগ দেব। সত্যি বলছি। অচেনা মানুষ আর সমাজ আমি পছন্দ করি না। আমি তোমার মতো এর জন্য উপযুক্ত নই।"
"তাহলে কী করবি? বিয়ে করে গ্রামে গিয়ে থাকবি?" ইউস্টেস জিজ্ঞেস করলেন।
বোতলের রোদে পোড়া তামাটে মুখটা একটু লাল হল—ইউস্টেসের সতর্ক দৃষ্টি সেটা লক্ষ্য করলো। "না, আমি বিয়ে করব না; নিশ্চয়ই না।"
"ওহ, মনে পড়ল" ইউস্টেস অন্যমনস্কভাবে বললেন, "গতকাল তোর পুরোনো প্রেমিকা লেডি ক্রস্টনের সঙ্গে দেখা হয়েছিল। আমি বলেছি, তুই দেশে ফিরছিস। সে এখন খুব সুন্দরী একজন বিধবা।"
"কী!" বোতল বিস্ময়ে চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়াল। "তার স্বামী মারা গেছে?"
"হ্যাঁ, মারা গেছে। এক বছর হলো, তাতে ভালোই হয়েছে। সে আমাকে তার সম্পত্তি দেখাশোনার দায়িত্ব দিয়েছিল; জানি না কেন, আমরা তো একে অপরকে পছন্দও করতাম না। আমার দেখা সবচেয়ে অপ্রীতিকর লোক ছিল সে। শুনেছি, সে তার স্ত্রীর সাথে মাঝে মাঝে বেশ খারাপ ব্যবহার করত। যদিও ওটা ওর প্রাপ্যই ছিল।"
"কেন, ওর প্রাপ্য কেন?" বোতল জিজ্ঞেস করল।
স্যার ইউস্টেস কাঁধ ঝাঁকালেন। "যখন একটি নির্লজ্জ মেয়ে টাকার জন্য তার বাগদত্তাকে ছেড়ে কোন বুড়োর কাছে নিজেকে বিক্রি করে, তার এটাই প্রাপ্য। ম্যাডেলিন যা পেয়েছে তা তার প্রত্যাশার চেয়েও ভালো।"
বোতল আবার চুপচাপ বসে পড়ল, তারপর সংযত কণ্ঠে বলল "তুমি কি মনে করো না ইউস্টেস, তুমি ওর প্রতি একটু বেশি কঠোর হচ্ছো?"
"কঠোর? না, একটুও না। আমি যত মেয়েকে চিনি, ম্যাডেলিন ক্রস্টন তাদের মধ্যে সবচেয়ে মূল্যহীন। তুই কি ভুলে গেছিস সে তোর সঙ্গে কেমন আচরণ করেছিল?"
"ইউস্টেস" প্রায় তীক্ষ্ণ স্বরে বোতল বলল, "দয়া করে তার সম্পর্কে এমন কথা বোলো না। আমি—আমি এটা পছন্দ করি না।"
স্যার ইউস্টেস বিস্ময়ে চোখ এতটাই বড় করলেন যে তার চশমাটি চোখ থেকে পড়ে গেল। "কী বলছিস, তুই কি বলতে চাস তুই এখনও ওই নারীকে ভালোবাসিস?"
বোতল তার বিশাল দেহটি চেয়ারে অস্বস্তিতে এপাশ-ওপাশ নাড়ল। জানি না, সত্যি ভালোবাসি কি না কিন্তু তোমার মুখে ওর সম্পর্কে এমন কথা শুনতে ভালো লাগছে না।"
স্যার ইউস্টেস হালকা স্বরে শিস বাজালেন। "তোকে কষ্ট দিয়ে থাকলে দুঃখিত, জর্জ" তিনি বললেন। "আমি ভাবিনি এটা তোর কাছে এতটা স্পর্শকাতর। দক্ষিণ আফ্রিকায় তুই নিশ্চয় খুব বিশ্বস্ত মানুষ ছিলি। এখানে মানুষের হৃদয়ের অনুভূতি বারো বছরে অনেকবার বদলায়।"
পর্বঃ ৩
পর্বঃ চার
পর্বঃ পাঁচ
চলবে.................
