.....

অ্যামব্রোজ বিয়ার্স এর অ্যান অকারেন্স অ্যাট আউল ক্রিক ব্রিজ (An Occurrence at Owl Creek Bridge) রূপান্তর মেহেদী হাসান



অ্যামব্রোজ গুইনেট বিয়ার্স ছিলেন একজন আমেরিকান ছোটগল্প লেখক, সাংবাদিক, কবি এবং আমেরিকান সিভিল ওয়ারের সৈনিক। তার বিখ্যাত গল্প "অ্যান অকারেন্স অ্যাট আউল ক্রিক ব্রিজ" প্রথম প্রকাশিত হয় ১৮৯০ সালের ১৩ই জুলাই দ্য সান ফ্রান্সিসকো এক্সামিনার পত্রিকায় এবং পরে "টেলস অফ সোলজার্স অ্যান্ড সিভিলিয়ান্স" (১৮৯১) সংকলনে এটি স্থান পায়। এই সংকলনটি দুটি ভাগে বিভক্ত—"সোলজার্স" এবং "সিভিলিয়ান্স"। এই নির্দিষ্ট গল্পটি "সোলজার্স" অংশের অন্তর্ভুক্ত।

____________________


অ্যান অকারেন্স অ্যাট আউল ক্রিক ব্রিজ

— অ্যামব্রোজ বিয়ার্স


পর্বঃ এক


আমেরিকার উত্তর আলাবামার এক রেলসেতুর উপর দাঁড়িয়ে একজন লোক তার নিচের বিশ ফুট দূরে দ্রুত প্রবাহমান পানির দিকে তাকিয়ে ছিল। লোকটির হাত পিছনে নিয়ে কব্জিগুলো দড়ি দিয়ে শক্ত করে বাঁধা। তার গলায় শক্ত করে পেঁচানো একটি দড়ি যা তার মাথার উপরকার একটি মোটা ক্রসবারের সাথে যুক্ত এবং দড়ির ঢিলে অংশ তার হাঁটু পর্যন্ত নেমে এসেছে।


রেললাইনের ওপর রাখা কিছু আলগা তক্তা দিয়ে তার এবং মৃত্যুদণ্ড কার্যকরকারীদের জন্য দাঁড়ানোর জায়গা তৈরি করা হয়েছে। বেসামরিক জীবনে ডেপুটি শেরিফ হিসেবে কর্মরত থাকা একজন সার্জেন্ট, ফেডারেল সেনাবাহিনীর দুইজন প্রাইভেট সৈনিককে বিভিন্ন নির্দেশ দিচ্ছিলেন। একই অস্থায়ী প্ল্যাটফর্মে কিছুটা দূরে বিশেষ পদমর্যাদার ইউনিফর্ম পরিহিত একজন সশস্ত্র অফিসার দাঁড়িয়ে ছিলেন। তিনি একজন ক্যাপ্টেন। সেতুর দুই প্রান্তে একজন করে প্রহরী তাদের রাইফেল তাক করে দাঁড়িয়ে ছিল অর্থাৎ বাম কাঁধের সামনে উল্লম্বভাবে, রাইফেলের হাতল সোজা বুকের উপর প্রসারিত বাহুর উপর রাখা—এটি একটি আনুষ্ঠানিক ও অস্বাভাবিক ভঙ্গি যা দেহকে সম্পূর্ণ সোজা রাখতে বাধ্য করে। সেতুর দুই প্রান্ত অবরোধ করে রাখাই তাদের দায়িত্ব—মাঝখানে কী ঘটছে তা তাদের জানার প্রয়োজন নেই।


একজন প্রহরী ছাড়া আর কাউকে দেখা যাচ্ছিল না; রেললাইনটি সোজা একশ গজ বনের মধ্যে চলে গিয়ে বাঁক নিয়ে চোখের আড়ালে অদৃশ্য হয়ে গেছে। সম্ভবত আরও দূরে কোনো আউটপোস্ট ছিল। নদীর অপর পাড়ে খোলা মাঠের মধ্যে ঢালের ওপরে খাড়াখাড়ি গাছের গুঁড়ি দিয়ে তৈরি একটি বেড়া যার মধ্যে রাইফেলের লুপহোল করা আর একটি মাত্র ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে আছে সেতুর দিকে তাক করা পিতলের কামানের নল।


কৌতূহলী দর্শকরা সেতু ও দুর্গের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে। পদাতিক বাহিনীর একটি দল প্যারেড রেস্ট অবস্থায় রাইফেলের বাট মাটিতে; ব্যারেলগুলি ডান কাঁধের উপর পিছনে হেলান দিয়ে আর হাতগুলো স্টকের উপর আড়াআড়ি রেখে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে আছে। সারির ডানদিকে বাম হাত ডান হাতের উপর আর তলোয়ারের ডগা মাটিতে গেঁথে একজন লেফটেন্যান্ট দাঁড়িয়ে আছেন। সেতুর মাঝখানে থাকা চারজন ছাড়া একটি মানুষও নড়ছিল না। সমস্ত জটলা সেতুর দিকে মুখ করে পাথরের মতো স্থির নিস্পলক তাকিয়ে ছিল। নদী পাড়ের দিকে মুখ করে থাকা প্রহরীগুলো মূর্তির মতো নিশ্চল হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল।  ক্যাপ্টেন বাহু গুটিয়ে নীরবে দাঁড়িয়ে অধীনস্থদের কাজ পর্যবেক্ষণ করছিলেন—কোনো সংকেত দিচ্ছিলেন না। মৃত্যু যেন এক মর্যাদাসম্পন্ন অতিথি যার আগমন ঘোষণা করা হলে তাকেও সম্মানের সঙ্গে গ্রহণ করতে হয়—এমনকি যারা তার সাথে সবচেয়ে বেশি পরিচিত তারাও। সামরিক শিষ্টাচারের নিয়মে নীরবতা ও নিশ্চলতা হচ্ছে শ্রদ্ধার বহিঃপ্রকাশ।


যে লোকটির ফাঁসি কার্যকর হতে চলেছিল তার বয়স সম্ভবত পঁয়ত্রিশের মতো। বেশভূষা দেখে মনে হচ্ছিল তিনি একজন বেসামরিক ব্যক্তি—সম্ভবত একজন চাষী। সোজা নাক, দৃঢ় মুখমণ্ডল ও প্রশস্ত কপালের একজন সুশ্রী পুরুষ। পিছনের দিকে আঁচড়ানো লম্বা কালো চুলগুলো কানের পাশ দিয়ে তার সুবিন্যস্ত ফ্রক কোটের কলার পর্যন্ত নেমে এসেছে। গোঁফ ও সূঁচালো দাড়ি থাকলেও কোন জুলফি নেই। গাঢ় ধূসর বর্ণের বড় বড় চোখ দুটুতে এক সদয় অভিব্যক্তি ফুটে উঠছিল যা সাধারণত ফাঁসির দড়িতে ঝুলন্ত ব্যক্তির মধ্যে আশা করা যায় না। স্পষ্টতই ইনি কোনো সাধারণ খুনি ছিলেন না। উদার সামরিক বিধিমালায় অনেক প্রকারের লোকের ফাঁসির ব্যবস্থা আছে এবং ভদ্রলোকরাও এর বাইরে নয়।


প্রস্তুতি সম্পন্ন হওয়ার পর দুইজন সৈনিক একপাশে সরে দাঁড়িয়ে আলগা তাক্তাগুলো সরিয়ে নিল। সার্জেন্ট ক্যাপ্টেনের দিকে ঘুরে স্যালুট করল এবং সেই অফিসারের ঠিক পিছনে গিয়ে দাঁড়াল। এই গতিবিধির ফলে দণ্ডিত লোকটি এবং সার্জেন্ট একই তক্তার দুই প্রান্তে দাঁড়িয়ে রইল যেটা সেতুর তিনটি আড়াআড়ি কাঠকে সংযুক্ত করে ছিল। বেসামরিক ব্যক্তি যে প্রান্তে দাঁড়িয়েছিল সেটা চতুর্থ ক্রসবার পর্যন্ত পৌঁছেছিল। এই তক্তাটি ক্যাপ্টেনের ওজনে এতক্ষণ স্থির ছিল; এখন সেটি সার্জেন্টের ওজনে স্থির রইল। ক্যাপ্টেনের ইশারায় সার্জেন্ট সরে গেলে তক্তাটি কাত হয়ে যাবে এবং দণ্ডিত লোকটি দুটি ক্রসবারের মাঝখান দিয়ে নিচে পড়ে যাবে। এই ব্যবস্থা তার বিচার অনুযায়ী সহজ এবং কার্যকর মনে হয়েছিল। তার মুখ বা চোখ কোনটাই বাঁধাও হয়নি। সে এক মুহূর্ত তার পায়ের নিচ দিয়ে উন্মত্ত বেগে বয়ে চলা নদীর ঘূর্ণায়মান পানির দিকে তাকাল। কাঁপতে থাকা ভাসমান কাঠের একটি টুকরো তার দৃষ্টি আকর্ষণ করল এবং তার চোখ স্রোতের সাথে সেটাকে অনুসরণ করল। কত ধীর গতিতে এটি চলছিল! কী অলস স্রোত!


স্ত্রী ও সন্তানদের কথা শেষবারের মতো স্মরণ করার জন্য সে চোখ বন্ধ করল। ভোরের সূর্যের স্পর্শে সোনালি হয়ে ওঠা জলরাশি, নদীতীরের কিছু দূরবর্তী স্থানে জমে থাকা ঘন কুয়াশা, কেল্লা, সৈন্যদল, আর সেই ভাসমান কাঠের টুকরো - সবকিছুই তার মনোযোগে বাধা দিচ্ছিল। এবার সে নতুন এক গোলমালের আভাস পেল; প্রিয়জনের স্মৃতির মাঝেই হঠাৎ একটি তীক্ষ্ণ স্পষ্ট ধাতব শব্দ কানে এল—যেন কামারের হাতুড়ি নেহাইয়ের উপর পড়ছে। সে ভাবল এটা কী? খুব দূরে নাকি একেবারে কাছে? যদিও দুটোই মনে হচ্ছিল। শব্দটি মৃত্যুর ঘণ্টাধ্বনির মত ধীরে ধীরে কিন্তু নিয়মিত বিরতিতে হচ্ছিল। প্রতিবার নতুন শব্দের জন্য সে অধৈর্য হয়ে অপেক্ষা করছিল এবং কেন জানি না—ভয়ে শঙ্কিত হচ্ছিল। নীরবতার বিরতি ক্রমশ দীর্ঘ হতে লাগল; প্রতীক্ষা তাকে পাগল করে তুলছিল। শব্দের ধারাবাহিকতা কমার সাথে সাথে সেটা আরও জোরালো ও তীক্ষ্ণ হয়ে উঠছিল। এগুলো ছুরির আঘাতের মতো কানে খোঁচা মারছিল; তার মনে হচ্ছিল সে চিৎকার করে উঠবে। আসলে সে তার নিজের ঘড়ির টিকটিক শব্দ শুনছিল।


চোখ খুলে আবার সে নিচের জলরাশির দিকে তাকাল। "যদি হাত ছাড়াতে পারতাম" সে ভাবল, "তাহলে হয়ত ফাঁস খুলে নদীতে ঝাঁপিয়ে পরতাম। ডুব দিয়ে গুলি এড়িয়ে সজোরে সাঁতরে তীরে পৌঁছাতে পারতাম। তারপর জঙ্গলে ঢুকে বাড়ি পালাতে পারতাম। আল্লাহকে ধন্যবাদ যে আমার বাড়ি এখনও শত্রুদের সীমানার বাইরে; আমার স্ত্রী ও ছোট্ট সন্তানরা এখনও আক্রমণকারীদের শেষ সীমান্তেরও ওপারে।"


এই ভাবনাগুলো সেই দণ্ডিত লোকটির মস্তিষ্কে বিদ্যুৎ ঝলকের মতো খেলে গেল আর ঠিক সেই মুহূর্তে ক্যাপ্টেন সার্জেন্টের দিকে ইঙ্গিত করায় সার্জেন্ট একপাশে সরে দাঁড়াল।


পর্বঃ দুই


পেইটন ফারকুহার ছিলেন আলাবামার একটি প্রাচীন ও উচ্চমর্যাদাসম্পন্ন পরিবারের একজন স্বচ্ছল জমিদার। দাসমালিক এবং অন্যান্য দাসমালিকদের মতোই একজন রাজনীতিবিদ হিসেবে তিনি স্বাভাবিকভাবেই ছিলেন মূল বিচ্ছিন্নতাবাদী এবং দক্ষিণের আদর্শের প্রতি একনিষ্ঠ ভক্ত।

এখানে বলা অপ্রয়োজনীয় এমন কিছু জরুরি পরিস্থিতির কারণে তিনি সেই বীর সেনাবাহিনীতে যোগ দিতে পারেননি যে সেনাবাহিনী করিন্থের পতনের মাধ্যমে শেষ হওয়া দুর্ভাগ্যজনক অভিযানে লড়েছিল। এই অগৌরবজনক নিষেধাজ্ঞায় তিনি অস্থির হয়ে উঠেছিলেন; বস্তুত সৈনিকের বৃহত্তর জীবন ও খ্যাতি অর্জনের সুযোগের জন্য তিনি ব্যাকুল ছিলেন। তিনি বিশ্বাস করতেন যুদ্ধের সময় যেভাবে সবার জীবনে সুযোগ আসে—তারও আসবে। এদিকে তিনি যা পারতেন তাই করতেন। দক্ষিণের পক্ষে কোনো কাজই তার কাছে তুচ্ছ ছিল না এবং কোনো দুঃসাহসিক কাজই তার পক্ষে খুব বেশি বিপজ্জনক মনে হতো না যদি তা একজন বেসামরিক ব্যক্তির চরিত্রের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়। তিনি মনেপ্রাণে একজন সৈনিক ছিলেন এবং আন্তরিকভাবে খুব বেশি দ্বিধা ছাড়াই অন্তত আংশিকভাবে সেই নৃশংস উক্তিতে সম্মতি দিয়েছিলেন যে প্রেম ও যুদ্ধে সবকিছুই ন্যায্য।

এক সন্ধ্যায় ফারকুহার ও তার স্ত্রী তাদের বাড়ির প্রবেশপথের কাছে একটি কাঠের বেঞ্চে বসে ছিলেন। এমন সময় ধূসর পোশাকে একজন সৈনিক ঘোড়ায় চড়ে গেটের কাছে এসে এক গ্লাস পানি চাইল। মিসেস ফারকুহার খুশি মনে নিজ হাতে তাকে পানি দিলেন। তিনি যখন পানি আনতে যাচ্ছিলেন তখন তার স্বামী সেই ধুলোমাখা অশ্বারোহীর কাছে গিয়ে উৎসুকভাবে যুদ্ধক্ষেত্রের খবর জিজ্ঞেস করলেন।

"ইয়াঙ্কিরা রেললাইন মেরামত করছে" সৈন্যটি বলল "এবং আরেকটি আক্রমণের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। তারা আউল ক্রিক ব্রিজ পর্যন্ত পৌঁছে সেটি ঠিকঠাক করেছে এবং উত্তর পাড়ে একটি বেড়া (স্টকেড) তৈরি করেছে। কমান্ডেন্ট এর জারি করা একটি আদেশ সর্বত্র টাঙানো হয়েছে—যাতে ঘোষণা করা হয়েছে যে রেলপথ, সেতু, টানেল বা ট্রেনে হস্তক্ষেপ করতে গিয়ে কোনও বেসামরিক নাগরিক ধরা পড়লে তাকে তৎক্ষণাৎ ফাঁসি দেওয়া হবে। আমি সেই আদেশ দেখেছি।"

"আউল ক্রিক ব্রিজটি এখান থেকে কত দূরে?" ফারকুহার জিজ্ঞেস করল।

"প্রায় ত্রিশ মাইল।"

"ক্রিকের এপারে কি কোনও সৈন্যবাহিনী নেই?"

"শুধু রেললাইনের উপর আধমাইল দূরে একটা পিকেট পোস্ট, আর সেতুর এ মাথায় একজন প্রহরী।"

"ধরুন বেসামরিক এবং ফাঁসির ব্যাপারে অভিজ্ঞ একজন লোক—পিকেট পোস্ট এড়িয়ে এবং হয়তো প্রহরীকেও কাবু করতে পারল," ফারকুহার হেসে বললেন, "তাহলে সে কী করতে পারবে?"

সৈনিক খানিকটা ভেবে বলল "আমি এক মাস আগে সেখানে ছিলাম। দেখেছি গত শীতের বন্যায় সেতুর এ মাথার কাঠের খুঁটির সাথে প্রচুর ভাসমান কাঠ জমে আছে। এখন সেগুলো শুকনো এবং বারুদের মতো জ্বলবে।"

ততক্ষণে ভদ্রমহিলা পানি নিয়ে এসেছেন, সৈনিকটি তা পান করল। সে বিনীতভাবে তাকে ধন্যবাদ জানিয়ে তার স্বামীকে কিঞ্চিৎ বাউ করে ঘোড়া নিয়ে চলে গেল। এই ঘটনার ঘণ্টাখানেক পর রাতের অন্ধকারে সেই বাড়ী পেরিয়ে সৈনিকটি যে দিক থেকে এসেছিল সেই উত্তর দিকে চলে গেল। মূলত সে ছিল একজন ফেডারেল গুপ্তচর।

পর্বঃ তিন


পেইটন ফারকুহার সেতু থেকে সোজা নিচের দিকে পড়তে পড়তে জ্ঞান হারিয়ে ফেললেন, যেন মরেই গেছেন। মনে হলো যেন বহুযুগ পরে এই অবস্থা থেকে তিনি জেগে উঠলেন। গলায় এক তীব্র ব্যথা এবং এর পরে শ্বাসরোধের অনুভূতি হলো। তীব্র, তীক্ষ্ণ যন্ত্রণা তার গলা থেকে শরীরের প্রতিটি তন্তু ও অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের দিকে নেমে যেতে লাগল। এই ব্যথাগুলো স্পষ্ট শাখা-প্রশাখায় বিভক্ত পথ ধরে বিদ্যুতের মতো ছুটে বেড়াচ্ছিল এবং অবিশ্বাস্য গতিতে স্পন্দিত হচ্ছিল। মনে হচ্ছিল যেন জ্বলন্ত আগুনের স্রোত তাকে অসহনীয় তাপমাত্রায় পুড়িয়ে দিচ্ছে। মাথার ভেতর রক্ত জমাট বাঁধার মতো এক ধরনের শিরশির অনুভূতি হচ্ছিল। এই অনুভূতিগুলোর সাথে কোন চিন্তা জড়িত ছিল না। তার বুদ্ধিবৃত্তিক অংশ ইতিমধ্যেই লুপ্ত হয়ে গিয়েছিল; তার কেবল অনুভব করার ক্ষমতা অবশিষ্ট ছিল আর তা ছিল এক ভয়াবহ যন্ত্রণা।

তিনি নিজের গতিবিধি উপলব্ধি করতে পারছিলেন। এক উজ্জ্বল মেঘে আবৃত হয়ে তার জ্বলন্ত হৃদয় অকল্পনীয়ভাবে একটি বিশাল পেন্ডুলামের মতো দুলছিলো। তারপর হঠাৎ এক ভয়াবহ আকস্মিকতায় তার চারপাশের আলো একটি জোরে ছপাঁছ শব্দ করে উপরের দিকে ছুটে গেল; তৎক্ষণাৎ তার কানে ভেসে এল এক ভয়ঙ্কর গর্জন—তারপর সবকিছু ঠাণ্ডা ও অন্ধকারে ঢেকে গেল।

চিন্তার ক্ষমতা ফিরে এলে বুঝতে পারলেন যে তিনি দড়িটি ছিঁড়ে নদীতে পরে গেছেন। অতিরিক্ত কোন শ্বাসরোধ হচ্ছিল না; তার গলার ফাঁস ইতিমধ্যেই তাকে শ্বাসরুদ্ধ করে রেখেছিল এবং ফুসফুসে পানি ঢুকতে বাঁধা দিচ্ছিল।

নদীর তলায় ফাঁসিতে মরা!—ব্যাপারটা তার কাছে হাস্যকর মনে হলো। তিনি অন্ধকারে চোখ খুলে উপরে এক ঝলক আলো দেখতে পেলেন কিন্তু কত দূরে আর কতই না দুর্গম! তিনি তখনও ডুবে চলেছেন কারণ আলো ক্রমশ ম্লান হয়ে হয়ে শুধু একটা ক্ষীণ আভায় পরিণত হলো। তারপর আলো আবার বাড়তে ও উজ্জ্বল হতে শুরু করল এবং বুঝতে পারলেন যে তিনি পানির উপরের দিকে উঠছেন।

"ফাঁসিতে ঝুলে ডুবে মারা" তিনি ভাবলেন "এটা তেমন খারাপ না; কিন্তু গুলি খেয়ে মরতে চাই না।
না; গুলি খেতে চাই না; এটা ন্যায়সঙ্গত হবেনা।

যদিও তিনি সচেতনভাবে কোন চেষ্টাই করছিলেন না কিন্তু কবজিতে তীব্র ব্যথা জানিয়ে দিল যে তিনি অবচেতনভাবে হাত মুক্ত করার চেষ্টা করছেন। বাঁধন খুলতে পারবেন কি পারবেন না এই ফলাফলের ব্যাপারে চিন্তা না করেই তিনি হাত মুক্ত করার কাজে সম্পূর্ণ মনোযোগ দিলেন।

কী দুর্দান্ত প্রয়াস!—কী চমৎকার, কী অতিমানবীয় শক্তি!
আহ, এটা ছিল এক দারুণ প্রচেষ্টা! শাবাশ!
দড়িটি খুলে গেল; তার বাহুগুলো আলাদা হয়ে উপরে ভাসল। ক্রমবর্ধমান আলোয় হাত দুটি অস্পষ্টভাবে দেখা যাচ্ছিল। নতুন আগ্রহ নিয়ে তিনি দুই হাত দিয়ে গলায় ফাঁসের দড়ি খুলতে লাগলেন। কিছুক্ষণের প্রচেষ্টায় সেটা ছিঁড়ে গেল এবং তিনি সজোরে সেটাকে দূরে ছুড়ে মারলেন। দড়িটাকে তখন জলসাপের মত দেখাচ্ছিল।

"এটাকে ফিরিয়ে দাও, ফিরিয়ে দাও!" মনে হলো তিনি হাত দুটোর দিকে চিৎকার করে এই কথা বললেন কারন ফাঁসটি খোলার পরেই তিনি জীবনের সবচেয়ে ভয়াবহ যন্ত্রণা অনুভব করলেন। তার গলা ভয়ানকভাবে ব্যথা করতে লাগল; মগজ জ্বলছিল আর মৃদুভাবে স্পন্দিত হৃদয় একটা বিশাল লাফ দিয়ে মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করল।

তার সমস্ত শরীর এক অসহনীয় যন্ত্রণায় মোচড় দিচ্ছিল! কিন্তু তার অবাধ্য হাত দুটো আদেশের তোয়াক্কা করল না। তারা দ্রুত নিচের দিকে স্ট্রোক দিয়ে প্রবলভাবে পানিতে আঘাত করে তাকে উপরের দিকে ঠেলে দিল। অবশেষে মাথা ভেসে উঠলো; মনে হলো প্রবল সূর্যালোক চোখ ঝলসে দিয়েছে। তার বুক কাঁপতে লাগল আর সর্বোচ্চ যন্ত্রণায় তার ফুসফুস বিশাল এক শ্বাস নিল যা তৎক্ষণাৎ এক চিৎকারে বের করে দিল!

তার শারীরিক ইন্দ্রিয়গুলো এখন পুরোপুরি সচেতন হয়ে উঠেছে। বরং সেগুলো অস্বাভাবিক রকমের তীক্ষ্ণ আর সতর্ক হয়ে গেছে। তার শরীরের সেই ভয়াবহ বিপর্যয়ের মধ্যে এমন কিছু ঘটেছে যা তাঁর ইন্দ্রিয়গুলিকে এতটাই উন্নত ও পরিশীলিত করেছে যে তারা এমন সব জিনিসের রেকর্ড রাখছিল যা আগে কখনো অনুভূত হয়নি। তিনি তার মুখে ঢেউয়ের স্পর্শ অনুভব করতে পারছেন এমনকি প্রতিটি ঢেউ আঘাত করার আলাদা আলাদা শব্দ শুনতে পাচ্ছিলেন। তিনি নদীতীরের বনভূমির দিকে তাকিয়ে প্রতিটি গাছ, প্রতিটি পাতার শিরা-উপশিরা—এমনকি পাতার উপর বসে থাকা কীটপতঙ্গগুলোও দেখতে পেলেন। সেখানে রয়েছে পঙ্গপাল, চকচকে শরীরের মাছি এবং ধূসর রঙের মাকড়সাগুলো ডাল থেকে ডালে তাদের জাল বুনছিল। এইতো লক্ষ কোটি ঘাসের পাতায় জমে থাকা শিশিরবিন্দুর রংধনুর মতো রং তিনি দেখতে পাচ্ছেন। নদীর ঘূর্ণায়মান পানিতে নেচে বেড়ানো মশার গুঞ্জন, ফড়িংদের ডানার ঝাপটানি, নৌকার দাঁড় টানা শব্দের মত জলমাকড়শার সাঁতার—এ সবই তাঁর কানে শ্রুতিমধুর সুরের মতো বাজছিল। একটি মাছ তাঁর চোখের সামনে দিয়ে সাঁতার কাটল এবং মাছের দেহে জল কাটার শব্দ তিনি শুনতে পেলেন।

নদীর স্রোতের দিকে মুখ করে তিনি যখন পানির উপর ভেসে উঠলেন মুহূর্তের মধ্যেই দৃশ্যমান জগতটি ধীরে ধীরে ঘুরতে লাগল যেন তিনিই সেই ঘূর্ণনের কেন্দ্রবিন্দু। তিনি দেখতে পেলেন সেই সেতু, কেল্লা, সেতুর উপর দাঁড়ানো সৈন্যরা, ক্যাপ্টেন, সার্জেন্ট, দুজন প্রহরী—যারা তাঁর ফাঁসির দায়িত্বে ছিল। নীল আকাশের পটভূমিতে তাদের অবয়ব কালো ছায়ার মতো দেখাচ্ছে। তারা তাঁর দিকে আঙুল তুলে চিৎকার ও ইশারা করছিল। ক্যাপ্টেন তার পিস্তল বের করেছিলেন কিন্তু গুলি করেননি; বাকিরা নিরস্ত্র ছিল। তাদের নড়াচড়া ছিল উদ্ভট ও ভয়ঙ্কর।

হঠাৎ একটি তীক্ষ্ণ গুলির শব্দ শুনে তিনি চমকে উঠলেন এবং কিছু একটা তাঁর মাথার কয়েক ইঞ্চি কাছেই পানিতে সজোরে আঘাত করে তাঁর মুখে জলকণা ছিটিয়ে দিল। দ্বিতীয় গুলির শব্দ শুনে তিনি দেখলেন সেতুর এক প্রান্তে একজন প্রহরী রাইফেল কাঁধে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে এবং রাইফেলের নল থেকে নীল ধোঁয়ার একটি হালকা মেঘ উঠছে। তিনি দেখলেন সেতুর উপর দাঁড়ানো লোকটি রাইফেলের টার্গেটের মাধ্যমে তার দিকে তাকিয়ে আছে। তিনি লক্ষ্য করলেন সেটা একটি ধূসর রঙের চোখ এবং তাঁর মনে পড়ল তিনি পড়েছিলেন যে ধূসর চোখই সবচেয়ে তীক্ষ্ণ হয় এবং সকল বিখ্যাত নিশানাবাজদের এমন চোখই থাকে। তবুও এই লোকটির নিশানা লক্ষ্যভ্রষ্ট হচ্ছিলো।

একটি বিপরীত ঘূর্ণিস্রোত ফারকুহারকে ধরে নিয়ে অর্ধেক ঘুরিয়ে দিল; তিনি আবার কেল্লার বিপরীত তীরের জঙ্গলের দিকে তাকালেন। তার পিছন থেকে একটি স্পষ্ট উচ্চ কণ্ঠস্বরের একঘেয়ে সুরেলা ধ্বনি ভেসে এল এবং পানির উপর দিয়ে এমন স্পষ্টতার সাথে আসল যা অন্য সমস্ত শব্দকে, এমনকি তার কানে ঢেউয়ের শব্দকেও স্তব্ধ করে দিল। যদিও তিনি সৈনিক নন তবুও ক্যাম্পে এতটা সময় কাটিয়েছেন যে সেই ধীর, টানা, উচ্চারিত সুরের ভয়াবহ তাৎপর্য বুঝতে একটুও দেরি হলোনা। তীরে থাকা লেফটেন্যান্ট কতটা ঠাণ্ডা মাথায় ও নিষ্ঠুরভাবে—কতটা শান্ত স্বরে নিখুঁত মাপা বিরতিতে সেই নিষ্ঠুর শব্দগুলো উচ্চারণ করছিলঃ

"কোম্পানি!... অ্যাটেনশন!... শোল্ডার আর্মস!... রেডি!... এইম!... ফায়ার!"

ফারকুহার যতটা সম্ভব গভীরে ডুব দিলেন। তাঁর কানে পানির গর্জন নায়াগ্রার মতই প্রবল শোনালো তবুও তিনি গুলির মন্থর বজ্রধ্বনি শুনতে পেলেন। আবার উপরের দিকে উঠতে গিয়ে দেখলেন অদ্ভুতভাবে চ্যাপ্টা হয়ে যাওয়া কতগুলো চকচকে ধাতুর টুকরো ধীর গতিতে নিচে নেমে যাচ্ছে। কিছু টুকরো তাঁর মুখ ও হাতে স্পর্শ করল, তারপর পিছলে দূরে সরে গিয়ে তাদের পতন অব্যাহত রাখল। একটা টুকরো তাঁর কলার এবং ঘাড়ের মাঝখানে আটকে গেল; সেটা অস্বস্তিকর গরম ছিল তাই দ্রুত সেটাকে বের করে ফেলে দিলেন।

শ্বাস নেওয়ার জন্য পানির উপরে উঠে এসে হাঁপাতে হাঁপাতে দেখলেন তিনি অনেকক্ষণ পানির নিচে ছিলেন। তিনি স্রোতের টানে বেশ খানিকটা দূরে নিরাপদ স্থানের আরও কাছাকাছি চলে এসেছেন। সৈন্যরা পুনরায় গুলি ভরা শেষ করেছে। ব্যারেল থেকে বের করে বাতাসে ঘুরিয়ে সকেটে ঢোকানোর সময় ধাতব রামরডগুলো একসাথে রোদে চকচক করে উঠলো। দুজন প্রহরী আবার গুলি করল। এক নিষ্ফল প্রচেষ্টা।

পলায়নরত মানুষটি স্রোতের সাথে প্রবলভাবে সাঁতার কাটতে কাটতে তার কাঁধের উপর দিয়ে এই সব দেখতে পেলেন। তার হাত-পায়ের মত মাথাটাও সক্রিয় ছিল; তিনি বিদ্যুতের গতিতে চিন্তা করলেন:

"অফিসারটি" তিনি যুক্তি দিলেন, "সেই প্রহরীটির মত দ্বিতীয়বার ভুল করবেন না। একটি গুলিকে এড়ানো সহজ। তিনি সম্ভবত ইতিমধ্যেই ইচ্ছামতো গুলি করার আদেশ দিয়েছেন। আল্লাহ আমাকে সাহায্য করুন, আমি সবগুলো গুলি এড়াতে পারব না!"

তার মাথার কাছাকাছি প্রায় দুই গজ দূরে একটা ভয়ানক ছপাৎ শব্দ হল তারপর একটা জোরালো গর্জন যেন ক্রমশ ক্ষীণ হয়ে বাতাসে ভেসে কেল্লার দিকে ছড়িয়ে পড়ল এবং একটি বিস্ফোরণের মাধ্যমে শেষ হলো যা নদীর গভীরতম অংশকেও কাঁপিয়ে দিল! পানির একটি উঁচু ঢেউ তার ওপর আছড়ে পরে তাকে প্রায় একইসঙ্গে অন্ধ ও শ্বাসরোধ করে ফেলল। কামান এবার খেলায় অংশ নিয়েছে। আঘাতপ্রাপ্ত পানির আলোড়ন থেকে মাথা উঠাতেই শোনা গেল বিচ্যুত গোলাটি বাতাসে গুঞ্জন করে এগিয়ে যাচ্ছে এবং মুহূর্তেই সেটা ওপারের জঙ্গলে গাছের ডালপালা ভেঙে চুরমার করে দিচ্ছে।

"ওরা আর এটা করবে না" তিনি ভাবলেন, "পরের বার ওরা গ্রেপশট ব্যবহার করবে। আমাকে কামানের ওপর নজর রাখতে হবে; ধোঁয়া আমাকে সতর্ক করবে—গর্জনটা তো গোলার পেছনে পেছনে দেরি করে আসে। ভালো কামান বটে।"

হঠাৎ অনুভব করলেন তিনি চারপাশে লাটিমের মতো ঘুরছেন। পানি, তীর, জঙ্গল, অনেক দূরের সেতু, কেল্লা আর মানুষগুলো সব মিলেমিশে অস্পষ্ট হয়ে গেছে। জিনিসগুলো শুধু তাদের রঙ দিয়ে চেনা যাচ্ছিলো। তিনি একটা ঘূর্ণিস্রোতে আটকে গেছেন এবং এত দ্রুত গতিতে এগিয়ে যাচ্ছেন আর ঘুরছেন যে তার মাথা ঘুরে উঠল এবং বমি পেতে লাগল। কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই তিনি নদীর দক্ষিণ পাড়ের পাদদেশে নুড়িপাথরের ওপর ছিটকে পড়লেন এবং একটা বেরিয়ে থাকা শিলার পিছনে এসে পড়লেন যা তাকে শত্রুদের কাছ থেকে আড়াল করে রেখেছিল। আকস্মিক গতি থামায় আর নুড়িতে একটা হাতের ছড়ে যাওয়ায় তার হুঁশ ফিরল এবং তিনি আনন্দে কেঁদে ফেললেন।

আঙুল দিয়ে বালিতে খোঁচা দিলেন, মুঠো মুঠো করে নিজের ওপর ছিটিয়ে দিলেন আর চিৎকার করে সেই বালিকে ধন্যবাদ জানাতে লাগলেন। বালিগুলো দেখতে হীরে, মানিক, পান্নার মতো লাগছিল; সুন্দর বলতে যা কিছু আছে তার সবকিছুর সাথেই তিনি বালির মিল খুঁজে পেলেন। তীরের গাছগুলো দেখতে লাগছে বিশাল বাগানের গাছের মতো। তাদের সাজানোর মধ্যে একটা নির্দিষ্ট ক্রম লক্ষ করলেন, বুকভরে তাদের ফুলের সুগন্ধ নিলেন। গাছের কাণ্ডের ফাঁক দিয়ে একটা অদ্ভুত গোলাপি আলো ঝলমল করছিল আর বাতাস তাদের ডালপালায় বাতাসী বীণার সুর তুলছিল। তার পালাতে ইচ্ছে করছিলো না—পুনরায় ধরা পড়ার আগ পর্যন্ত এই মোহনীয় জায়গায় থেকে যেতে পারলেই তিনি খুশি হতেন।

মাথার ওপর গাছের ডালপালার মধ্যে গ্রেপশটের শোঁ শোঁ শব্দ আর খটখট আওয়াজে তার স্বপ্নভঙ্গ হলো। হতাশ কামানের গোলন্দাজ তাকে বিদায় জানাতে এলোমেলোভাবে গোলা ছুঁড়ছিল। তিনি লাফিয়ে উঠে ঢালু তীর দিয়ে দৌড়ে জঙ্গলে ঢুকে পড়লেন।

সেদিন সারাটাদিন তিনি সূর্যের গতিপথ অনুসরণ করে পথ চললেন। বন যেন অন্তহীন; কোথাও কোনো ফাঁকা স্থান নেই—এমনকি কাঠুরের রাস্তা পর্যন্ত না। এতটা বুনো অঞ্চলে বাস করেন এটা তিনি এতদিন জানতেনই না। এই আবিষ্কারে কেমন যেন অদ্ভুত কিছু অশুভ ব্যাপার ছিল।

ফোস্কা পড়া পায়ে ক্ষুধায় কাতর ফারকুহার সন্ধ্যা নাগাদ প্রচণ্ড ক্লান্ত হয়ে পরলেন। স্ত্রী ও সন্তানদের কথা চিন্তা করে তিনি শত কষ্টের মাঝেও এগিয়ে চললেন। অবশেষে একটি রাস্তা খুঁজে পাওয়া গেল—তিনি জানতেন এটা তাকে সঠিক দিকে নিয়ে যাবে। যদিও এটা শহুরে রাস্তার মতোই চওড়া ও সোজা তবু মনে হচ্ছিল কেউ এপথে চলাচল করে না। কোথাও কোনো জমি বা বাড়িঘর দেখা যাচ্ছিলো না। এমনকি কুকুরের ডাক পর্যন্ত শোনা গেল না যা শুনে তিনি অন্তত বুঝতে পারতেন আশেপাশে কোথায় মানব বসতি রয়েছে। গাছের কালো কাণ্ড দুই পাশে সোজা দেয়াল তৈরি করে দিগন্তে একটা বিন্দুতে গিয়ে মিলিত হয়েছে—যেন দৃষ্টিবিজ্ঞান পাঠের আঁকা কোন ছবি।

মাথার ওপর গাছের ফাঁক দিয়ে তাকাতেই অদ্ভুত নক্ষত্রপুঞ্জে সাজানো উজ্জ্বল সোনালী তারার ঝলমলে আলো দেখা গেল । তিনি নিশ্চিত যে এদের এভাবে সাজানোর নিশ্চয়ই একটা গোপন আর অশুভ তাৎপর্য রয়েছে। দুপাশের বন বিচিত্র শব্দে পরিপূর্ণ—তার মধ্যে একবার, দুবার, এইতো আবারও তিনি যেন একটি স্পষ্ট অজানা ভাষার ফিসফিসানি শুনতে পেলেন!

ঘাড় প্রচণ্ড ব্যথা করছিলো; হাত তুলে স্পর্শ করলে দেখা গেল সেটা ভয়ানকভাবে ফুলে রয়েছে। তিনি জানতেন দড়ির ঘষায় সেখানে একটি কালো দাগের বৃত্ত তৈরি হয়েছে। চোখ দুটো ভারি হয়ে উঠায় সেগুলো তিনি বন্ধ করতে পারছিলেন না। তৃষ্ণায় জিহ্বা ফুলে উঠেছে; তিনি দাঁতের ফাঁক দিয়ে ঠাণ্ডা বাতাসে জিহ্বা বের করে সেই জ্বালা কমানোর চেষ্টা করলেন। নরম ঘাস কি দারুণভাবে অচেনা পথটিকে মখমলের মতো ঢেকে রেখেছিল—তিনি এখন তার পায়ের নিচে রাস্তার স্পর্শ অনুভব করতে পারছিলেন না।

এতো কষ্টের মধ্যেও তিনি হাঁটতে হাঁটতে ঘুমিয়ে পড়লেন কারণ এখন তিনি ঘোরের মধ্যে অন্য একটি দৃশ্য দেখছেন—"হয়তো তিনি কেবল প্রলাপ থেকে সেরে উঠেছেন। তিনি নিজ বাড়ির গেটে দাঁড়িয়ে আছেন। সব কিছু তেমনই আছে যেমনটি তিনি রেখে গিয়েছিলেন আর সকালের রোদে সবকিছু উজ্জ্বল ও সুন্দর দেখাচ্ছে। নিশ্চয়ই তিনি সারারাত হেঁটেছেন। গেট ঠেলে সাদা চওড়া পথ ধরে এগোতেই মেয়েলি পোশাকের একটি ঝলক দেখতে পেলেন; সতেজ শান্ত ও মিষ্টি দেখতে মিসেস ফারকুহার তাকে অভ্যর্থনা জানানোর জন্য বারান্দা থেকে নিচে নেমে এলেন। অতুলনীয় মর্যাদা আর সৌন্দর্যের ভঙ্গিতে মুখে অপার্থিব আনন্দের হাসি নিয়ে তিনি সিঁড়ির নিচে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছেন।

আহ, সে কত সুন্দরী!
তিনি বাড়ানো বাহু নিয়ে সামনের দিকে দ্রুত এগিয়ে গেলেন। ঠিক যখন তাকে আলিঙ্গন করতে যাবেন তখনই তার ঘাড়ের পিছনে এক তীব্র আঘাত অনুভব করলেন; অন্ধকারের মাঝে কামানের বিস্ফোরণের মতো সাদা আলোয় চারপাশ ঝলসে ওঠে—তারপর সবকিছু অন্ধকার ও নিস্তব্ধ!