অ্যামব্রোজ বিয়ার্স এর অ্যান অকারেন্স অ্যাট আউল ক্রিক ব্রিজ (An Occurrence at Owl Creek Bridge) রূপান্তর মেহেদী হাসান
অ্যামব্রোজ গুইনেট বিয়ার্স ছিলেন একজন আমেরিকান ছোটগল্প লেখক, সাংবাদিক, কবি এবং আমেরিকান সিভিল ওয়ারের সৈনিক। তার বিখ্যাত গল্প "অ্যান অকারেন্স অ্যাট আউল ক্রিক ব্রিজ" প্রথম প্রকাশিত হয় ১৮৯০ সালের ১৩ই জুলাই দ্য সান ফ্রান্সিসকো এক্সামিনার পত্রিকায় এবং পরে "টেলস অফ সোলজার্স অ্যান্ড সিভিলিয়ান্স" (১৮৯১) সংকলনে এটি স্থান পায়। এই সংকলনটি দুটি ভাগে বিভক্ত—"সোলজার্স" এবং "সিভিলিয়ান্স"। এই নির্দিষ্ট গল্পটি "সোলজার্স" অংশের অন্তর্ভুক্ত।
____________________
অ্যান অকারেন্স অ্যাট আউল ক্রিক ব্রিজ
— অ্যামব্রোজ বিয়ার্স
পর্বঃ এক
আমেরিকার উত্তর আলাবামার এক রেলসেতুর উপর দাঁড়িয়ে একজন লোক তার নিচের বিশ ফুট দূরে দ্রুত প্রবাহমান পানির দিকে তাকিয়ে ছিল। লোকটির হাত পিছনে নিয়ে কব্জিগুলো দড়ি দিয়ে শক্ত করে বাঁধা। তার গলায় শক্ত করে পেঁচানো একটি দড়ি যা তার মাথার উপরকার একটি মোটা ক্রসবারের সাথে যুক্ত এবং দড়ির ঢিলে অংশ তার হাঁটু পর্যন্ত নেমে এসেছে।
রেললাইনের ওপর রাখা কিছু আলগা তক্তা দিয়ে তার এবং মৃত্যুদণ্ড কার্যকরকারীদের জন্য দাঁড়ানোর জায়গা তৈরি করা হয়েছে। বেসামরিক জীবনে ডেপুটি শেরিফ হিসেবে কর্মরত থাকা একজন সার্জেন্ট, ফেডারেল সেনাবাহিনীর দুইজন প্রাইভেট সৈনিককে বিভিন্ন নির্দেশ দিচ্ছিলেন। একই অস্থায়ী প্ল্যাটফর্মে কিছুটা দূরে বিশেষ পদমর্যাদার ইউনিফর্ম পরিহিত একজন সশস্ত্র অফিসার দাঁড়িয়ে ছিলেন। তিনি একজন ক্যাপ্টেন। সেতুর দুই প্রান্তে একজন করে প্রহরী তাদের রাইফেল তাক করে দাঁড়িয়ে ছিল অর্থাৎ বাম কাঁধের সামনে উল্লম্বভাবে, রাইফেলের হাতল সোজা বুকের উপর প্রসারিত বাহুর উপর রাখা—এটি একটি আনুষ্ঠানিক ও অস্বাভাবিক ভঙ্গি যা দেহকে সম্পূর্ণ সোজা রাখতে বাধ্য করে। সেতুর দুই প্রান্ত অবরোধ করে রাখাই তাদের দায়িত্ব—মাঝখানে কী ঘটছে তা তাদের জানার প্রয়োজন নেই।
একজন প্রহরী ছাড়া আর কাউকে দেখা যাচ্ছিল না; রেললাইনটি সোজা একশ গজ বনের মধ্যে চলে গিয়ে বাঁক নিয়ে চোখের আড়ালে অদৃশ্য হয়ে গেছে। সম্ভবত আরও দূরে কোনো আউটপোস্ট ছিল। নদীর অপর পাড়ে খোলা মাঠের মধ্যে ঢালের ওপরে খাড়াখাড়ি গাছের গুঁড়ি দিয়ে তৈরি একটি বেড়া যার মধ্যে রাইফেলের লুপহোল করা আর একটি মাত্র ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে আছে সেতুর দিকে তাক করা পিতলের কামানের নল।