পেইটন ফারকুহার মারা গিয়েছিলেন; তার দেহ, ভাঙা ঘাড় নিয়ে আউল ক্রিক সেতুর কাঠের নিচে মৃদুভাবে দুলছিল।

[সমাপ্ত]

হেনরি রাইডার হ্যাগার্ড এর স্মিথ অ্যান্ড দ্য ফারাওস (Smith and the Pharaohs) রূপান্তর মেহেদী হাসান



“স্মিথ অ্যান্ড দ্য ফারাওস” গল্পটি প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল ১৯২০ সালে। এটা স্যার হেনরি রাইডার হ্যাগার্ডের 'স্মিথ অ্যান্ড দ্য ফারাওস, অ্যান্ড আদার টেলস' বইয়ের একটি গল্প। এই সংগ্রহে মোট ছয়টি গল্প আছে। গল্পগুলো হলো: 'স্মিথ অ্যান্ড দ্য ফারাওস', 'মাগেপা দ্য বাক', 'দ্য ব্লু কার্টেন্স', 'দ্য লিটল ফ্লাওয়ার', 'ওনলি আ ড্রিম' এবং 'বারবারা হু কেম ব্যাক'। বইটিতে 'স্মিথ অ্যান্ড দ্য ফারাওস' হচ্ছে প্রথম গল্প।

………………………………………………………….

ভুমিকা


মাঝে মাঝে বিজ্ঞানীদের মধ্যে মতভেদ হলেও অধিকাংশরা বলেন তারা মানুষ সম্পর্কে সব জানেন। মানুষ কোথা থেকে এসেছে সেটা তারা খুঁজে বের করেছেন। তারা দেখিয়েছেন কিভাবে মানুষের কঙ্কালের বিবর্তন ঘটেছে। এছাড়াও দেখিয়েছেন কিভাবে প্রয়োজন ও আবেগের টানে এক সময়ের সরল মস্তিষ্ক ধীরে ধীরে সাধারণ অবস্থা থেকে বিকশিত হয়েছে। তারা স্পষ্টভাবে দেখিয়েছেন যে মানুষের সবকিছুই ব্যবচ্ছেদ টেবিলে কাটা-ছেড়ার মাধ্যমে ব্যাখ্যা করা সম্ভব।

তাদের মতে মানুষের পরকাল নিয়ে ভাবনার পেছনে মূলত আছে মৃত্যুভয়। আবার কেউ কেউ বলেন এটা ভূমিকম্প বা বজ্রপাতের ভয় থেকে আসে। তারা বলেন অতীতের সাথে মানুষের সম্পর্ক তার পূর্বপুরুষদের কাছ থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া যারা হয়তো লক্ষ লক্ষ বছর আগে এই পৃথিবীতে বসবাস করতেন। আর তার সব মহৎ গুণ শুধু নিজের সুবিধার জন্য গড়ে তোলা আচরণ মাত্র। অন্যদিকে সব খারাপ দিকগুলো এসেছে তার আদিম বা বন্য স্বভাব থেকে। সংক্ষেপে বললে মানুষও একপ্রকার প্রাণী যে তার চারপাশের পরিবেশ দ্বারা প্রভাবিত হয়। তাদের (অন্তত কিছু গবেষকের) দাবি এইগুলোই বাস্তব; বাকি সবই আজেবাজে কল্পনা।

কখনও কখনও এসব জ্ঞানীদের কথায় বিশ্বাস করতে ইচ্ছা হয় বিশেষ করে যখন তাদের কারো বক্তৃতা শোনার সুযোগ হয় আমাদের। কিন্তু তারপর হঠাৎ জীবনে এমন কিছু ঘটে যা আমাদের থামিয়ে দেয় ও ভাবিয়ে তোলে। মনে আবার সেই পুরনো ঈশ্বর সংক্রান্ত প্রশ্নগুলো দানা বাঁধে। আর সেই প্রশ্নেগুলোর সাথে জেগে ওঠে আরও এক গভীর, আরও এক আশাজাগানিয়া ঐশ্বরিক অনুভূতি।

সব কথা ভেবে চিন্তে কখনও কখনও মনে হয় মানুষ বোধহয় শুধু একটি প্রাণী নয় বরং এর চেয়েও বেশি কিছু। হয়তো সে অতীতকে চিনেছে - সুদূর অতীতকে। আর ভবিষ্যতেও সে একদিন পৌঁছাবে - অনেক, অনেক দূরের ভবিষ্যতে। হয়তো যে কল্পনাকে আমরা "স্বপ্ন" বলি, সেটাই সত্যি। হয়তো মানুষের মধ্যে সত্যিই আছে এক অমর আত্মা । এই আত্মা বিভিন্ন রূপে নিজেকে প্রকাশ করতে পারে। এটা যুগ যুগ ঘুমিয়ে থাকতে পারে। তবুও ঘুমন্ত হোক কিংবা জাগ্রত - আসলে এটা সরুপেই থাকে যা মহাবিশ্বের পদার্থের মতো অবিনশ্বর।

পর্বঃ এক

_______________________________________


যদি কেউ মিঃ জেমস এবেনেজার স্মিথের জীবনের বিস্তারিত ঘটনাগুলো জানতেন তাহলে নিঃসন্দেহে এটি তার মনে গভীর চিন্তার উদ্রেক করত। কিন্তু এই লেখাটি প্রকাশের আগে পর্যন্ত এর বিস্তারিত কেউই জানতো না। তবে স্মিথ এমন একজন ব্যক্তি যিনি কখন চুপ থাকতে হয় তা ভালোই বুঝেন। তবুও এই ঘটনাটি স্বয়ং স্মিথকেই গভীরভাবে ভাবিয়ে তুলেছিল। আসলে, জেমস এবেনেজার স্মিথ এখনও এই ঘটনা নিয়ে অত্যন্ত গভীরভাবে ভাবছেন।

স্মিথ ছিলেন সুশিক্ষিত ও ভালো পরিবারের সন্তান। কলেজে থাকাকালীন তিনি একজন সুদর্শন ও মেধাবী যুবক ছিলেন। কিন্তু ডিগ্রি নেওয়ার আগেই তার জীবনে সমস্যা দেখা দিল এবং তিনি সম্পূর্ণ নিঃস্ব ও বন্ধুহীন অবস্থায় জগতের কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি হন।

তবে তাকে একেবারে বন্ধুহীন বলা যাবেনা। তার একজন গডফাদার ছিলেন। এই ভদ্রলোক ব্যবসার সঙ্গে জড়িত ছিলেন। তার নাম ছিল এবেনেজার। শেষ ভরসা হিসেবে স্মিথ তার কাছেই গেলেন, এই ভেবে যে বাপ্তিস্মে তাকে যে অদ্ভুত নামটি দেওয়া হয়েছিল তার বিনিময়ে এবেনেজার হয়ত তার কাছে কিছুটা ঋণী।

এবেনেজার কিছুটা দায়িত্ববোধ দেখালেন। তিনি বড় কোনো সাহায্য না করলেও স্মিথকে তার পরিচালিত একটি ব্যাংকে সাধারণ ক্লার্কের চাকরি দিলেন। এছাড়াও এক বছর পর তিনি মারা গেলে স্মিথের জন্য একশ পাউন্ড রেখে গেলেন স্মারক হিসেবে খরচ করার জন্য।

ব্যবসায়িক বুদ্ধিসম্পন্ন স্মিথ সেই টাকা স্মারকের পেছনে নষ্ট না করে একটি লাভজনক ব্যবসায় বিনিয়োগ করলেন। সৌভাগ্যক্রমে তার ধারণা সঠিক প্রমাণিত হলো এবং বিনিয়োগ দশ গুণ হয়ে ফিরে এল। তিনি আবারও বিনিয়োগ করলেন এবং এইবারও সাফল্য পেলেন। ত্রিশ বছর বয়সে তার সম্পত্তির পরিমাণ দাঁড়াল পঁচিশ হাজার পাউন্ডেরও বেশি। এরপর তিনি এই ফটকা ব্যবসা বন্ধ করে টাকাটা নিরাপদ জায়গায় রেখে বছরে চার শতাংশ হারে আয় করতে লাগলেন।

এই সময়ে স্মিথ ব্যাংকের একজন বিশ্বস্ত কর্মী হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছিলেন। যদিও তিনি ক্লার্কই ছিলেন তবে বছরে বেতন ছিল চারশ পাউন্ড। তিনি চাইলে বিয়ে করতে পারতেন। কিন্তু তিনি বিয়ে করতে চাননি। হয়তো পরিচিত মহিলাদের কেউই তাকে আকর্ষণ করেনি অথবা অন্য কোনো কারণ ছিল।

লাজুক ও সংরক্ষণশীল স্বভাবের স্মিথ কাউকে নিজের কথা বলতেন না। ব্যাংকের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা বা পরিচালনা পর্ষদও জানতেন না যে তিনি কতটা সম্পদশালী। পুটনির কাছে তার ফ্ল্যাটে কেউই যেত না এমনকি তিনি কোনো ক্লাবের সদস্য ছিলেন না এবং তার কোনো ঘনিষ্ঠ বন্ধুও ছিল না। জীবনের প্রথম দিকে জগতের কাছ থেকে পাওয়া কঠিন আঘাত, প্রত্যাখ্যান ও রূঢ় ব্যবহার তার সংবেদনশীল মনে এত গভীর দাগ কেটেছিল যে তিনি কখনও আর মানুষের সাথে ঘনিষ্ঠ হতে চাননি। এমনকি অল্প বয়সেই তিনি এক ধরণের পরিশীলিত একাকীত্বপূর্ণ জীবনযাপন শুরু করেন।

বিনিয়োগ বন্ধ করার পর স্মিথ শীঘ্রই অনুভব করলেন যে মানুষের মনেরও কোনো না কোনো কাজের প্রয়োজন। তিনি জনহিতকর কাজ করার চেষ্টা করলেন কিন্তু অন্যের ব্যক্তিগত বিষয়ে অপ্রাসঙ্গিক প্রশ্ন করতে গিয়ে নিজেকে অস্বস্তিকর অবস্থায় পড়তে দেখলেন। শেষমেশ তিনি নিজের সাথে একটি সমঝোতায় এলেন—তার আয়ের একটি বড় অংশ উপযুক্ত ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের মধ্যে বেনামে বিতরণের জন্য আলাদা করে রাখলেন।

এক শীতের দিনে ব্যাংক বন্ধ থাকায় স্মিথ ব্রিটিশ মিউজিয়ামে ঢুকে পড়লেন। মূলত বাইরের দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়া থেকে বাঁচতেই তিনি মিউজিয়ামে চলে আসেন। এলোমেলোভাবে ঘুরতে ঘুরতে তিনি মিশরীয় পাথরের জিনিসপত্র ও ভাস্কর্যের জন্য সংরক্ষিত বিশাল গ্যালারিতে এসে উপস্থিত হলেন। মিশর সম্পর্কে অজ্ঞ স্মিথ এই সমস্ত দেখে কিছুটা অবাকই হলেন। তিনি ভাবলেন, নিশ্চয়ই অত্যন্ত বিচক্ষণ কোনো সভ্যতা ছিল যারা এমন শিল্পকর্ম তৈরি করেছিল। এই চিন্তার সাথে তাদের সম্পর্কে আরও জানার আকাঙ্ক্ষা জন্ম নিল। তবুও তিনি চলে যাচ্ছিলেন। হঠাৎ তার চোখ পড়ল দেওয়ালে ঝোলানো একটি নারীর মুখের ভাস্কর্যের উপর।

স্মিথ নারী মুখের ভাস্কর্যটির দিকে ভালভাবে তাকালেন। একবার, দুবার, তিনবার তাকানোর পর অজান্তেই তিনি যেন প্রেমে পড়ে গেলেন। সেই খোদাই করা মুখচ্ছবি তাকে এমনভাবে টেনে নিল যে তিনি কখনোই তা ভুলতে পারবেন না। হয়তো সাধারণ দৃষ্টিতে এটি অত সুন্দর ছিল না। হয়তো এর ঠোঁটগুলো বড্ড মোটা ছিল এবং নাকের ছিদ্রগুলোও বেশি প্রসস্ত ছিল। শুধু তার রহস্যময় হাসিই ছিল অসাধারণ। তবুও তার কাছে সেই মুখটি ছিল সৌন্দর্যের প্রতীক যে তাকে এক অদৃশ্য শক্তিতে টানছিল এবং তার মনে নানান কল্পনার জন্ম দিচ্ছিল যার কিছু ছিল এতটাই অদ্ভুত ও আবেগঘন যেন সেগুলো স্মিথের নিজের স্মৃতিরই অংশ। তিনি সেই মূর্তির দিকে তাকিয়ে রইলেন আর মূর্তিটিও তার দিকে তাকিয়ে মিষ্টি হাসছিল ঠিক যেমনটি হেসেছিল জীবিত অবস্থায়। প্লাস্টারের নকল মূর্তিটি সত্যিকার অর্থেই আসল মনে হচ্ছিল।

এমন সময় একজন খাটো, মোটা ভদ্রলোক ব্যস্তভাবে এগিয়ে এলেন এবং কর্তৃত্বপূর্ণ সুরে কয়েকজন শ্রমিককে কিছু নির্দেশ দিলেন যারা কাছাকাছি একটি মূর্তির বেদি সাজাচ্ছিল। স্মিথের মনে হলো ইনি নিশ্চয়ই এই বস্তুগুলো সম্পর্কে জানেন। স্বভাবসিদ্ধ লাজুকতা কাটিয়ে টুপি তুলে তিনি ভদ্রলোকের কাছে জানতে চাইলেন এই মুখোশের আসল মানুষটি কে ছিলেন।

ভদ্রলোক ছিলেন মিউজিয়ামের একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা। তিনি স্মিথের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালেন। তিনি বুজতে পারলেন এই ব্যাপারে সত্যিই স্মিথের আগ্রহ আছে। তিনি বললেন-

"আমি জানি না। কেউই জানে না। এই মূর্তিটিকে বিভিন্ন নাম দেওয়া হয়েছে, কিন্তু কোনোটিই প্রমানিত নয়। হয়তো একদিন মূর্তির বাকি অংশ খুঁজে পাওয়া যাবে তখন আমরা জানতে পারব। অবশ্য যদি তাতে কোনো লিপি থাকে। তবে সম্ভবত অনেক আগেই এটিকে চুন তৈরির জন্য পুড়িয়ে ফেলা হয়েছে।"

"তাহলে আপনি এর সম্পর্কে কিছুই বলতে পারবেন না?" স্মিথ জিজ্ঞাসা করলেন।

"আচ্ছা, অল্প কিছু বলতে পারি। প্রথমত, এটি একটি প্রতিরূপ। আসল মূর্তি কায়রো মিউজিয়ামে আছে। ম্যারিয়েট এটাকে কার্নাকে খুঁজে পেয়েছিলেন বলে আমার ধারণা এবং তিনি তার মতো করে এর একটি নাম দিয়েছিলেন। সম্ভবত এটি একজন রানীর মূর্তি – মুকুটের কারুকাজ দেখে মনে হয় অষ্টাদশ রাজবংশের। ভাঙা ইউরিয়াস দেখে আপনি তার মর্যাদা নিজেই বুঝতে পারবেন।" (স্মিথ তাকে থামিয়ে বলেননি যে ইউরেয়াস কী হতে পারে সে সম্পর্কে তার বিন্দুমাত্র ধারণা নেই। কারণ তিনি মিশরীয় রাজপরিবারের সাপের মাথাওয়ালা প্রতীক সম্পর্কে সম্পূর্ণ অজ্ঞ ছিলেন।) "আপনার উচিত মিশরে গিয়ে মাথাটা নিজে দেখে আসা। এটা এখন পর্যন্ত পাওয়া সবচেয়ে সুন্দর নিদর্শনগুলোর মধ্যে একটি। আচ্ছা, আমাকে এখন যেতে হবে। শুভ দিন।"

এই বলে তিনি ব্যস্তভাবে দীর্ঘ গ্যালারি ধরে চলে গেলেন।

স্মিথ উপরের তলায় গিয়ে মমি এবং অন্যান্য নিদর্শন দেখলেন। সেই মিষ্টি মায়াবী মুখের অধিকারীনী যে আজ থেকে বহু শতাব্দী আগে খ্রিস্টের জন্মেরও পূর্বে মমিতে পরিণত হয়েছেন—এই ভাবনা তাকে ব্যথা দিল। মমিগুলো তার কাছে মোটেও আকর্ষণীয় মনে হল না।

তিনি আবার ভাস্কর্যের গ্যালারিতে ফিরে এলেন এবং সেই প্লাস্টারের নারী মুখটির দিকে একদৃষ্টে এমনভাবে তাকিয়ে রইলেন যতক্ষণ না একজন শ্রমিক তার সঙ্গীকে মন্তব্য করল যে, "যদি আমি এই ভদ্রলোক হতাম, তাহলে এরকম জীবন্ত কাউকে দেখতে যেতাম!"

লজ্জিত হয়ে স্মিথ সেখান থেকে চলে এলেন।

বাড়ি ফেরার পথে তিনি একটি বইয়ের দোকানে গিয়ে মিশরবিদ্যা সংক্রান্ত সবচেয়ে ভালো বইগুলো অর্ডার দিলেন। কয়েকদিন পর যখন একটি প্যাকিং কেসে করে বইগুলো এলো তিনি দৃঢ়তার সঙ্গে বইগুলো পড়তে আরম্ভ করলেন। বুদ্ধিমান ও পরিশ্রমী স্মিথ তিন মাসের মধ্যেই বিষয়টির উপর ভালো রকমের জ্ঞান অর্জন করলেন, এমনকি হায়ারোগ্লিফিক্সেরও সামান্য জ্ঞান লাভ করলেন।

সেই তিন মাস পর অর্থাৎ জানুয়ারি মাসে স্মিথ তার ব্যাংক ডিরেক্টরদের অবাক করে দিয়ে দশ সপ্তাহের ছুটির আবেদন করে বসলেন। অথচ তিনি এর আগে বছরে মাত্র দুই সপ্তাহ ছুটিতে সন্তুষ্ট থাকতেন। জিজ্ঞাসাবাদ করলে তিনি ব্যাখ্যা দিলেন যে - তিনি ব্রঙ্কাইটিসে ভুগছেন এবং ডাক্তার তাকে মিশরে গিয়ে আবহাওয়া পরিবর্তনের পরামর্শ দিয়েছেন।

"খুব ভালো," ম্যানেজার বললেন; "কিন্তু আমার ভয় হচ্ছে আপনার অনেক খরচ হয়ে যাবে। মিশরে তারা মানুষকে ঠকায়।"

"আমি জানি," স্মিথ উত্তর দিলেন; "কিন্তু আমি কিছু সঞ্চয় করেছি এবং তা খরচ করার মত আমি ছাড়া আর কেউ নেই।"



পর্বঃ দুই

_______________________________________


অবশেষে স্মিথ মিশরে গিয়ে সেই সুন্দরী মূর্তির আসল মুখাবয়ব সহ হাজারো চিত্তাকর্ষক নিদর্শন দেখলেন। শুধু তাই নয়, কিছু প্রত্নতাত্ত্বিকের সাথে যুক্ত হয়ে তিনি প্রাচীন থিবসের আশেপাশে এক মাস খনন কাজেও অংশ নিলেন যদিও তেমন উল্লেখযোগ্য কোনো কিছুই পেলেন না।


এর বছর দুয়েক পরই তিনি তার মহান আবিষ্কারটি করলেন যা আজও স্মিথের সমাধি নামে পরিচিত। এখানে বলে রাখা ভালো যে স্বাস্থ্যগত কারণে প্রতি বছর মিশরে যাওয়া তার জন্য আবশ্যক হয়ে দাঁড়িয়েছিল—অন্তত তার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা এটাই বিশ্বাস করতেন। তবে যেহেতু তিনি গ্রীষ্মকালীন ছুটির জন্য আবেদন করতেন না এবং সবসময় সহকর্মীদের কাজে সহায়তা করতেন যার ফলে শীতকালীন এই ভ্রমণগুলো তার পক্ষে সহজেই সম্ভব হচ্ছিল।

মিশরে তার এই তৃতীয় সফরে স্মিথ কায়রোর প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের মহাপরিচালকের কাছ থেকে নিজের উদ্যোগে খননের অনুমতি পেলেন। ইতিমধ্যেই একজন দক্ষ মিশরতত্ত্ববিদ হিসেবে পরিচিতি পাওয়ায় তাকে স্বাভাবিক শর্তেই এই অনুমতি দেওয়া হয়। অর্থাৎ প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ আবিষ্কৃত বস্তুগুলোর যেকোনোটি বা চাইলে সবগুলোই নেওয়ার অধিকার রাখবে।

প্রাথমিক প্রস্তুতি শেষে স্মিথ কায়রো মিউজিয়ামে কয়েকদিন কাটিয়ে লুক্সরের রাতের ট্রেনে চড়ে বসলেন। সেখানে তিনি তার প্রধান সহকারী মাহমুদ (একজন সাবেক ড্রাগোম্যান বা পর্যটক পথপ্রদর্শক) এবং ভাড়া করা শ্রমিকরা তার জন্য অপেক্ষা করছিল। যেহেতু এটা ছিল একটি ছোট আকারের উদ্যোগ তাই মাত্র চল্লিশ জন শ্রমিক নিয়ে এই খননকাজ শুরু হলো। তিনি মাত্র তিনশ পাউন্ড বাজেট নির্ধারণ করেছিলেন যা প্রত্নতাত্ত্বিক খননের জন্য খুবই অপ্রতুল।

গত বছর মিশর সফরে স্মিথ খননের জন্য একটি স্থান চিহ্নিত করে রেখেছিলেন। এটি ছিল প্রাচীন থিবসের কবরস্থানে মেডিনেট হাবু মন্দিরের কাছে কুইন্স ভ্যালি বা রানীদের উপত্যকা নামে পরিচিত একটি নির্জন স্থান। এই স্থানটি থেকে রাজাদের সমাধিস্থল একটি পাহাড় দ্বারা পৃথক করা। মিশরের অনেক মহিয়সী রানী এখানে চিরনিদ্রায় শায়িত আছেন এবং তাদেরই কোনো সমাধি খুঁজে বের করার লক্ষ্য ছিল স্মিথের। তিনি ভালো করেই জানতেন এর মধ্যে কিছু সমাধি এখনো আবিষ্কার হওয়া বাকি আছে।

কে বলতে পারে? ভাগ্য সাহসী মানুষের পক্ষেই থাকে। হয়তো তিনি সেই সুন্দরী, অজানা রাজকীয় নারীর সমাধি খুঁজে পাবেন, যার মুখ গত তিন বছর ধরে তাকে আবিষ্ট করে রেখেছিল!