কৌতূহলী দর্শকরা সেতু ও দুর্গের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে। পদাতিক বাহিনীর একটি দল প্যারেড রেস্ট অবস্থায় রাইফেলের বাট মাটিতে; ব্যারেলগুলি ডান কাঁধের উপর পিছনে হেলান দিয়ে আর হাতগুলো স্টকের উপর আড়াআড়ি রেখে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে আছে। সারির ডানদিকে বাম হাত ডান হাতের উপর আর তলোয়ারের ডগা মাটিতে গেঁথে একজন লেফটেন্যান্ট দাঁড়িয়ে আছেন। সেতুর মাঝখানে থাকা চারজন ছাড়া একটি মানুষও নড়ছিল না। সমস্ত জটলা সেতুর দিকে মুখ করে পাথরের মতো স্থির নিস্পলক তাকিয়ে ছিল। নদী পাড়ের দিকে মুখ করে থাকা প্রহরীগুলো মূর্তির মতো নিশ্চল হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। ক্যাপ্টেন বাহু গুটিয়ে নীরবে দাঁড়িয়ে অধীনস্থদের কাজ পর্যবেক্ষণ করছিলেন—কোনো সংকেত দিচ্ছিলেন না। মৃত্যু যেন এক মর্যাদাসম্পন্ন অতিথি যার আগমন ঘোষণা করা হলে তাকেও সম্মানের সঙ্গে গ্রহণ করতে হয়—এমনকি যারা তার সাথে সবচেয়ে বেশি পরিচিত তারাও। সামরিক শিষ্টাচারের নিয়মে নীরবতা ও নিশ্চলতা হচ্ছে শ্রদ্ধার বহিঃপ্রকাশ।
যে লোকটির ফাঁসি কার্যকর হতে চলেছিল তার বয়স সম্ভবত পঁয়ত্রিশের মতো। বেশভূষা দেখে মনে হচ্ছিল তিনি একজন বেসামরিক ব্যক্তি—সম্ভবত একজন চাষী। সোজা নাক, দৃঢ় মুখমণ্ডল ও প্রশস্ত কপালের একজন সুশ্রী পুরুষ। পিছনের দিকে আঁচড়ানো লম্বা কালো চুলগুলো কানের পাশ দিয়ে তার সুবিন্যস্ত ফ্রক কোটের কলার পর্যন্ত নেমে এসেছে। গোঁফ ও সূঁচালো দাড়ি থাকলেও কোন জুলফি নেই। গাঢ় ধূসর বর্ণের বড় বড় চোখ দুটুতে এক সদয় অভিব্যক্তি ফুটে উঠছিল যা সাধারণত ফাঁসির দড়িতে ঝুলন্ত ব্যক্তির মধ্যে আশা করা যায় না। স্পষ্টতই ইনি কোনো সাধারণ খুনি ছিলেন না। উদার সামরিক বিধিমালায় অনেক প্রকারের লোকের ফাঁসির ব্যবস্থা আছে এবং ভদ্রলোকরাও এর বাইরে নয়।
প্রস্তুতি সম্পন্ন হওয়ার পর দুইজন সৈনিক একপাশে সরে দাঁড়িয়ে আলগা তাক্তাগুলো সরিয়ে নিল। সার্জেন্ট ক্যাপ্টেনের দিকে ঘুরে স্যালুট করল এবং সেই অফিসারের ঠিক পিছনে গিয়ে দাঁড়াল। এই গতিবিধির ফলে দণ্ডিত লোকটি এবং সার্জেন্ট একই তক্তার দুই প্রান্তে দাঁড়িয়ে রইল যেটা সেতুর তিনটি আড়াআড়ি কাঠকে সংযুক্ত করে ছিল। বেসামরিক ব্যক্তি যে প্রান্তে দাঁড়িয়েছিল সেটা চতুর্থ ক্রসবার পর্যন্ত পৌঁছেছিল। এই তক্তাটি ক্যাপ্টেনের ওজনে এতক্ষণ স্থির ছিল; এখন সেটি সার্জেন্টের ওজনে স্থির রইল। ক্যাপ্টেনের ইশারায় সার্জেন্ট সরে গেলে তক্তাটি কাত হয়ে যাবে এবং দণ্ডিত লোকটি দুটি ক্রসবারের মাঝখান দিয়ে নিচে পড়ে যাবে। এই ব্যবস্থা তার বিচার অনুযায়ী সহজ এবং কার্যকর মনে হয়েছিল। তার মুখ বা চোখ কোনটাই বাঁধাও হয়নি। সে এক মুহূর্ত তার পায়ের নিচ দিয়ে উন্মত্ত বেগে বয়ে চলা নদীর ঘূর্ণায়মান পানির দিকে তাকাল। কাঁপতে থাকা ভাসমান কাঠের একটি টুকরো তার দৃষ্টি আকর্ষণ করল এবং তার চোখ স্রোতের সাথে সেটাকে অনুসরণ করল। কত ধীর গতিতে এটি চলছিল! কী অলস স্রোত!