একটি পূর্ণ মাস ধরে তিনি খনন করেও সামান্যতম সাফল্য পেলেন না। অবশেষে নির্বাচিত স্থানটি সত্যিই একটি সমাধির প্রবেশপথ হিসেবে প্রমাণিত হলো। পঁচিশ দিনের কঠোর পরিশ্রমের পর সেটি সম্পূর্ণ পরিষ্কার করা হলো এবং তিনি একটি রুক্ষ ও অসম্পূর্ণ গুহার সামনে দাঁড়ালেন। যে রানীর জন্য এই সমাধি প্রস্তুত করা হয়েছিল তিনি সম্ভবত অল্প বয়সেই মারা গিয়েছিলেন এবং অন্য কোথাও তাকে সমাধিস্থ করা হয়েছিলো। অথবা তিনি নিজেই হয়তো অন্য কোনো সমাধি বেছে নিয়েছিলেন কিংবা পাথুরে শিলার গুণগত মান সমাধির জন্য উপযুক্ত ছিল না।

স্মিথ কাঁধ ঝাঁকিয়ে এগিয়ে গেলেন। এখানে সেখানে পরীক্ষামূলক গর্ত ও খাদ খনন করতে লাগলেন কিন্তু তবুও কিছুই পেলেন না। যখন সময় ও অর্থের দুই-তৃতীয়াংশ খরচ হয়ে গেল তখন ভাগ্য তার সহায় হলো। একদিন সন্ধ্যায় স্মিথ তার দক্ষ কয়েকজন শ্রমিক নিয়ে যখন কাজ থেকে খালি হাতে ফিরছিলেন তখন পাহাড়ের গায়ে একটি ছোট খাদ বা বালিয়াড়ির দিকে তার দৃষ্টি আটকে গেল—যেটি ছিল এলোমেলো পাথর ও বালিতে ভরা। যদিও এখানে এমন শত শত জায়গা আছে। তবুও এই স্থানটি তাকে আকর্ষণ করল। সম্পূর্ণ হতাশ হয়ে তিনি সেটি অতিক্রম করে বিশ পা এগিয়েই আবার ঘুরে দাঁড়ালেন।

"কোথায় যাচ্ছেন, স্যার?" তার প্রধান সহকারী মাহমুদ জিজ্ঞাসা করল।

স্মিথ পাহাড়ের খাঁড়িটির দিকে ইশারা করলেন।

"ওখানে কিছু নেই, স্যার," মাহমুদ বলল। "সমাধি থাকলে এখানে শিলাস্তর বেশি উপরে থাকত না। বন্যার পানি এখানে ঢোকে। মৃত রানীরা শুকনো জায়গায় থাকতে ভালোবাসেন!"

কিন্তু স্মিথ এগিয়ে গেলেন এবং অন্যরা বাধ্য হয়ে তাকে অনুসরণ করল।

তিনি বালি ও পাথরের ছোট ঢাল বেয়ে নিচে নেমে খাড়া পাথরটি পরীক্ষা করতে লাগলেন। এটি ছিল অক্ষত একটি পাথরখণ্ড—কোনো মানুষের হাতের ছাপই দেখা যাচ্ছিল না।

শ্রমিকরা চলে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিল এমন সময় এক অদ্ভুত অনুভূতি তাকে আবারও সেই স্থানের দিকে টেনে আনল। তিনি একজন শ্রমিকের কাছ থেকে বেলচা নিয়ে পাথর থেকে বালি সরানো শুরু করলেন।

মনিবকে কাজ করতে দেখে শ্রমিকরাও কাজে লেগে পড়লো। শুধুমাত্র স্মিথকে খুশি করার জন্যই প্রায় বিশ মিনিট ধরে তারা আনন্দচিত্তে খুঁড়তে লাগল কারণ সকলেই নিশ্চিত ছিল যে এখানে কোনো সমাধি নেই। শেষ পর্যন্ত স্মিথ তাদের থামতে বললেন কারণ ছয় ফুট গভীরে খনন করেও পাথরের দেয়ালটি সেই অক্ষতই দেখা যাচ্ছিল।

বিরক্তি নিয়ে স্মিথ শেষ এক বেলচা বালি ছুঁড়ে ফেললেন। একটু উঁচু হয়ে থাকা কিছুর উপর বেলচার ধারালো প্রান্ত আঘাত করলো। আরও কিছু বালি সরাতেই দেখা গেল একটি গোলাকার কার্নিসের মতো অংশ। শ্রমিকদের ডেকে তিনি এটি দেখালেন এবং কোনো কথা ছাড়াই তারা আবার খুঁড়তে আরম্ভ করল। পাঁচ মিনিটের মধ্যেই নিশ্চিত হওয়া গেল এটি সত্যিই একটি কার্নিস এবং আধ ঘণ্টা পর একটি সমাধিদ্বারের উপরের অংশ দেখা গেল।

মাহমুদ বদ্ধ দরজার দিকে ইশারা করে বলল, "প্রাচীন লোকেরা এটাকে বালি পাথর আর কাদা দিয়ে বন্ধ করে দিয়েছে।" তিনি সমতল পাথরের দিকে ইশারা করলেন। এই পাথরগুলো কাদার মর্টার দিয়ে জোড়া লাগানো ছিল। এই কাদার উপর ছিল স্কারাব সিলের ছাপ। যেসব কর্মকর্তার উপর রাজপরিবারের মৃতের সমাধিস্থল চিরকালের জন্য বন্ধ করার দায়িত্ব ছিল তারা এই সিল দিয়ে রেখেছে।

"হয়তো রানী এখনও ভেতরে অক্ষত অবস্থায় আছে," আগের মন্তব্যের কোনো উত্তর না পেয়ে মাহমুদ আবার বলল।

"হয়তো," স্মিথ সংক্ষেপে উত্তর দিলেন। "খোঁড়ো, বাবা, খোঁড়ো! কথা বলে সময় নষ্ট করো না।"

তারা দ্রুত খনন চালিয়ে যেতে লাগল। হঠাৎ স্মিথ কিছু দেখে জোরে আর্তনাদ করে উঠলেন। গাঁথুনিতে মধ্যে একটা গর্ত ছিল অর্থাৎ সমাধিটি আগেই লুটপাট হয়েছে। মাহমুদও এটা দেখল এবং তার অভিজ্ঞ দৃষ্টিতে ফোকরটির উপরের অংশ পরীক্ষা করল।

"খুব পুরনো চোর," সে বলল। "দেখুন, সে আবার দেয়াল তোলার চেষ্টা করেছিল, কিন্তু শেষ করার আগেই পালিয়ে গেছে।"

এই বলে সে কিছু চ্যাপ্টা পাথরের দিকে ইঙ্গিত করল যা অগোছালো ও তাড়াহুড়ো ভাবে বসানো হয়েছিল।

"খোঁড়ো—খোঁড়ো!" স্মিথ আদেশ দিলেন।

আরও দশ মিনিটের মধ্যে প্রবেশপথটি একজন মানুষের শরীর প্রবেশ করার মতো বড় করা হল। এতক্ষণে সূর্য অস্ত যাচ্ছিল। পশ্চিমের পাহাড়শ্রেণীর উপর সূর্য লাল আগুনের গোলকের মতো কিছুক্ষণ ঝুলে থাকল তারপর মুহূর্তেই অদৃশ্য হয়ে গেল। সবুজ আভার একটি ঝলক দেখা দিল এবং তাও মিলিয়ে গেল। হঠাৎ করেই মরুর বুকে মিশরের রাত নেমে এল।

শ্রমিকরা নিজেদের মধ্যে ফিসফিস করতে লাগল। কেউ কেউ অজুহাত দেখিয়ে সরে যেতে শুরু করল। বাকিরা তাদের সরঞ্জাম ফেলে দিয়ে স্মিথের দিকে তাকিয়ে রইল।

"ওরা এখানে থাকতে চায় না। ভূতের ভয় পাচ্ছে! এই সমাধিগুলোতে অনেক আফ্রিত (অশরীরী আত্মা) থাকে। ওরা বলছে কাল সকালে আলো থাকতে এসে কাজ শেষ করবে। এই সাধারণ শ্রমিকরা খুব বোকা মানুষ," মাহমুদ তার স্বাভাবিক কর্তৃত্বপূর্ণ সুরে মন্তব্য করল।

"ঠিক আছে," স্মিথ উত্তর দিলেন, তিনি ভালোভাবেই জানতেন যে সূর্যাস্তের পর সমাধি খোলার কাজে শ্রমিকদের কোনোভাবেই রাজি করানো যাবে না।

"তাদের যেতে দাও। তুমি আর আমি এখানে সকাল পর্যন্ত পাহারা দেব।"

"দুঃখিত স্যার" মাহমুদ বলল, "আমার শরীরটা ভাল লাগছে না, মনে হচ্ছে জ্বর এসেছে। আমি ক্যাম্পে গিয়ে কম্বলের নিচে শুয়ে প্রার্থনা করব।"

"ঠিক আছে, যাও," স্মিথ বললেন; "কিন্তু যদি কোনো সাহসী লোক থাকে, সে যেন আমার বড় কোট, কিছু খাবার-পানীয় আর তাঁবুতে ঝোলানো লন্ঠনটা নিয়ে আসে। আমি উপত্যকায় তার সাথে দেখা করব।"

মাহমুদ অনিচ্ছাসত্ত্বেও রাজি হলো এবং স্মিথকে তাদের সাথে যেতে অনুরোধ করল—যাতে সমাধির ভূত রাতে কোনো ক্ষতি করতে না পারে। তারপর তারা দ্রুত চলে গেল।

স্মিথ পাইপ ধরিয়ে বালিতে বসে অপেক্ষা করতে লাগলেন। আধঘণ্টা পর অন্ধকার উপত্যকা থেকে গানের আওয়াজ ও আলো আসতে দেখলেন।

"আমার সাহসী লোকেরা" তিনি মনে মনে ভাবলেন এবং ঢাল বেয়ে তাদের সাথে দেখা করতে এগিয়ে গেলেন।

তিনি ঠিকই অনুমান করেছিলেন। তার বিশজন শ্রমিক আসছিল। এর কম সংখ্যায় তারা রাতের উপত্যকার ভূতদের মুখোমুখি হতে সাহস পায়নি। হঠাৎ একজন শ্রমিকের (মাহমুদ নয়, তার অসুস্থতা হঠাৎ বেড়ে গিয়েছিল) হাতের লন্ঠনের আলো স্মিথের লম্বা দেহের উপর পড়ল। সাদা ইউনিফর্ম পরে তিনি পাথরে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন। সঙ্গে সঙ্গে লন্ঠন নিচে পড়ে গেল এবং ভয়ে আর্তনাদ করে সাহসী দলটি পালিয়ে গেল।

"কাপুরুষের দল!" স্মিথ আরবিতে জোরালো গর্জন করে উঠলেন, "আমি তোমাদের মনিব, কোনো আফ্রিত নই।"

তারা শুনতে পেয়ে আস্তে আস্তে ফিরে এল। তখন স্মিথ লক্ষ্য করলেন যে তারা সংখ্যায় ভারি হওয়ায় প্রত্যেকেই কিছু না কিছু জিনিস বহন করে এনেছে। একজন রুটি, আরেকজন লন্ঠন, কেউ সার্ডিনের টিন, কেউ টিন খোলার যন্ত্র, কেউ দেশলাইয়ের বাক্স, কেউ বিয়ারের বোতল ইত্যাদি। এমনকি এভাবেও সবার কাছে দেওয়ার মতো যথেষ্ট জিনিস ছিল না তাই দুজন তার বড় কোটটি ভাগাভাগি করে বহন করছিল—একজন হাতা ধরে অন্যজন নিচের দিক ধরে, যেন এটি একটি স্ট্রেচার।

"এগুলো নামাও," স্মিথ বললেন, এবং তারা তা-ই করল।

"এখন," তিনি যোগ করলেন, "প্রাণ নিয়ে পালাও; আমি শুনতে পেয়েছি দুটি আফ্রিত উপরে আলোচনা করছিল যে, যদি কেউ রাতের বেলা তাদের পবিত্র স্থানে এসে শান্তি ভঙ্গ করে তাহলে তারা তাদের দেবতাদের অপমানের শাস্তি দেবে।"

এই সদয় পরামর্শটি অত্যন্ত আগ্রহের সাথে গৃহীত হলো। এক মিনিটের মধ্যেই স্মিথ নক্ষত্রখচিত আকাশ ও মরুভূমির মৃদু বাতাসের সাথে একা হয়ে পড়লেন।

স্মিথ তার প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র বড় কোটের পকেটে ভরে সমাধির মুখে ফিরে এলেন। এখানে তিনি লন্ঠনের আলোয় সামান্য খাবার খেয়ে ঘুমানোর চেষ্টা করলেন। কিন্তু ঘুমাতে পারলেন না। কোন অদৃশ্য কারনে একের পর এক ঘুমে ব্যাঘাত ঘটতে লাগল। প্রথমে শেয়ালের ডাক, তারপর একটি স্যান্ড ফ্লাই তার গোড়ালিতে এমন তীব্রভাবে কামড় দিল যে তিনি ভাবলেন নিশ্চয়ই বিছায় কামড়েছে। তারপর গরম কোট পরা সত্ত্বেও ঠান্ডা লাগতে শুরু করল কারণ ভেতরের পোশাক ঘামে ভিজে গিয়েছিল। তিনি বুঝতে পারলেন কিছু না করলে হয়তো জ্বর বা ঠাণ্ডা লেগে যাবে।

তিনি উঠে পায়চারি করতে লাগলেন।

ততক্ষণে চাঁদ উঠে গেছে। যার আলো মরুভূমির সমস্ত বিষাদময় ও বন্য দৃশ্য স্পষ্ট করে তুলছে। মিশরের রহস্য তার হৃদয়ে প্রবেশ করে তাকে আচ্ছন্ন করে ফেলল। যে পাহাড়ের উপর তিনি দাঁড়িয়ে ছিলেন সেখানে কত মৃত মহিমা শায়িত আছে? তিনি ভাবলেন, তারা কি সত্যিই সবাই মৃত নাকি সেই শ্রমিকদের কথাই ঠিক? তাদের আত্মারা কি এখনো রাতে বেরিয়ে এসে ঘুরে বেড়ায় যেখানে তারা একসময় শাসন করত? মিশরীয় বিশ্বাস অনুযায়ী, 'কা' বা আত্মা চিরকাল সেই স্থানেই ঘুরে বেড়ায় যেখানে তার মরণশীল দেহ সমাহিত আছে। তবু মিশরীয় বিশ্বাসে এমন কিছু আছে যা খ্রিস্টান হিসেবে অবিশ্বাস করা কঠিন।

উদাহরণস্বরূপ, মুক্তিদাতার মাধ্যমে পরিত্রাণ অথবা দেহের পুনরুত্থান। স্মিথ কি ইতিমধ্যেই এই মিলগুলো নিয়ে একটি গ্রন্থ রচনা করেননি যা তিনি একদিন নিজের নামে নয় বরং অন্য নামে প্রকাশ করার প্রস্তাব করেছিলেন? কিন্তু এখন এসব ভাবার সময় নয়; পরিস্থিতি একদমই উপযুক্ত নয়—এসব চিন্তা খুবই তীব্রভাবে আঘাত করে এমন একজন মানুষকে যে কিনা এই মুহূর্তে একটি সমাধি লুণ্ঠনের কাজে ব্যস্ত!

স্মিথের মন তথা তার কল্পনাশক্তি এক নতুন দিকে ছুটে চলল। হাজার হাজার বছর আগে এই স্থানটিতে কি ঘটেছিল? একদা হাজার বছর পূর্বে একটি শোভাযাত্রা বর্তমানে বালির নিচে চাপা পড়ে যাওয়া সেই রাস্তা বেয়ে এই সমাধির অন্ধকার প্রবেশপথের দিকে এগিয়ে গিয়েছিল। পাথরের ফাঁক দিয়ে ভেতরে বাইরে চলাচলকারী সেই শোভাযাত্রাটি তিনি স্পষ্ট দেখতে পেলেন। সাদা আলখাল্লা কিংবা চিতা বাঘের চামড়া পরিহিত মাথা কামানো পুরোহিতেরা তাদের রহস্যময় প্রতীকসমূহ হাতে নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছিল। ষাঁড়ে টানা শবযাত্রার রথ তার উপর বিশাল আয়তাকার কাঠের বাক্স যার ভেতরে কফিন আর তাতে মোড়া কোনো মৃত রানির মমি (মিশরীয় রীতিতে যে বাজপাখি ডানা মেলে মৃত্যুর দেবতা ওসাইরিসের কোলে উড়ে গেছে)। পিছনে শোকাহত পরিবারের ক্রন্দনে বাতাস বিদীর্ণ হচ্ছে। তারপর শেষকৃত্যের উপকরণ ও নৈবেদ্য বহনকারীরা হাঁটছে। তাদের পেছনে রাষ্ট্রের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা ও আমেনসহ অন্যান্য দেবতাদের প্রধান পুরোহিতগণ। তারপর রাজার অন্য সকল রানীরা কৌতূহলী কয়েকজন শিশুকে হাত ধরে নিয়ে হাঁটছে। তাদের পেছনে ফারাওয়ের পুত্রগণ তাদের পদমর্যাদার প্রতীকসহ হাঁটছে।

সবশেষে একা হেঁটে চলেছেন ফারাও নিজে তার আনুষ্ঠানিক পোশাকে। তার অ্যাপ্রন, সোনালি সাপ দিয়ে সজ্জিত তার লিনেনের মুকুট, তার খোদাই করা ব্রেসলেট এবং তার ভারী ঝনঝনে কানের দুল যা চলার সময় টুংটাং শব্দ করে। ফারাও তার নতমস্তক ও ক্লান্ত পায়ে এগিয়ে চলেছেন আর তার হৃদয়ে কী ভাবনা চলছে? হয়তো তার চলে যাওয়া রানীর জন্য দুঃখ। তবুও তার আরও অগণিত রানি ও সুন্দরী রক্ষিতা ছিল। নিঃসন্দেহে যে চলে গেছে সে মিষ্টি ও সুন্দরী ছিল কিন্তু মাধুর্য ও সৌন্দর্য কেবল তার একারই ছিল না। বরং সে তো ফারাওয়ের ইচ্ছাকে অমান্য করত, তার দেবত্বে সন্দেহ করত! না, নিশ্চয়ই ফারাও শুধু তাকে নিয়ে ভাবছেন না যার জন্য তিনি এই চমৎকার সমাধি প্রস্তুত করেছিলেন দেবতাদের সাথে তাকে মিলিয়ে দেওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় সব কিছু দিয়ে। নিশ্চয়ই তিনি নিজের কথাও ভাবছেন এবং পাহাড়ের ওপারে সেই সমাধির কথাও যেখানে শিল্পীরা বহু বছর ধরে কাজ করছে। সেই সমাধির দিকে তো তাকেও একদিন যাত্রা করতে হবে ঠিক এমনিভাবে—মৃত্যুর দরজা পেরিয়ে সেই স্থানে পৌঁছাতে হবে যেখানে রাজা-রানী-দাস-দাসী সবার জন্য মৃত্যুর হাত সমানভাবে প্রসারিত।

কল্পনার ঝলক মিলিয়ে গেল। এটা এতটাই বাস্তব মনে হচ্ছিল যে স্মিথ ভাবলেন তিনি স্বপ্ন দেখছিলেন। কিন্তু এখন তিনি সম্পূর্ণ জেগে আছেন এবং আগের চেয়েও বেশি ঠাণ্ডা লাগছে। উপরন্তু শেয়ালের সংখ্যা বেড়ে গেছে। একদল শেয়াল কাছাকাছিই ঘুরাঘুরি করছে। এইতো একটি হলদে শেয়াল লন্ঠনের আলোর গণ্ডির মধ্যে দিয়ে ঘেঁষে গেল সম্ভবত সে খাবারের গন্ধ পাচ্ছিল। অথবা হয়তো স্মিথের নিজের গন্ধ পেয়েছে। এছাড়াও এই পাহাড়গুলোতে খারাপ লোকজনও ঘোরাফেরা করে আর তিনি এখন একা এবং সম্পূর্ণ নিরস্ত্র। হয়তো লন্ঠনের আলো নিভিয়ে দেওয়া উচিত যা তার অবস্থান জানান দিচ্ছে। এটা বুদ্ধিমানের কাজ হবে কিন্তু এবার তিনি এই বুদ্ধি প্রত্যাখ্যান করলেন। শেষমেশ এই আলোই তো তার একমাত্র সঙ্গী।

ঘুম আসবে না বুজতে পেরে তিনি তার শরীরে উষ্ণতা আনবে এমন একটি কাজে মনোনিবেশ করার কথা ভাবলেন। বেলচা হাতে নিয়ে তিনি সমাধির প্রবেশপথে খুঁড়তে শুরু করলেন আর আশ্চর্য হয়ে শেয়ালের দল আরও জোরে চেঁচাতে লাগল। তারা এমন দৃশ্য দেখতে অভ্যস্ত নয়। হাজার হাজার বছর ধরে কোনো মানুষ—অন্তত একা কোনো মানুষ এমন অসময়ে সমাধি লুট করার সাহস করেনি। প্রায় বিশ মিনিট ধরে খনন করার পর তার বেলচায় কিছু একটা ধাতব শব্দ করল নিস্তব্ধতায় যেটা খুবই জোরালো শোনালো।

"একটা পাথর যা হয়তো শেয়াল তাড়ানোর কাজে লাগবে," তিনি ভাবলেন, ধীরে ধীরে বেলচা থেকে বালি ঝেড়ে ফেলতে লাগলেন যতক্ষণ না বস্তুটি দেখা গেল। এটা খুব বড় নয় তবু তিনি সেটি তুলে নিলেন এবং হাতে ঘষে ময়লা পরিষ্কার করলেন। যখন হাত খুললেন, দেখলেন এটি পাথর নয়—বরং একটি ব্রোঞ্জের মূর্তি।

"ওসাইরিস," স্মিথ ভাবলেন, "সমাধির সামনে পুঁতে রাখা হয়েছে জায়গাটিকে পবিত্র করার জন্য। না, আইসিস দেবী। না, আসলে এটি একটি চমৎকার ছোট মূর্তির মাথা অন্তত চাঁদের আলোতে তো তাই মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছে সোনার প্রলেপ দেওয়া ছিল।" লন্ঠনটা হাতে নিয়ে তিনি বস্তুটির উপর আলো ফেললেন। পরের মুহূর্তেই তিনি এক হাতে লন্ঠন আর অপর হাতে মূর্তির মাথাটি ধরে গর্তের তলায় বসে পড়লেন।

"মুখোশের রানি!" তিনি হাঁপাতে হাঁপাতে বলে উঠলেন, "এটাই-একই রকম! হায় আল্লাহ, ঠিক একই রকম!"

ওহ, ভুল হওয়া সম্ভব ছিল না। এইতো পুরু ঠোঁট, হুবহু চওড়া নাকের ছিদ্র, বাঁকানো ভ্রু ও সমান দূরত্বে অবস্থিত সপ্নিল চোখগুলো। সর্বোপরি একই মায়াবী ও রহস্যময় হাসি। তবে এই প্রাচীন শিল্পকর্মটির মাথায় ছিল ইউরিয়াসের একটি পূর্ণ মুকুট। মুকুটের নিচে এবং কানের পিছনে চেপে বসানো ছিল একটি সম্পূর্ণ উইগ বা রাজকীয় শিরস্ত্রাণ যার প্রান্তগুলো বুক পর্যন্ত নেমে এসেছে। সোনার প্রলেপ দেয়া ছোট মূর্তিটি ঠিক মাঝ বরাবর ভাঙা। সম্ভবত জোরে আঘাতের ফলে এমনটি ঘটেছে কারণ ভাঙার দাগটি ছিল খুব স্পষ্ট।

স্মিথের মনে হলো কোনো চোর এটি সমাধি থেকে সোনার তৈরি ভেবে চুরি করেছিল। সমাধির বাইরে এসে সন্দেহ হলে সে এটি পাথরে আঘাত করে ভেঙে ফেলেছিল। ভাঙ্গার পর স্পষ্ট বুঝতে পেরেছিল যে এটি শুধু সোনার প্রলেপ দেওয়া ব্রোঞ্জ, তাই টুকরোগুলো ফেলে দিয়েছিল। স্মিথ প্রথমে অন্য অংশটি খুঁজতে লাগলেন। অনেকক্ষণ খোঁজার পরও সাফল্য মেলেনি। তখন বা পরে কখনও এটি পাওয়া যায়নি। তার ধারণা চোরটি নিচের অংশটি হাতে রেখে বিরক্তিতে দূরে ছুঁড়ে মেরেছিল আর মাথাটি যেখানে পড়েছিল সেখানেই রেখে গিয়েছিল।

আবার স্মিথ মাথাটি পরীক্ষা করলেন, এবার আরও গভীরভাবে। এবার তিনি দেখতে পেলেন বুকের ঠিক নিচে একটি সূক্ষ্মভাবে খোদাই করা কার্তুজ রয়েছে।

হায়ারোগ্লিফিক্সে এখন দক্ষ হয়ে উঠেছেন স্মিথ। তাই কার্তুজটি পড়তে তার কোনো সমস্যা হলো না। এতে লেখা ছিল: "মা-মি, রাজকীয় মহান রমণী। প্রিয়——" এখানে কার্তুজটি ভাঙা ছিল। তাই তিনি আর পড়তে পারলেন না।

"মা-মে, অথবা এটা মা-মি হতে পারে," তিনি ভাবলেন। "ইতিহাসে আমি 'মা-মে', বা 'মা-মি', বা 'মা-মু' নামের কোনো রানীর কথা শুনিনি। ইতিহাসের জন্য এ একেবারেই নতুন নাম। আমি অবাক হচ্ছি তিনি কার প্রিয় ছিলেন-কে তাকে ভালোবাসতো? স্মিথ বিড়বিড় করলেন। সম্ভবত আমেন, বা হোরাস, বা আইসিস। নিশ্চয়ই কোনো দেবতার প্রিয় ছিলেন, এই ব্যাপারে আমার কোনো সন্দেহ নেই!"

তিনি হাতে থাকা সুন্দর মুখাবয়বের দিকে তাকিয়ে রইলেন ঠিক যেমনটি একদা তিনি মিউজিয়ামের দেয়ালে ঝোলানো প্রতিকৃতির দিকে তাকিয়েছিলেন। গম্ভীর চাঁদের আলোয় হাজারো বছরের জমে থাকে ধুলো বালির নিচ থেকে বেরিয়ে আসা সেই সুন্দর প্রতিকৃতিটি স্মিথের দিকে তাকিয়ে সেখানে হাসল যেমনটা একবার মিউজিয়ামের দেয়াল থেকে প্রতিকৃতি হেসেছিল। তবে সেটি ছিল নকল, আর এটি আসল। এটা সেই মৃতের সাথে ঘুমিয়েছিল যার মুখাবয়ব এতে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে যে মৃতদেহ এখানে বা একসময় এখানে শায়িত ছিল।

স্মিথ হঠাৎ এক দৃঢ় সিদ্ধান্ত নিলেন। তিনি এখনই সম্পূর্ণ একাকী এই সমাধির ভেতরে প্রবেশ করবেন। প্রথমবারের মতো এই সমাধিতে তিনিই সর্বপ্রথম প্রবেশ করবেন যদিও এটা হবে এক ধরনের ধর্মদ্রোহিতা।

কেন প্রবেশ করবেন না? যেহেতু তার লন্ঠনটি বেশ উজ্জ্বল ও দীর্ঘক্ষণ জ্বলবে। তদুপরি তারা যে গর্তটি পরিষ্কার করেছিল তার ফোঁকর দিয়ে ইতোমধ্যে বিষাক্ত বাতাস বেরিয়ে গেছে। সবশেষে মনে হলো কিছু একটা যেন তাকে ডাকছে। স্মিথ ব্রোঞ্জের মাথাটি বুক পকেটে রেখে লন্ঠন নিয়ে ফাঁক দিয়ে নিচে উঁকি দিলেন। বালি জমে প্রবেশপথ প্রায় ভরাট ছিল তাই নিচে নামতে সমস্যা হলো না। ভেতরে ঢুকে দেখলেন বালি ও কাদামাটিতে প্রায় ভরাট হয়ে আছে সমাধিপথ।

মাহমুদ ঠিকই বলেছিল। এই শিলাস্তরে তৈরি সমাধিটি নিশ্চয়ই বন্যায় প্লাবিত হয়েছে। প্রাচীন কোনো বন্যায় এখানে কাদামাটি ঢুকেছে এবং শক্ত হয়ে গেছে। সমাধি তৈরি করার সময়ই সম্ভবত এটা হিসাব করে নিচে একটি গর্ত রাখা হয়েছিল যাতে কাদা ঢুকে সমাধিপথ বন্ধ হয়ে যেতে পারে। কিন্তু হিসাবের ভুলে কাদার স্তর সমাধির ছাদ পর্যন্ত পৌঁছায়নি তাই সমাধিটি এখনও খোলা রয়ে গেছে।

প্রায় চল্লিশ ফুট শক্ত কাদার উপর দিয়ে হামাগুড়ি দেবার পর স্মিথ হঠাৎ একটি উঁচু সিঁড়ির গোঁড়ায় পৌঁছালেন। তখনই তিনি ব্যাপারটি বুঝতে পারলেন—সমাধিটি আসলে আরও উঁচু স্তরে অবস্থিত।

এখান থেকেই শুরু হয়েছিল দেয়ালচিত্র। রানী মা-মি'কে তার মুকুট ও স্বচ্ছ পোশাকে সজ্জিত করে বিভিন্ন দেবতার সামনে উপস্থাপন করা হয়েছে। দেবতা ও রানীর মূর্তির মধ্যবর্তী স্থান হায়ারোগ্লিফিক্সে পূর্ণ, যা আজও ততটাই স্পষ্ট যেন শিল্পী সেগুলো এইমাত্র এঁকেছে। এক নজরেই তিনি বুঝলেন এগুলো "বুক অফ দ্য ডেড" থেকে নেওয়া অংশ।

সম্ভবত দাফনের অল্প কিছুদিন পরেই সেই চোর সমাধিতে ঢুকেছিল। তখন এই কাদা এখনকার মতো শক্ত হয়নি। সিঁড়িতে তার পায়ের ছাপ ও দেয়ালে হাতের দাগ থেকে এটা বোঝা যায়। দুষ্ট চোর নিশ্চয়ই কাঁদা থেকে উঠে দেয়ালের উপর ভর দিয়ে দাঁড়িয়েছিল যার ফলে তার হাতের ছাপ চিত্রগুলোয় দাগ ফেলেছিল। এক জায়গায় তার হাতের পুরো ছাপ এমনকি ত্বকের রেখাগুলোও দেখা যাচ্ছিলো!

সিঁড়ির ধাপগুলোর শীর্ষে আরেকটি করিডোর শুরু হয়েছে যা কখনও পানিতে প্লাবিত হয়নি। ডান-বামে অসমাপ্ত কক্ষগুলো দেখে বোঝা যায় রানী অল্প বয়সেই মারা গিয়েছিলেন। রানীর বা রাজার পরিকল্পনা অনুযায়ী তৈরি করা সমাধিটির ডিজাইন অসমাপ্তই রয়ে গেছে। কয়েক পা এগুতেই করিডোরটি প্রায় ত্রিশ ফুট বর্গাকার একটি হলঘরে পরিণত হলো। ছাদটি দানা ছড়ানো ও শিকলে ঝোলানো শকুনের চিত্র দিয়ে সজ্জিত ছিল। এক দেয়ালে রানী মা-মি'কে দেখা যাচ্ছে আনুবিসের দাঁড়িপাল্লায় তার হৃদয় ও সত্যের পালক ওজন করতে আর লিপিকার থোথ ফলাফল লিপিবদ্ধ করছেন। রানীর সব উপাধি এখানে উল্লেখ করা হয়েছে। যেমন-

"মহান রাজকীয় উত্তরাধিকারী"
"রাজকীয় বোন"
"রাজকীয় পত্নী"
"রাজকীয় মা"
"দুই ভূমির কর্ত্রী"
"অসীম সুন্দরী" ইত্যাদি।

স্মিথ লক্ষ্য করলেন কোথাও তার স্বামী রাজার নাম উল্লেখ নেই। মনে হচ্ছে ইচ্ছাকৃতভাবে এটি বাদ দেওয়া হয়েছে। অন্যান্য দেয়ালে মা-মি ও তার 'কা' (আত্মা) বিভিন্ন দেবতাকে নৈবেদ্য দিচ্ছেন বা পাতালের ভয়ঙ্কর দানবদের শান্ত করছেন। তাদের নাম উচ্চারণ করে বাধ্য করছেন বলতে: "এগিয়ে যাও। তুমি পবিত্র!"

অবশেষে শেষ দেয়ালে তার সব পরীক্ষা শেষ হওয়ার পর বিজয়ী রূপে দণ্ডায়মান যেখানে ওসাইরিস তাকে স্বাগত জানাচ্ছেন অথবা বলা ভালো তার আত্মাকে গ্রহন করছেন।

লন্ঠন দোলাতে দোলাতে স্মিথ সবকিছু দ্রুত পর্যবেক্ষণ করলেন। হঠাৎ তার চোখ পড়ল আরেকটি ভয়াবহ দৃশ্যের দিকে। সমাধিকক্ষের মেঝেতে কফিন থাকার জায়গায় কয়লার মতো কালো কিছু টুকরো ছড়িয়ে আছে। সঙ্গে সঙ্গে তিনি বুঝতে পারলেন চোর তার কাজ শেষ করে মমিকেস সহ রানীর দেহটিও পুড়িয়ে ফেলেছে। এতে কোনো সন্দেহ নেই কারণ ছাইয়ের মধ্যে কিছু পোড়া হাড় পড়ে আছে আর ছাদ পর্যন্ত ধোঁয়ায় কালো ও আগুনের তাপে ফেটে গেছে। তার আবিষ্কারের জন্য এখানে আর কিছুই অবশিষ্ট রইল না।

গুমোট আবহাওয়ায় ক্লান্ত হয়ে তিনি পাথরে খোদাই করা একটি ছোট বেঞ্চ বা টেবিলের উপর বসলেন যেখানে মৃতের জন্য নৈবেদ্য রাখা হতো। সেখানে এখনও কিছু পোড়া ফুলের অবশেষ পড়ে আছে। পায়ের নিচে লন্ঠন রেখে তিনি কিছুক্ষণ বসে সেই পোড়া হাড়গুলোর দিকে তাকিয়ে রইলেন। ওইতো নিচের চোয়াল আর তাতে কিছু ছোট, সাদা, সুবিন্যস্ত ও কম ক্ষয়প্রাপ্ত দাঁত। হ্যাঁ, রানী অল্প বয়সেই মারা গিয়েছিলেন। হতাশা এবং স্থানটির পবিত্রতা স্মিথকে আচ্ছন্ন করেছিল। তিনি আর সেখানে থাকতে পারলেন না। লন্ঠন দুলিয়ে সমাধিকক্ষ ছেড়ে তিনি রঙিন চিত্রযুক্ত করিডোর ধরে ফিরতে লাগলেন। চিত্রগুলো আগামীকাল লিপিবদ্ধ করতে হবে।

তিনি সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামলেন। কাদার ঢালের নিচে পৌঁছাতেই তার চোখ পড়ল বালির মধ্যে আটকে থাকা একটি বেতের বাক্সের দিকে। বালি সরাতেই দেখা গেল আসলেই এটি একটি বাক্স। প্রায় এক ফুট লম্বা। প্রাচীন মিশরীয়রা যাতে উশাবতি মূর্তি বা মৃতের সাথে সম্পর্কিত অন্যান্য জিনিস রাখত। মনে হচ্ছিল এটি পড়ে গিয়েছিল কারণ এটি একপাশে কাত হয়ে ছিল। আশাহত মনে স্মিথ এটি খুললেন কারণ এমন জায়গায় কোনো মূল্যবান জিনিস পড়ে থাকার কথা নয়।

প্রথমেই যে জিনিসটি তার চোখে পড়ল সেটি ছিল একটি মমিকৃত হাত, কব্জি থেকে ভাঙা। এটি ছিল অক্ষত অবয়বের একটি নারীর ছোট হাত—অত্যন্ত সুগঠিত, শুকনো ও কাগজের মতো সাদা। লম্বা আঙুলগুলো সম্পূর্ণ নিখুঁত ছিল। মমিকরণের রীতি অনুযায়ী বাদাম আকৃতির নখগুলো মেহেদি দিয়ে রাঙানো ছিল। হাতে ছিল দুটি সোনার আংটি। এই আংটিগুলোর জন্যই হাতটি চুরি হয়েছিল কিন্তু শেষ পর্যন্ত ফেলে দেওয়া হয়েছিল (নিশ্চয়ই এর মধ্যে এমন কিছু ঘটেছিল যার ফলে চোর হাতটি ফেলে দিতে বাধ্য হয়েছিলো)।

স্মিথ দীর্ঘক্ষণ সেই হাতের দিকে তাকিয়ে রইলেন। তার হৃদয় ভরে উঠল—এই তো সেই স্বপ্নের রাজকীয় রমণীর হাত!