স্ত্রী ও সন্তানদের কথা শেষবারের মতো স্মরণ করার জন্য সে চোখ বন্ধ করল। ভোরের সূর্যের স্পর্শে সোনালি হয়ে ওঠা জলরাশি, নদীতীরের কিছু দূরবর্তী স্থানে জমে থাকা ঘন কুয়াশা, কেল্লা, সৈন্যদল, আর সেই ভাসমান কাঠের টুকরো - সবকিছুই তার মনোযোগে বাধা দিচ্ছিল। এবার সে নতুন এক গোলমালের আভাস পেল; প্রিয়জনের স্মৃতির মাঝেই হঠাৎ একটি তীক্ষ্ণ স্পষ্ট ধাতব শব্দ কানে এল—যেন কামারের হাতুড়ি নেহাইয়ের উপর পড়ছে। সে ভাবল এটা কী? খুব দূরে নাকি একেবারে কাছে? যদিও দুটোই মনে হচ্ছিল। শব্দটি মৃত্যুর ঘণ্টাধ্বনির মত ধীরে ধীরে কিন্তু নিয়মিত বিরতিতে হচ্ছিল। প্রতিবার নতুন শব্দের জন্য সে অধৈর্য হয়ে অপেক্ষা করছিল এবং কেন জানি না—ভয়ে শঙ্কিত হচ্ছিল। নীরবতার বিরতি ক্রমশ দীর্ঘ হতে লাগল; প্রতীক্ষা তাকে পাগল করে তুলছিল। শব্দের ধারাবাহিকতা কমার সাথে সাথে সেটা আরও জোরালো ও তীক্ষ্ণ হয়ে উঠছিল। এগুলো ছুরির আঘাতের মতো কানে খোঁচা মারছিল; তার মনে হচ্ছিল সে চিৎকার করে উঠবে। আসলে সে তার নিজের ঘড়ির টিকটিক শব্দ শুনছিল।
চোখ খুলে আবার সে নিচের জলরাশির দিকে তাকাল। "যদি হাত ছাড়াতে পারতাম" সে ভাবল, "তাহলে হয়ত ফাঁস খুলে নদীতে ঝাঁপিয়ে পরতাম। ডুব দিয়ে গুলি এড়িয়ে সজোরে সাঁতরে তীরে পৌঁছাতে পারতাম। তারপর জঙ্গলে ঢুকে বাড়ি পালাতে পারতাম। আল্লাহকে ধন্যবাদ যে আমার বাড়ি এখনও শত্রুদের সীমানার বাইরে; আমার স্ত্রী ও ছোট্ট সন্তানরা এখনও আক্রমণকারীদের শেষ সীমান্তেরও ওপারে।"
এই ভাবনাগুলো সেই দণ্ডিত লোকটির মস্তিষ্কে বিদ্যুৎ ঝলকের মতো খেলে গেল আর ঠিক সেই মুহূর্তে ক্যাপ্টেন সার্জেন্টের দিকে ইঙ্গিত করায় সার্জেন্ট একপাশে সরে দাঁড়াল।