স্মিথ শুধু তাকিয়েই থাকেননি তিনি সেটাতে চুমু খেলেন। ঠোঁট স্পর্শ করার মুহূর্তেই তার মনে হলো একটি ঠাণ্ডা সুগন্ধি বাতাস তার কপাল স্পর্শ করলো। এই অদ্ভুত অনুভূতিতে ভীত হয়ে তিনি দ্রুত নিজেকে বাস্তবে ফিরিয়ে আনলেন এবং বাক্সটি পরীক্ষা করতে লাগলেন।

বাক্সের ভেতরে তিনি আরও কিছু জিনিস পেলেন যা রানীর দেহ থেকে ছেঁড়া মমি কাপড়ের টুকরো দিয়ে অগোছালোভাবে মোড়ানো ছিল। এই গয়নাগুলোর বিস্তারিত বর্ণনা দেওয়ার প্রয়োজন নেই কারণ সেগুলো এখন মিউজিয়ামের গোল্ড রুমে প্রদর্শিত হচ্ছে।

যার লেবেলে লেখা আছে: "রানী মা-মি'র গয়না, ১৮তম রাজবংশ, থিবেস (স্মিথের সমাধি)"। তবে উল্লেখ্য এই সেটটি অসম্পূর্ণ ছিল। যেমন— ডালিম ফুলের গুচ্ছের মতো বিশাল আকৃতির সোনার কানের দুলের একটি মাত্রই ছিল যেখানে এক জোড়া থাকার কথা। এছাড়াও সবচেয়ে সুন্দর হারটি দু'ভাগে ছিঁড়ে গিয়েছিল যার অর্ধেক অংশই অনুপস্থিত।

স্মিথ বুঝতে পারলেন মমির সাথে সমাধিস্থ করা মূল্যবান বস্তুগুলোর মাত্র একটি অংশ এই বাক্সে রাখা হয়েছিল। তাহলে চোরটি কেন ফেলে গেল? একটু চিন্তা করতেই সেটাও স্পষ্ট হয়ে গেল। চোরটি সম্ভবত তার অপরাধ লুকানোর জন্য মমি ও কফিন পুড়িয়ে ফেলেছিল কিন্তু ভুলে গিয়েছিল যে মমি এবং তাদের পোশাক কতটা দ্রুত পুড়তে পারে অথবা তার লন্ঠন থেকে দুর্ঘটনাবশত আগুন লেগে গিয়েছিল। ধোঁয়ায় শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থায় চোর কাদার পিচ্ছিল ঢাল বেয়ে পালানোর চেষ্টা করেছিল। তাড়াহুড়োয় সে বাক্সটি ফেলে যায় কিন্তু ফিরে তা নেওয়ার সাহস পায়নি। ভেবেছিল পরদিন আগুন নিভে গেলে এবং বাতাস বিশুদ্ধ হলে ফিরে এসে নিয়ে যাবে—কিন্তু সেই পরদিন কখনও আসেনি।

যখন স্মিথ সমাধি থেকে বেরিয়ে এলেন তখন ভোরের আলোয় তারাগুলো ম্লান হয়ে আসছিল। এক ঘণ্টা পর সূর্য পুরোপুরি উঠে গেলে মাহমুদ (হঠাৎ তার অসুস্থতা সেরে গিয়েছিল) এবং অন্যান্য শ্রমিকরা হাজির হল।

শ্রমিকদের ভাঙা ব্রোঞ্জের মূর্তিটি আর মমিকৃত হাতটি দেখিয়ে স্মিথ বললেন "তোমরা ঘুমাচ্ছিলে আর আমি ব্যস্ত ছিলাম"। যদিও স্মিথ আঙুল থেকে আংটিগুলো ইতোমধ্যে খুলে নিয়েছেন এবং তার পকেটে লুকানো অমূল্য গয়নাগুলোর কথাও তিনি তাদের বলেননি।

পরবর্তী দশ দিন তারা অবিরত খনন কাজ চালিয়ে সমাধি ও তার প্রবেশপথ সম্পূর্ণ পরিষ্কার করে ফেলল। সিঁড়ির ধাপগুলোর মাথার কাছে তারা এক ব্যক্তির কঙ্কাল পেল যাকে স্পষ্টতই তাড়াহুড়োয় সমাহিত করা হয়েছিল। কপালে কুঠারের আঘাতের চিহ্ন আর মাথার খুলিতে লেগে থাকা চুল থেকে বোঝা গেল সে সম্ভবত একজন পুরোহিত ছিল।

মাহমুদের ধারণা যা স্মিথও সমর্থন করলেন "এটিই সেই চোর।" সে যখন পালাচ্ছিল তখন সমাধিস্থলের প্রহরীরা তাকে ধরে ফেলে। সে প্রবেশের ফাঁকাটি ঢেকে রেখেছিল যাতে পরে ফিরে আসতে পারে। প্রহরীরা তাকে বিচার ছাড়াই হত্যা করে ও লুটের মাল নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নেয়। অথবা তার সঙ্গীরাই তাকে মেরে ফেলেছিল। মাহমুদের এই তত্ত্ব সঠিক কি না তা কেউই নিশ্চিত করে বলতে পারবে না। হয়তো কঙ্কালটি চোরের নয় কিন্তু সম্ভাবনা বিপরীত দিকেই ইঙ্গিত করে।

সমাধিতে আর কিছুই পাওয়া গেল না এমনকি একটি মমির পুঁতিও নয়। স্মিথ বাকি সময় কাটালেন দেয়ালচিত্রের ছবি তোলা ও শিলালিপিগুলো নকল করে যা নানান কারণে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল। শেষে রানীর পোড়া হাড়গুলি সমাধির একটি গোপন স্থানে সমাহিত করে তিনি স্থানীয় প্রত্নতত্ত্ব রক্ষককে দায়িত্ব বুঝিয়ে দিলেন। মাহমুদ ও শ্রমিকদের মজুরি দিয়ে তিনি কায়রোর উদ্দেশে রওনা হলেন। তার সাথে ছিল সেই অমূল্য গয়নাগুলো যার কথা তিনি কাউকে জানাননি এবং আরও একটি অনন্য নিদর্শন—রানী মা-মি'র সেই হাত যা তার কাছে ছিল সবচেয়ে মূল্যবান।



পর্বঃ তিন

_______________________________________

স্মিথ কায়রোর নতুন জাদুঘরের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের প্রখ্যাত পরিচালকের ব্যক্তিগত কক্ষে বসে ছিলেন। ঘরটা ছিল খুবই আকর্ষণীয়। মেঝেতে বইয়ের স্তূপ, এখানে-ওখানে ছড়িয়ে আছে সমাধি থেকে আনা নানান জিনিসপত্র। টেবিলের ওপর আছে আলেকজান্দ্রিয়া থেকে সদ্য খুঁজে পাওয়া টলেমীয় যুগের রূপার কয়েন—যেগুলো দু'হাজার বছর ধরে একটি মাটির পাত্রে লুকানো ছিল। ঘরের এক কোণে সম্প্রতি আবিষ্কৃত ছয় বা সাত বছর বয়সী এক রাজকুমারীর মমি রাখা যার কাপড়ে কিছু শিলালিপি আঁকা রয়েছে। আর মমির কাপড়ের গোলাপি বাঁধনের নিচে ঠাঁই পেয়েছে ভালোবাসার শেষ উপহার—শুকিয়ে যাওয়া একটি পদ্মফুল।

"কী স্পর্শকাতর জিনিস," স্মিথ মনে মনে ভাবলেন। "আসলে, ছোট্ট মেয়েটিকে শান্তিতে থাকতে দিলেই পারত।"

কোমল হৃদয়ের স্মিথ এটা ভাবতে ভাবতেই তিনি টের পেলেন তার ওয়েস্টকোটের ভেতরের পকেটে লুকানো গয়নাগুলো তার গায়ে খচখচ করছে। তার বিবেকটাও ছিল নরম।

ঠিক তখনই পরিচালক ঘরে ঢুকলেন। ভদ্রলোক একজন ফরাসি পণ্ডিত—চনমনে, প্রাণবন্ত ও কৌতূহলী।

"আহ, প্রিয় মিস্টার স্মিথ!" চমৎকার ইংরেজিতে বললেন তিনি। "আপনাকে আবার দেখে সত্যিই খুব ভালো লাগছে। বিশেষ করে যখন শুনেছি আপনি এবার খুব খুশি মনে ফিরেছেন এবং অনেক সাফল্য নিয়ে এসেছেন। তারা বলছে আপনি একজন রানীর সমাধি খুঁজে পেয়েছেন।

আচ্ছা তার নাম কী—মা-মি? বেশ অদ্ভুত নাম।
বাড়তি স্বরবর্ণটা কোথা থেকে এল?
শব্দটা সুন্দর শোনানোর জন্য?
আপনি যে কত বড় পণ্ডিত সেটা না জানলে তো ভাবতাম হয়তো নামটা ভুল পড়েছেন।
মে-মি, মা-মি! ফরাসিতে তো বেশ মিষ্টি শোনায়, তাই না?
"মা মি"—মানে "আমার প্রিয়"। হয়তো তার সময়ে সে কারও প্রিয়ই ছিল। যাক, এবার গল্পটা বলুন তো।

স্মিথ তাকে সংক্ষেপে ও পরিষ্কারভাবে পুরো ঘটনা বললেন; এছাড়াও তিনি তার তোলা ছবি এবং শিলালিপির অনুলিপিগুলো বের করে দেখালেন।

ছবি ও নথিগুলো দেখার পর পরিচালক বললেন "সত্যিই চমৎকার—অত্যন্ত আকর্ষণীয়"।

"আপনি এগুলো আমার কাছে রেখে যাবেন আমি সময় নিয়ে দেখব।
আর আপনি নিশ্চয়ই এগুলো প্রকাশ করবেন, তাই না?
হয়তো কোনও সোসাইটি খরচ বহনে সাহায্য করবে কারণ এগুলো প্রতিলিপি আকারে প্রকাশ করা উচিত। এই ভিগনেটটা দেখুন! খুব অদ্ভুত। ওহ, কী দুর্ভাগ্য সেই বদমাশ পুরোহিত গয়নাগুলো নিয়ে পালিয়েছে আর রানীর দেহ পুড়িয়ে ফেলেছে!"

"সে সব গয়না নিয়ে পালাতে পারেনি।" স্মিথ ঘোষণা করলেন।

"কী বলছেন, মিস্টার স্মিথ? আমাদের পরিদর্শক আমাকে জানিয়েছিল আপনি কিছুই পাননি।"

"হয়তো, স্যার; কিন্তু আপনার পরিদর্শক জানত না আমি কী পেয়েছি।"

"আহা, আপনি তো বেশ বিচক্ষণ মানুষ! তাহলে দেখা যাক।"

স্মিথ ধীরে ধীরে তার ওয়েস্টকোটের বোতাম খুলে ফেললেন। ভেতরের পকেট ও শরীরের অন্যান্য জায়গা থেকে মমির কাপড়ে মোড়ানো গয়নাগুলো বের করলেন—ঠিক যেভাবে তিনি সেগুলো পেয়েছিলেন।

প্রথমে তিনি ডালিমের আকৃতির সোনার একটি রাজদণ্ডের মাথা বের করলেন। এর উপর রানি মা-মি'র সিংহাসন নাম এবং উপাধি খোদাই করা আছে।

"কী সুন্দর বস্তু!" পরিচালক বললেন।
"দেখুন! হাতলটি হাতির দাঁতের ছিল আর সেই চোর পুরোহিত সেটি সকেট থেকে ভেঙে নিয়েছে। তখন হাতলটি নতুন ছিল; মূলত লুটপাট কবর দেওয়ার অল্পকাল পরেই ঘটেছে।
দেখুন, এই ম্যাগনিফাইং গ্লাসে এটা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। আর কিছু আছে?”

স্মিথ তার হাতে সেই অসাধারণ হারটির অবশিষ্ট অর্ধেকটি তুলে দিলেন যা দুইভাগে ছিঁড়ে গিয়েছিল।

"আমি এটি আবার সুতোয় গেঁথেছি," তিনি ফিসফিস করে বললেন, "কিন্তু প্রতিটি পুঁতি ঠিক তার জায়গায় আছে।"

"ওহ, হায় আল্লাহ! কী সুন্দর! হাথরের কর্নেলিয়ানের মাথাগুলোর কারুকার্য আর মাঝের সোনার পদ্মফুলগুলো দেখুন–হ্যাঁ, আর নিচে এনামেল করা মাছিরাও আছে। আমাদের জাদুঘরে এর মতো কিছুই নেই।"

"আর কিছুকি আছে?" অবশেষে পরিচালক হাঁপাতে হাঁপাতে জিজ্ঞেস করলেন। ঝুড়ির সমস্ত জিনিস টেবিলের ওপর ঝলমল করছিল।

"হ্যাঁ," স্মিথ বললেন। আমি সমাধির বাইরে বালির মধ্যে একটি ভাঙা ছোট মূর্তি খুঁজে পেয়েছিলাম। রানীরই মূর্তি কিন্তু আমি ভেবেছিলাম হয়তো আপনি আমাকে এটা নিজের কাছে রাখতে দেবেন।"

"অবশ্যই, মিস্টার স্মিথ; এটা আপনারই। আমরা এতটা লোভী নই।
তবুও, যদি আমি একবার দেখতে পেতাম——"

আরেকটি পকেট থেকে স্মিথ মূর্তির মাথাটি বের করলেন। পরিচালক একদৃষ্টে তাকিয়ে রইলেন, তারপর আবেগপ্রবণ হয়ে বললেন:

"আমি এইমাত্র বলেছিলাম আপনি বিচক্ষণ, মিস্টার স্মিথ, এবং আমি ভাবছিলাম আপনি সৎ। কিন্তু এখন আমি যোগ করতে বাধ্য হচ্ছি - আপনি অত্যন্ত চালাক। যদি আপনি আমাকে এই ব্রোঞ্জের মূর্তিটি আপনার বলে প্রতিশ্রুতি না করাতেন তাহলে এটা আর কখনোই আপনার পকেটে ফেরত যেত না। আর জনস্বার্থে আপনি কি আমাকে সেই প্রতিশ্রুতি থেকে মুক্তি দিতে পারবেন?"

"না," স্মিথ বললেন।

"আপনি সম্ভবত জানেন না" পরিচালক দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলতে লাগলেন, "এটি মারিয়েট এর সেই অজ্ঞাত রানীর প্রতিকৃতি যাকে আমরা এখন শনাক্ত করতে পেরেছি। দুটোকে আলাদা করাটা দুঃখজনক ব্যাপার হবে তাই আমরা আপনাকে একটি প্রতিরূপ দিতে পারি।"

"আমি ভালো করেই জানি," স্মিথ বললেন, "আর আমি অবশ্যই আপনাকে ছবিসহ নকলটি পাঠাবো। এছাড়াও আমি ইচ্ছাপত্রে আসলটি কোনও মিউজিয়ামে দান করার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি।"

পরিচালক সযত্নে মূর্তিটি জড়িয়ে ধরে আলোর দিকে তুলে ধরলেন এবং বুকের নিচে ভাঙা কার্তুজটি পড়লেন:

"মা-মি, রাজকীয় মহান রমণী। প্রিয়——"
কার প্রিয়? আচ্ছা, স্মিথের প্রিয় একজন।
নিন মশাই, দ্রুত লুকিয়ে ফেলুন।
আর ন্যায়ের খাতিরে যে মিউজিয়াম এটি পাবে তা যেন ব্রিটিশ না হয়ে কায়রোর হয় কারণ এই রানী মিশরের সম্পত্তি।
হ্যাঁ, আমি শুনেছি আপনার ফুসফুস দুর্বল। এখন আপনার স্বাস্থ্য কেমন?
আমাদের ঠাণ্ডা বাতাস খুব কষ্টদায়ক।
বেশ ভালো? আহ, চমৎকার!
আমার মনে হয় আপনার কাছে আর কোনো জিনিস নেই যা আমাকে দেখাতে পারেন!"

"গয়নার ঝুড়ির মধ্যে পাওয়া একটি মমি করা হাত ছাড়া আমার কাছে আর কিছুই নেই। এর থেকে দুটি আংটি খুলে নেয়া হয়েছে। হয়তো সেই ব্রেসলেটটা পাওয়ার জন্য হাতটা সরানো হয়েছিল। আমি ধারণা করছি হাতটি রাখলে আপনি কিছু মনে করবেন না——"

"স্মিথের প্রিয়তমার হাত," পরিচালক রসিকতা করে বললেন।
"না, আমার মনে হয় না যদিও আমি নিজে এতটা পুরোনো হাত পছন্দ করি না। তবুও বস্তুটি এক ঝলক দেখাতে হয়তো আপনি আপত্তি করবেন না। আপনার সেই পকেটটি এখনও কিছুটা ফোলা দেখাচ্ছে; আমি ভেবেছিলাম তাতে বই আছে!"

স্মিথ একটি সিগার বাক্স বের করলেন; তার মধ্যে তুলোয় মোড়ানো হাতটি ছিল।

"আহ," পরিচালক বললেন, "একটি সুন্দর, সুগঠিত হাত।
নিঃসন্দেহে এই মা-মি সিংহাসনের প্রকৃত উত্তরাধিকারী ছিলেন।
ফারাও সম্ভবত নিম্ন বংশের কেউ ছিলেন, হয়তো সৎভাই...
তাকে 'রাজকীয় বোন' বলা হয়েছে, আপনার মনে আছে নিশ্চয়ই...
সম্ভবত ফারাও কোনও দাসীর পুত্র হবে।
অদ্ভুত যে তিনি সমাধিতে তার কথা কখনো উল্লেখ করেননি। মনে হচ্ছে জীবনে তাদের বনিবনা ছিল না এবং মৃত্যুর পরেও তিনি তার থেকে মুক্তি পেতে চেয়েছিলেন।

এই হাতেই সেই আংটিগুলো ছিল, তাই না?"

তিনি আংটি দুটি আবার আঙুলে পরালেন, তারপর একটি খুলে নিলেন। এটা একটা কার্তুজ যার মধ্যে খোদাই করা রয়েছে রাজকীয় সিলমোহর। অন্য আংটিতে লিখা রয়েছে: 'বেস আংক, আংক বেস'—'বেস দ্য লিভিং, দ্য লিভিং বেস'।

"আপনার মা-মি'র মধ্যে কিছু মানবীয় অহংকার ছিল," তিনি যোগ করলেন। "যেমনটি আপনি জানেন, 'বেস' ছিলেন সৌন্দর্য ও নারীসজ্জার দেবতা। মা-মি এই আংটি পরতেন যাতে চিরসুন্দরী থাকতে পারেন। তার পোশাক যেন সবসময় মানানসই থাকে এবং দেবতাদের সামনে নাচার সময় তার গালের আভা যেন ম্লান না হয়ে যায়। মা-মি'র প্রিয় আংটিটি কেড়ে নেওয়া উচিত হবে না। আমাদের জন্য রাজকীয় সিলমোহরটাই যথেষ্ট।"

একটু মাথা নুইয়ে তিনি হাতটি স্মিথকে ফেরত দিলেন। বেস এর আংটিটি তখনো সেই আঙুলেই রয়ে গেল। তিন হাজার বছরেরও বেশি সময় ধরে আংটিটি এই একই আঙ্গুলে পরা ছিল। পরিচালক হাতটি ফেরত দেয়ার সময় স্মিথ এতটাই নিশ্চিত ছিলেন যে এটি বেসের আংটিটাই হবে যার ফলে তিনি সেই মুহূর্তে আর চেক করেন নি।

তারপর স্মিথ পরদিন ফিরে আসার প্রতিশ্রুতি দিয়ে বিদায় নিলেন—যদিও পরবর্তী ঘটনাবলীর কারণে তিনি এই প্রতিশ্রুতি রাখতে পারেননি। তিনি চলে যাওয়ার পর যখন দরজা বন্ধ হয়ে গেল তখন নিজের মনে পরিচালক বললেন, “আহ!” তিনি খুব তাড়াহুড়ো করে চলে গেলেন। মনে হচ্ছে আমি যেন সেই আংটি নিয়ে মত না বদলাই সেই ভয়ে আছেন। আর ব্রোঞ্জের মূর্তিটার কথাও তো আছে। মিস্টার স্মিথ এখানে বেশ চালাকি করেছেন। ওই ব্রোঞ্জের মূর্তিটার দাম হাজার পাউন্ড তো হবেই। তবে আমার বিশ্বাস টাকার কথা তার মাথায় ছিল না। আমার মনে হয় সে মা-মি'র প্রেমে পড়েছে আর তার ছবি নিজের কাছে রাখতে চায়। কঠিন প্রেম। তবুও, সে সৎ—আমি নিশ্চিত, একদম সৎ। আরে বাবা, চাইলে তো সব গয়নাই নিজের কাছে রাখতে পারত, কেউ কিচ্ছুটি জানত না। আর কি জিনিস! কী আবিষ্কার! সিয়েল! কত বড় আবিষ্কার! বহু বছর পর এমন জিনিস পাওয়া গেছে। অদ্ভুত স্মিথের মাথায় আশীর্বাদ বর্ষিত হোক!” এরপর তিনি মূল্যবান জিনিসগুলো একত্র করে নিজের সিন্দুকের ভেতরের আলাদা খোপে রেখে ডবল তালা দিলেন। ঘড়িতে তখন প্রায় পাঁচটা বাজে তাই আর বিলম্ব না করে জাদুঘর থেকে নিজের বাসভবনে চলে গেলেন। সেখানে স্মিথের নকল করা শিলালিপির কপি ও ছবি নিয়ে পড়াশোনা করতে হবে। তাছাড়া বন্ধুদেরকে এই অসাধারণ ঘটনাগুলোও তো বলতে হবে। স্মিথ দরজার বাইরে বৃদ্ধ প্রহরীকে পাঁচ পিয়াস্ট্রি বকশিশ দিলেন। তারপর ডানদিকে কয়েক কদম এগিয়ে দেখতে পেলেন কিছু স্থানীয় শ্রমিক অস্থায়ী ট্রামলাইনে বসিয়ে একটি বিশাল সারকোফেগাস টানছে। টানতে টানতে তারা গলা মিলিয়ে ছন্দে ছন্দে গান গাইছিল, যার প্রতিটি লাইন শেষ হতো আল্লাহর নামে। "ঠিক এভাবেই" স্মিথ ভাবলেন, হাজার হাজার বছর আগে তাদের পূর্বপুরুষরাও গান গেয়েছিল যখন তারা এই একই সারকোফেগাসটা খনির পাহাড় থেকে নীল নদের দিকে, আবার সেখান থেকে সমাধিতে টেনে নিয়ে গিয়েছিল—যেখান থেকে আজ আবার বের করা হয়েছে। কিংবা যখন তারা পিরামিডের পাথরের ব্লকগুলো বিশাল র‍্যাম্প আর মসৃণ বালির ঢালে গড়িয়ে তুলেছিল শুধু তখন শ্রমের সেই চিরন্তন গানের প্রতিটি লাইনের শেষে 'আমেন' এর নাম থাকত আর এখন সেখানে 'আল্লাহ' এর নাম স্থান দখল করেছে। প্রাচ্য তার শাসক আর দেবতা বদলালেও রীতিনীতিগুলো কখনোই বদলায় না! ভাবতে ভাবতে স্মিথ সেই সারকোফেগাস আর নীল পোশাক পরা কালো চামড়ার শ্রমিকদের পাশ কাটিয়ে হাজারো ভাস্কর্যে ভরা লম্বা করিডোর ধরে দ্রুত সরে গেলেন। পথিমধ্যে রানী আমেনার্তাসের অপূর্ব সাদা মূর্তির সামনে এক মুহূর্ত দাঁড়ালেন, তারপর মনে পড়ল হাতে সময় কম—তাড়াহুড়ো করে করিডোরের পাশের একটি নির্দিষ্ট কক্ষে ঢুকে পড়লেন। কক্ষটির এক কোণে দেয়ালের ওপর অনেক সুন্দর জিনিসের মাঝে ছিল সেই মাথাটি যা মারিয়েট খুঁজে পেয়েছিলেন আর ব্রিটিশ মিউজিয়ামে যার প্রতিরূপ দেখে স্মিথ বহু বছর আগেই মুগ্ধ হয়েছিলেন। এখন তিনি জানেন এটি কার মাথা; তারই সমাধি খুঁজে পাওয়ার সৌভাগ্য হয়েছে স্মিথের। এমনকি তার আসল হাত এখন স্মিথের পকেটে—হ্যাঁ, সেই হাত যা একদিন ওই মার্বেল ছুঁয়েছিল। ভাস্করকে তার ভুল দেখিয়ে দিচ্ছিল, হয়তো বলেছিল কিভাবে খোঁদাই করলে তাকে আরও বেশি সুন্দর দেখাবে। স্মিথ ভাবলেন, সেই ভাস্কর কে ছিলেন? নিশ্চয়ই তিনি খুব সুখী মানুষ ছিলেন। আবার ভাবলেন, ছোট মূর্তিটিও কি সেই শিল্পীরই কাজ? অবশ্য তার তাই মনে হচ্ছিল, তবে তিনি নিশ্চিত হতে চাইলেন। ঘরের একদম শেষে গিয়ে স্মিথ চোরের মতো চারপাশে তাকালেন। পুরো ঘরে তিনি একা; কোনো ছাত্র বা পর্যটক নেই, আর প্রহরীও যেন কোথাও চলে গেছে। তিনি মমির হাত রাখা বাক্সটি বের করলেন। ধীরস্থিরভাবে আঙ্গুল থেকে আংটিটি খুলে ফেললেন। যদিও সিলমোহরওয়ালা আংটিটা তার বেশি পছন্দ ছিল কিন্তু ব্রোঞ্জের মূর্তির ঘটনার পর সেটা তো আর চাওয়া যায় না। মমিকৃত হাতটা বাক্সে ভরে আবার পকেটে রেখে দিলেন। আশেপাশে দ্রুত একবার চোখ ভুলিয়ে দেখে নিলেন কেউ আছে কিনা। তারপর আংটিটা নিজের কনিষ্ঠ আঙ্গুলে পরে নিলেন যা একদম ঠিকঠাক ফিট হল। মা-মি দুটো আংটিই তার বাম হাতের মধ্যমায় পরতেন। স্মিথের মনে হলো মা-মি'র নিজের আংটি পরে তার মূর্তির সামনে দাঁড়ানো উচিত। এই মাত্রই তো মা-মির আংটি তার হাজার বছর পুরনো আঙ্গুল থেকে এখন স্মিথের আঙ্গুলে এসে পরেছে—এটাই কি কম অদ্ভুত ব্যাপার? মাথাটি আগের যায়গাতেই আছে। শেষবার এটি দেখার পর কয়েক সপ্তাহ কেটে গেছে আর এখন তার চোখে এটা আগের চেয়েও সুন্দর মনে হচ্ছে। উপরন্তু হাসিটা ছিল আরও রহস্যময় এবং প্রাণবন্ত। তিনি ছোট মূর্তিটি বের করলেন এবং পয়েন্ট বাই পয়েন্ট বড়টার সাথে তুলনা করতে লাগলেন। কোনো সন্দেহ নেই, উভয়ই একই নারীর প্রতিকৃতি যদিও ছোট মূর্তিটা হয়তো বড়টার থেকে দুই-তিন বছর পরে তৈরি করা হয়েছিল। তার কাছে বড় মূর্তিটির মুখ একটু বেশি বয়সী এবং আধ্যাত্মিক মনে হচ্ছিল। হয়তো অসুস্থতা বা মৃত্যুর পূর্বাভাস তখন রাণীর উপর ছায়া ফেলেছিল। তিনি বারবার তুলনা করলেন। কিছু আনুমানিক মাপ ও স্কেচ করলেন তার পকেটবুকে এবং অনুপাতের একটি নিয়ম বের করার চেষ্টা করলেন। এতই নিমগ্ন হয়ে তিনি কাজ করছিলেন যে মিউজিয়াম বন্ধ হওয়ার স্বাভাবিক সতর্কতা ঘণ্টাটি শুনতেই পেলেন না। স্মিথ দূরের এক অন্ধকার কোণে একটি বেদীর আড়ালে লুকিয়ে থাকায় কক্ষের প্রহরী শেষবারের মতো যখন চেক করতে এলো তাকে দেখতেই পেল না। এদিকে আগামীকাল শুক্রবার, মুসলমানদের সাপ্তাহিক ছুটির দিন অর্থাৎ মিউজিয়াম বন্ধ থাকবে। তাই শনিবার সকাল পর্যন্ত প্রহরীর আর আসার প্রয়োজন নেই। স্মিথকে একা রেখে সবাই চলে গেল। বিশাল দরজাগুলো শব্দ করে বন্ধ হলো–তালা ও বল্ট লাগানো হলো এবং বাইরে একজন প্রহরী ছাড়া সেই বিশাল প্রাঙ্গনে আর কেউ রইল না। এদিকে স্মিথ এক কোণে বসে স্কেচ ও মাপ নিয়ে ব্যস্ত। ছায়া বাড়ার কারণে দেখতে অসুবিধা হওয়ায় তার নজর পড়ল যে সময় দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে। তিনি ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলেন যে পাঁচটা বাজতে দশ মিনিট বাকি। "শীঘ্রই চলে যেতে হবে," মনে মনে ভাবলেন এবং আবার কাজে লেগে পড়লেন। কী অদ্ভুত নীরবতা! কোথাও কোনো পায়ের আওয়াজ শোনা যাচ্ছে না, না কোনো মানুষের কণ্ঠস্বর। তিনি আবার ঘড়ি দেখলেন। এবার দেখা গেল ছয়টা বাজে, পাঁচটা নয়—অন্তত ঘড়িতে সেটাই দেখা যাচ্ছে। কিন্তু এটা অসম্ভব কারণ মিউজিয়াম তো পাঁচটায় বন্ধ হয়; স্পষ্টতই মরুভূমির বালি ঘড়ির যন্ত্রের মধ্যে ঢুকে গেছে। স্মিথ 'আই' নাম্বার রুমে দাঁড়িয়ে ছিলেন। একজন আরব প্রহরী প্রায়শই এই রুমের উপর দিয়ে রুম 'কে' বা বাইরের গ্যালারিতে যাতায়াত করত। এখন তাকে খুঁজে বের করে সঠিক সময় জানতে হবে। হাথরের মূর্তির পাশ কাটিয়ে স্মিথ দরজার কাছে এসে গ্যালারির দুই দিকে তাকালেন। কোথাও কেউ নেই। তিনি দৌড়ে 'রুম কে', 'রুম এইচ' এবং অন্যান্য কক্ষগুলোতেও গেলেন। কাউকে দেখা গেল না। তখন তিনি যথাসম্ভব দ্রুত প্রধান প্রবেশদ্বারের দিকে ছুটলেন। দরজাগুলো তালাবদ্ধ ও বল্ট লাগানো। "ঘড়িটা ঠিকই আছে। আমি আটকে পড়েছি" স্মিথ নিজের মনে বললেন। "তবুও আশেপাশে কোথাও কেউ তো থাকবে। সম্ভবত বিক্রয়কেন্দ্র এখনও খোলা আছে। দোকানপাট তো বাধ্য না হলে বন্ধ করে না।" সেখানে গিয়ে দেখলেন একইরকমভাবে এই দরজাটাও শক্তভাবে বন্ধ। তিনি দরজায় কড়া নাড়লেন কিন্তু শুধু একটি কর্কশ প্রতিধ্বনি ছাড়া কোনো উত্তর এলো না। "আমি জানি," তিনি ভাবলেন, "পরিচালক নিশ্চয়ই এখনও তার কক্ষে আছেন। সব গয়না পরীক্ষা করে গুছিয়ে রাখতে তার অনেক সময় লাগবে।" তাই তিনি সেই কক্ষে যাওয়ার জন্য পথ ধরলেন। দুইবার পথ হারালেও শেষমেশ আরবরা যে সারকোফেগাস টানছিল তার সাহায্যে কক্ষটি খুঁজে পেলেন। সারকোফেগাসটি এখন সমাধির মতোই নিঃসঙ্গ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে—ক্রমশ ঘনিয়ে আসা অন্ধকারে একটি বিষাদময় বস্তু। পরিচালকের দরজাও বন্ধ ছিল। কড়া নাড়ায় শুধু প্রতিধ্বনি ছাড়া কোনো সাড়া মিলল না। এরপর তিনি মিউজিয়ামের চারপাশে ঘুরতে শুরু করলেন। নিচতলা খুঁজে বের করে বড় সিঁড়ি দিয়ে উপরের গ্যালারিতে উঠলেন। অবশেষে নিজেকে রাজকীয় মমিগুলোর প্রদর্শনীতে পেলেন আর ক্লান্ত হওয়ায় কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিলেন। তার সামনে, গ্যালারির মাঝখানে একটি কাঁচের বাক্সে বিশ্রাম নিচ্ছিল দ্বিতীয় রামেসিস। কাছাকাছি পাশের একটি বাক্সে ছিল রামেসিসের পুত্র মেনেপটাহ, আর তার উপরে তার পুত্র দ্বিতীয় সেটি, আর অন্যান্য বাক্সে মিশরের আরও অনেক রাজপরিবারের দেহাবশেষ ছিল। তিনি রামেসিসের গর্বিত মুখ এবং মমির মশলার কারণে হলদে হয়ে যাওয়া সাদা চুলের ছোট গোছা আর খানিকটা উঁচু করে রাখা বাম হাতটির দিকে তাকালেন। তার মনে পড়ল পরিচালক তাকে বলেছিলেন "এই পরাক্রমশালী রাজার মমি খোলার ফাঁকে এক প্রহরীকে দায়িত্বে রেখে তারা লাঞ্চ করতে গিয়েছিলেন। এর কিছুক্ষন পরই ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে প্রহরীটি তাদের কাছে দৌড়ে এসে বলেছিল যে মৃত রাজা হাত তুলে তার দিকে আঙুল দিয়ে ইশারা করছে! প্রহরীটির চুল খাড়া হয়ে গিয়েছিল। তারা ফিরে এসে দেখলেন সত্যিই হাতটি কিছুটা উঁচু হয়ে আছে; আর তারা কখনই সেটাকে পুরোপুরি আগের অবস্থানে ফিরিয়ে দিতে পারেননি। এর ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছিল যে সূর্যের উষ্ণতা শুকিয়ে যাওয়া পেশীগুলোকে সংকুচিত করেছে, যা খুবই স্বাভাবিক এবং যুক্তিসঙ্গত। তবুও স্মিথ চাইল না সে এই গল্পটি এই মুহূর্তে মনে করুক—বিশেষ করে যখন সে দেখল যে হাতটি যেন একটু নড়ছে... খুব সামান্য, তবুও নড়ছে!

পর্বঃ ৪

_______________________________________

স্মিথ ঘুরে মেনেপতাহের দিকে তাকালেন। মমির শুকনো চামড়ার মতো মুখের ওপর এলোমেলোভাবে জড়ানো কাপড়ের ফাঁক দিয়ে তার খালি চোখ দুটো যেন স্মিথের দিকে তাকিয়ে আছে। এই মুখই একদিন মুসার দিকে রাগে কুঁচকে উঠেছিল। এই হৃদয়ই আল্লাহ শক্ত করে দিয়েছিলেন। তার হার্ট একদম পাথরের মতো শক্ত হয়ে গিয়েছিলো—ডাক্তাররা বলেছিলেন ধমনী শক্ত (ক্যালসিফিকেশন) হয়ে যাওয়ায় তার মৃত্যু হয়েছিল আর হার্ট এর নালীগুলো ছিল সাদা চুনে পরিপূর্ণ!

স্মিথ একটি চেয়ারের উপর দাঁড়িয়ে উপরে 'দ্বিতীয় সেটির' মমির দিকে তাকালেন। তার দুর্বল চেহারাটা শান্ত মনে হলেও যেন কোনো অভিযোগের ভাব ছিল। নিচে নামার সময় স্মিথ ভারী চেয়ারটা উল্টে ফেললেন। চেয়ার পতনের শব্দ এতই ভয়ানক ছিল যে তিনি ভাবতেই পারেননি একটা চেয়ারের পতনে এত আওয়াজ হতে পারে! এই রাজাদের মমিগুলোকে আগে যতবার দেখেছেন তার চেয়ে আজ একদম অন্যরকম লাগছিল—যেন তারা আরও বাস্তব এবং জীবন্ত হয়ে উঠেছে।

স্মিথ আবার জীবিত মানুষের সন্ধানে বের হলেন।

তিনি এগোতে থাকলেন—ডানদিকে মমি, বামদিকে মমি, নানা ধরণের ও ভিন্ন ভিন্ন সময়ের। স্মিথ এতটাই বিরক্ত হলেন যে জীবনে তিনি আর কোনো মমি দেখতে চাইবেন না। মহান রানী তাইয়ার পিতা-মাতা—ইউইয়া ও তুইয়ো যে রুমে বিশ্রাম নিচ্ছিলেন তিনি সেখানে উঁকি দিলেন। তাদের উপর কাপড় টানা ছিল যা তাদেরকে আরও ভয়ানক করে তুলেছে—নগ্ন কালো অবয়বের চেয়েও আরও ভয়ংকর এবং রহস্যময় লাগছে।

তারপর তিনি গেলেন বিশ শতকের পুরোহিত-রাজাদের কফিনের কাছে। সেগুলো ছিল মানুষের মুখাকৃতির বড় বড় রঙিন কফিন। মনে হচ্ছিল এই পুরোহিত-রাজাদের সংখ্যা অনেক! তবে এরা সম্ভবত টলেমীয় যুগের রাণীদের সেই সোনার মুখোশগুলোর চেয়ে ভালো যেগুলো গোধূলির আলোয় ঝলমল করছিল।

সত্যি বলতে, উপরের তলায় তার আর দেখার ইচ্ছা রইল না। নিচের তলার মূর্তিগুলো এই সব মৃতদেহের চেয়ে ভালো—যদিও মিশরীয় বিশ্বাস অনুযায়ী প্রতিটি মূর্তি চিরকাল আত্মা বা 'কা' দ্বারা আচ্ছন্ন থাকে। তিনি বড় সিঁড়ি দিয়ে নেমে এলেন।

এটা কি কল্পনা, নাকি সত্যি?
সিঁড়ির নিচের ধাপে কিছু একটা যেন তার সামনে দিয়ে ছুটে গেল?
কোনো প্রাণী আর তার পিছনে একটা অস্পষ্ট দ্রুতগামী ছায়া?
যদি তাই হয়, তাহলে এটা নিশ্চয়ই মিউজিয়ামের বেড়াল যা কোন ইঁদুর তাড়া করছে।
কিন্তু তাহলে সেই অদ্ভুত এবং অপ্রীতিকর ছায়াটি কী ছিল?

তিনি ডেকে উঠলেন, "বিলি! বিলি! বিলি!"। বেড়ালের সঙ্গ এখন তার খুব প্রয়োজন কিন্তু কোনো বন্ধুত্বপূর্ণ "মিয়াউ" শোনা গেল না। হয়তো সেটা বিড়ালের 'কা' ছিল আর ছায়াটা?

আহ, সেটার ব্যাপারে চিন্তা করা ঠিক হবেনা। মিশরীয়রা বেড়াল পূজা করত আর এখানে তাকজুড়ে তাদের প্রচুর মমি রয়েছে। কিন্তু ওই ছায়া?

একবার তিনি চিৎকার করে সাহায্য চাইলেন কারণ কোনো জানালা দিয়ে বেরোনোর উপায় ছিল না। এই একবারই—পরবর্তীতে তিনি আর চিৎকার করলেন না কারণ মনে হলো হাজার হাজার কণ্ঠস্বর এই বিশাল ভবনের প্রতিটি কোণ ও ছাদ থেকে তাকে জবাব দিচ্ছে।

ঠিক আছে, তাকে এই পরিস্থিতি মোকাবিলা করতেই হবে। সে তো মিউজিয়ামে আটকে পড়েছে আর এখন ভাবতে হবে রাতটা কোথায় কাটাবে। তাছাড়া অন্ধকার দ্রুত বাড়ছে, তাই এই সমস্যার সমাধান এখনই করতে হবে। তিনি আজ ডিরেক্টরের কাছে যাওয়ার আগে দুপুরে এক আরব প্রহরীর সাহায্যে যে টয়লেটে হাত ধুয়েছিলেন সেটার কথা ভাবলেন। প্রহরীটি দরজা পাহারা দিত আর বিনিময়ে পিয়াস্ট্রি বখশিশ নিত। কিন্তু এখন সেই আরব নেই আর টয়লেটের দরজাটাও এই অভিশপ্ত জায়গার বাকি সব দরজার মতো তালাবদ্ধ। তিনি প্রবেশদ্বারের দিকে এগিয়ে গেলেন।

এখানে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে ছিল মহান রানী হাতশেপু এবং তার ভাই ও স্বামী তৃতীয় থটমেস এর লাল গ্রানাইটের সারকোফেগাস। স্মিথ তাদের দিকে তাকালেন। এই দুটির মধ্যে কোনো একটিতে রাত কাটানো যায় না?

এগুলো গভীর ও শান্ত আর মানুষের শরীরের জন্য একদম উপযুক্ত।

কিছুক্ষণ স্মিথ ভাবলেন—এই দুইজনের মধ্যে কে তার এমন ব্যবহার দেখে রাগ করতে পারেন? সাধারণ যুক্তিতে সিদ্ধান্ত নিয়ে রানীর দয়ার উপর নিজেকে ছেড়ে দিলেন।

তার এক পা ইতিমধ্যেই সেই কফিনের কিনারা অতিক্রম করেছে আর তিনি তার শরীরকে কাঠের ব্লকের উপর রাখা বিশাল ঢাকনার নিচে প্রবেশ করাচ্ছিলেন—ঠিক তখনই তার মনে পড়ল থিবসের রাজাদের উপত্যকায় দ্বিতীয় আমেনহোটেপ এর সমাধির পাশের কক্ষে এক ছোট নগ্ন, শুকনো ও দীর্ঘ কেশের মমিটির কথা। যাকে অনেকেই রানি হাতশেপুর আসল দেহ বলে বিশ্বাস করে।

একটু কল্পনা করুন তো, স্মিথ যখন এই সারকোফেগাসের তলায় শুয়ে থাকবে তখন এই ছোট্ট ভুতুড়ে মুখটি কফিনের কিনারা থেকে উঁকি দিয়ে যদি জিজ্ঞেস করে—"এখানে তুমি কী করছ?"

অবশ্য ভাবনাটা হাস্যকর; স্মিথ ক্লান্ত আর তার স্নায়ুগুলো দুর্বল ছিল। তবুও আসল ব্যাপারটি হলো শতাব্দী ধরে রানী হাতশেপুর মমি যেখানে শুয়েছিল যেখানে সে অর্থাৎ একজন আধুনিক মানুষ শুতে চাচ্ছিল।

স্মিথ তৎক্ষণাৎ কফিন থেকে নেমে এসে চারপাশে তাকালেন। মূল প্রবেশদ্বারের বিপরীতে ছিল মিউজিয়ামের বিশাল কেন্দ্রীয় হল। তিনি জানতেন এই হলের ছাদ সংস্কারের কাজ চলছিল। পরিচালক তাকে জানিয়েছিলেন এই কাজ শেষ হতে কয়েক বছর লাগবে। যার ফলে পুরো এলাকাটি কাঠের বোর্ড দিয়ে ঘেরা শুধু একটি ছোট দরজা খোলা ছিল শ্রমিকদের যাতায়াতের জন্য। কিছু মূর্তি যেমন দ্বিতীয় সেটি এবং অন্যান্য বড় বড় মূর্তি, যেগুলো সরানো সম্ভব নয়—সেগুলো মোটা কাঠ দিয়ে ঢেকে রাখা হয়েছে। প্রবেশদ্বারের দুপাশে রাখা ছিল প্রাচীন অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার নৌকাগুলো। ২০০ ফুট লম্বা এই বিশাল হলঘরটি প্রায় খালি—শুধু দূর প্রান্তে গ্যালারির নিচে দাঁড়িয়ে আছে তৃতীয় আমেনহোটেপ ও রানি তাইয়ার দুটি বিরাট মূর্তি। অন্ধকারে তাদের ছায়া যেন আরও বড় হয়ে উঠেছে।

"ওটা ছিল ঘুমানোর জন্য এক ভয়ংকর জায়গা" স্মিথ ভাবলেন, যদি ওই অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার নৌকাগুলোর একটির চারপাশে লাগানো বোর্ডের পেছনে লুকনো যায় তাহলে বেশ আরামদায়ক হবে। অন্তত সারকোফেগাস বা মমির ঘরের চেয়ে এটা অনেক ভালো।

সন্ধ্যার অন্ধকার নামতে আরম্ভ করেছে—তিনি পর্দা সরিয়ে হলের ভেতর প্রবেশ করলেন। শুধু স্কাইলাইটগুলো আর দূরপ্রান্তে দাঁড়িয়ে থাকা দৈত্যাকার মূর্তির রূপরেখা অস্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। সিঁড়ির মাথায় দাঁড়িয়ে আছে সকালে দেখা সেই দুইটি অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার নৌকা। ডানদিকের নৌকাটির দিকে হাতড়ে হাতড়ে এগোলেন। দেখা গেল স্মিথ ঠিক ধারণাই করেছিলেন। নৌকার ধনুকের দিকের কাঠের বোর্ডগুলো একটু ফাঁকা। ফাঁক গলে হামাগুড়ি দিয়ে নৌকার মাঝখানে গিয়ে শুয়ে পড়লেন।

শোয়ার প্রায় সাথে সাথেই ক্লান্তিতে ঘুমিয়ে পরলেন—তবে কতক্ষণ ঘুমিয়েছেন তা তিনি নিজেও জানেন না। হটাৎ জেগে উঠলেন, চারপাশ তখন ঘন অন্ধকার। যেহেতু হাত ঘড়িটি অটোমেটিক না তাই সময় দেখার উপায় নেই। পকেটে অবশ্য কয়েকটি দেশলাইয়ের কাঠি ছিল যার অন্তত একটা জ্বালিয়ে হয়তো পাইপ ধরানো যেতো। কিন্তু স্মিথ তা করলেন না কারণ তিনি জানতেন পৃথিবীর সবচেয়ে মূল্যবান মিউজিয়ামগুলোর একটিতে তিনি এখন অতিথি হিসেবে রাত্রিযাপন করছেন এবং আগুন লাগার ব্যাপারে সাবধান থাকা তার দায়িত্ব। পাঁচ হাজার বছরের পুরনো শুকনো কাঠের নৌকার নিচে দেশলাই জ্বালানো নিশ্চয়ই বুদ্ধিমানের কাজ হবে না?

স্মিথ এখন সম্পূর্ণ সজাগ। মনে হয় সারাজীবনে তিনি কখনো এত সতর্ক অনুভব করেননি—তার জীবনের সবচেয়ে বড় বিপর্যয়ের মুহূর্তেও নয়। তার স্নায়ুগুলো যেন বীণার তারের মতো টানটান—প্রতিটি ইন্দ্রিয় অসম্ভব রকম তীক্ষ্ণ। এমনকি তিনি উপরের গ্যালারি থেকে আসা মমিগুলোর গন্ধও পাচ্ছিলেন সাথে এই নৌকার মাটির ঘ্রাণতো রয়েছেই যা মিশরীয় পঞ্চম রাজবংশের কোনো এক পিরামিডের পাদদেশে হাজার বছর ধরে বালির নিচে চাপা পড়ে ছিল।

উপরন্তু তিনি নানারকম অদ্ভুত শব্দ শুনতে পাচ্ছিলেন—ক্ষীণ ও দূরবর্তী আওয়াজ যেগুলো প্রথমে মনে হয়েছিল কায়রো শহর থেকেই আসছে। তবে শীঘ্রই তিনি নিশ্চিত হলেন যে এসব শব্দ আসলে অনেক কাছাকাছি কোনো জায়গা থেকেই আসছে। নিঃসন্দেহে গ্যালারির সিমেন্ট ও কাঠের কেসগুলো ফাটছে যা বর্তমান পরিস্থিতিতে খুবই অপ্রীতিকর শোনাচ্ছে।

কিন্তু এসব সাধারণ ব্যাপার এতটা শব্দ করছে কেন আর কেনই বা তার মধ্যে এত অদ্ভুত অনুভূতি তৈরি করছে? সত্যিই মনে হচ্ছিল যেন চারদিকে কারা ঘুরঘুর করছে। আরও অবাক ব্যাপার হচ্ছে তিনি যেন নিশ্চিত ছিলেন যে তার নিচে থাকা অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার বিশাল নৌকাটিতে আবার সেই পুরনো নাবিকরা ফিরে এসেছে।

তিনি তাদের কাজের শব্দ শুনতে পাচ্ছিলেন। কারও পায়ের শব্দ আর ভারী জিনিস ডেকের উপর রাখার মতো আওয়াজ—যেমনটা হয়েছিল যখন ফারাওয়ের মমিটা শেষ যাত্রার জন্য নীল নদের পশ্চিম পাড়ে নিয়ে যাওয়ার সময় নৌকায় তোলা হয়েছিল। হ্যাঁ, এবার তো মনে হলো সেই পুরোহিত নাবিকরা বৈঠা বের করছে!

স্মিথ ভাবলেন, "এখান থেকে পালিয়ে যাওয়াই ভালো হবে।"
আর ঠিক তখনই একটা ঘটনা দেখে সেখানে আঠার মত আটকে গেলেন। তিনি নড়ার শক্তি প্রায় হারিয়ে ফেললেন।

দেখলেন বিশাল হলঘরটা আলোকিত হচ্ছে কিন্তু তা ভোরের আলো নয়—ফ্যাকাসে ভুতুড়ে তীব্র নীলচে আলো যা তিনি আগে কখনও দেখেননি। প্রথমে হলঘরের একদম শেষ প্রান্ত থেকে একটা পাখার কিংবা ঝর্ণার মতো আলো উঠতে লাগলো এবং সিঁড়িগুলো আর তাদের ওপরে বসে থাকা দুই বিশাল মূর্তিকে আলোকিত করে তুললো।

কিন্তু সিঁড়ির মাথায় দাঁড়িয়ে থাকা সেই জ্যোতির্ময় ব্যক্তিটি কে?
হায় আল্লাহ! এ তো স্বয়ং ওসাইরিস বা মৃতদের দেবতা ওসাইরিসের মূর্তি—মিশরীয়দের বিশ্ব ত্রাণকর্তা!

তিনি তার মমির কাপড়ে আবৃত অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছেন। মাথায় পালকের মুকুট আর হাত দুটো কাপড়ের ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে আছে —এক হাতে রাজদণ্ড, আরেক হাতে চাবুক।

তিনি জীবিত নাকি মৃত?
স্মিথ বুঝতে পারলেন না কারণ ওসাইরিস নড়ছিলেন না—শুধু শান্ত ভীতিকর ও করুণ মুখে শূন্যের দিকে তাকিয়ে ছিলেন।

স্মিথ বুঝতে পারলেন যে দেবতা ও তার মাঝের অন্ধকার স্থান এখন লোকে লোকারণ্য হয়ে গেছে—এক বিশাল জনসমাবেশ ঘটেছে। নীল আলো আরও বাড়তে লাগল। দীর্ঘ শিখাগুলো একত্রিত হয়ে সমগ্র হলঘরটিকে আলোকিত করে তুলল।

এবার তিনি সমাবেশটিকে স্পষ্ট দেখতে পেলেন। তার সামনে সারিবদ্ধ ভাবে দাঁড়িয়ে আছেন মিশরের ফারাও ও রানিরা। যেন কোনো অদৃশ্য সংকেত পেয়ে তারা সবাই একসাথে ওসাইরিসের উদ্দেশ্যে মাথা নত করলেন এবং তাদের অলংকারের মৃদু ঝংকার থেকে যাওয়ার আগেই হঠাৎ—ওসাইরিস অদৃশ্য হয়ে গেলেন। কিন্তু পরক্ষনেই তার স্থান দখল করলেন আরেকজন—দেবী আইসিস, রহস্যের জননী। তার গভীর চোখ দুটি রত্নখচিত শকুনের মুকুটের নিচ থেকে জ্বলজ্বল করছিল। আবারও সবাই মাথা নত করলেন আর সাথে সাথেই তিনিও অদৃশ্য হয়ে গেলেন। এবার তার জায়গায় এলেন আরও একজন দেবী—উজ্জ্বল, মোহনীয়, হাতে জীবনচিহ্ন আর মাথায় উজ্জ্বল সূর্যচক্রের প্রতীক। ইনি প্রেমের দেবী হাথোর। তৃতীয়বারের মতো সবাই নত করলেন আর তিনিও মিলিয়ে গেলেন—এবার আর কেউ তার জায়গায় এলো না।

এরপর ফারাও ও রানিরা একে অপরের সাথে কথা বলতে শুরু করলেন। স্মিথের মনে হল তাদের সকলের কণ্ঠস্বর মিলেমিশে এক মিষ্টি গুঞ্জনে পরিণত হয়েছে।

বিস্ময়ে স্মিথ ভয় পেতে ভুলে গিয়েছিলেন। লুকানো জায়গা থেকে তিনি গভীর মনোযোগ দিয়ে তাদের দেখছিলেন। তাদের কয়েকজনকে তিনি মুখ দেখে চিনতে পারলেন। যেমন ওই যে লম্বা গলার খু-এন-আতেন—কিছুটা রাগান্বিত ভঙ্গিতে কথা বলছেন সম্রাট দ্বিতীয় রামেসিসের সাথে। স্মিথ আশ্চর্যভাবে তাদের কথাবার্তা বুঝতে পারছিলেন—যেন এই ক্ষমতা তাকে দেওয়া হয়েছে। খু-এন-আতেন এক তীক্ষ্ণ কিন্তু দুর্বল কণ্ঠে অভিযোগ করছিলেন যে বছরের এই একটিমাত্র রাতে যখন তারা সবাই মিলিত হতে পারেন, তখন দেবতারা বা তাদের পূজার জন্য দেবতাদের যে মূর্তিগুলো রাখা হয়েছে তাদের মধ্যে তার দেবতা অর্থাৎ সূর্যচক্র 'আতেন'-এর কোনো মূর্তি রাখা হয়নি।

"আপনার দেবতার কথা আমি শুনেছি" রামেসিস উত্তর দিলেন, "পুরোহিতরা আমাকে তার কথা বলত আর এটাও বলত যে আপনি স্বর্গে চলে যাওয়ার পর তিনি বেশিদিন টিকেননি। আমেনের পুরোহিতরা আপনাকে ধর্মদ্রোহী বলে বদনাম দিয়েছিল আর আপনার নামের কার্তুজও মুছে দিয়েছিল। আমার সময়ে সেগুলো বড়ই দুর্লভ ছিল।

আহ, রাগ করবেন না! আমাদের অনেকেই তো বিধর্মী ছিল।
যেমন আমার নাতি সেতি—এই বলে তিনি একজন নম্র, চিন্তাশীল চেহারার লোককে ইঙ্গিত করলেন।
শুনেছি, সে নাকি সত্যিই সেই হিব্রু দাসদের দেবতাকে পূজা করত যাদের দিয়ে আমি আমার শহর বানাতাম। ওর সাথের মহিলাটার দিকে তাকান—সুন্দরী, না? তার বড় বড় বেগুনি রঙের চোখগুলো দেখুন! আসলে এই মহিলাই সব গণ্ডগোল করেছিল, সে নিজেও ছিল হিব্রু। অন্তত তারা আমাকে তাই বলেছে।"

"আমি তার সাথে কথা বলব," খু-এন-আতেন জবাব দিলেন। "একেবারেই সম্ভব যে আমাদের কিছু বিষয়ে মিল আছে। তবে এখনই আপনাকে আমি কিছু ব্যাখ্যা করতে পারি—"

"ওহ, দয়া করে এখন নয়। ওই তো আমার স্ত্রী আসছেন।"

"আপনার স্ত্রী?" খু-এন-আতেন সোজা হয়ে দাঁড়ালেন।
"কোন স্ত্রী? শুনেছি আপনার অনেক স্ত্রী ছিল এবং আপনি একটি বিশাল পরিবার রেখে গেছেন।
সত্যিই, আজ রাতে তাদের শত শত জনকে আমি এখানে দেখতে পাচ্ছি। “তবে আসুন” খু-এন-আতেন বললেন, আপনাকে আমার নেফারতিতির সাথে পরিচয় করিয়ে দিই। তিনি আমার একমাত্র স্ত্রী ছিলেন।"

"হ্যাঁ, আমি তাই শুনেছি। আপনার শরীর তেমন ভালো যেত না, তাই না? অবশ্য এমন পরিস্থিতিতে একজন বিশ্বস্ত নার্সই বেশি পছন্দনীয় হওয়ার কথা।

ওহ, দয়া করে ভুল বুঝবেন না! নেফারতারি, আমার ভালোবাসা—ওহ, মাফ করবেন! আস্তনেফারত—নেফারতারি তার কিছু সন্তানের সাথে কথা বলতে গেছেন। আমি আপনাকে আপনার পূর্বসূরি চতুর্থ আমেনহোটেপের স্ত্রী রানি নেফারতিতির সাথে পরিচয় করিয়ে দিই। (মানে চতুর্থ আমেনহোটেপ আর খু-এন-আতেন একই ব্যক্তি ছিলেন। তিনি তার নাম পরিবর্তন করে নামের অর্ধেক অংশ দেবতাদের পিতার নামে রেখেছিলেন।) এই রানি বহুবিবাহে আগ্রহী ছিলেন।

আচ্ছা বিদায়! আমি আমার দাদু প্রথম রামেসিসের সাথে কথা বলতে চাই। ছোটবেলায় তিনি আমাকে খুব ভালোবাসতেন।"

এই মুহূর্তে স্মিথের সেই অদ্ভুত কথোপকথনের প্রতি আগ্রহ চলে গেল কারণ হঠাৎই তিনি তার স্বপ্নের রানি মা-মি-কে দেখতে পেলেন! হ্যাঁ, সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই তিনিই দাড়িয়ে আছেন। স্মিথ যেমনটি কল্পনা করেছিলেন তিনি তার চেয়েও কমপক্ষে দশগুণ বেশি সুন্দরী।

মা-মি লম্বা এবং কিছুটা ফর্সা—গভীর তন্দ্রাচ্ছন্ন কালো চোখ আর মুখে সেই রহস্যময় হাসি যা স্মিথ এত ভালোবাসতেন। তিনি একটি সাধারণ সাদা পোশাক এবং বেগুনি সূচিকর্ম করা অ্যাপ্রন পরেছিলেন। তার কালো চুলে সাজানো ছিল সেই সোনার ইউরিয়াসের মুকুট—মূর্তির মতই তাতে ফিরোজা পাথরে তৈরি চোখওয়ালা সাপের আকৃতি খোঁদাই করা। তার বুক ও হাতে ছিল সেই একই হার ও বালা যা স্মিথ তার সমাধি থেকে উদ্ধার করেছিলেন। তিনি কিছুটা বিষণ্ণ বা বলা ভালো চিন্তিত মনে একা একটি রেলিংয়ের ওপর হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন। বোঝাই যাচ্ছে সমাবেশের দিকে তার খুব একটা আগ্রহ নেই।

এই সময়ে কালো ভ্রুওয়ালা পুরু ঠোঁটের একজন ফারাও এগিয়ে এলেন।
"তোমাকে অভিবাদন জানাই," তিনি বললেন।
মা-মি চমকে উঠলেন এবং উত্তর দিলেন, "ওহ, আপনি! আমি আপনার মাহাত্ম্যকে সম্মান জানাই—বলেই তিনি বিনয়ের সঙ্গে মাথা নত করলেন কিন্তু তার ভঙ্গিতে একটু বিদ্রূপের ছাপ ছিল।
"মনে হচ্ছে তুমি আমাকে খুঁজে বের করার জন্য খুব একটা উৎসুক ছিলে না, মা-মি; যদিও আমাদের খুব কমই দেখা হয়—"
"আমি দেখলাম আপনি আমার বোন অন্য রানীদের সাথে ব্যস্ত ছিলেন," তিনি গম্ভীর, মৃদু স্বরে বাধা দিয়ে বললেন, "এবং গ্যালারিতে আরও কিছু মহিলা ছিলেন যাদের মুখ আমার চেনা মনে হচ্ছে কিন্তু মনে হয় তারা রানী ছিলেন না। অথবা হয়তো আমার চলে যাওয়ার পর আপনি তাদের বিয়ে করেছেন।”

"আত্মীয়স্বজনের সাথে তো কথা বলতেই হয়," ফারাও উত্তর দিলেন।

"নিশ্চয়ই। কিন্তু দেখুন, আমার কোনো আত্মীয়স্বজন নেই—অন্তত যাদের আমি ভালো করে চিনি। আপনার মনে আছে নিশ্চই আমার বাবা-মা আমি ছোট থাকতেই মারা গিয়েছিলেন। আমাকে মিশরের উত্তরাধিকারী করে রেখে গেছেন আর আমার উপদেষ্টাদের পরামর্শে আমি যে বিয়ে করেছিলাম তা নিয়ে তারা এখনও বিরক্ত।
কিন্তু বলুন তো, এটা কি বিরক্তিকর নয়? আমার একটা আংটি হারিয়ে গেছে যেটায় দেবতা বেসের ছবি ছিল। পৃথিবীর কেউ একজন আজ সেটা পরে আছে আর সেই জন্যই আমি তার কাছ থেকে সেটা ফিরে পাচ্ছি না।"

"তার কাছ থেকে! কোন ব্যক্তির কথা বলছ?—আচ্ছা চুপ; কাজ শুরু হতে যাচ্ছে।"

"কী কাজ?"
"ওহ, আমাদের সমাধি লুণ্ঠনের বিষয় নিয়ে মনে হয়।"
"সত্যিই! এটা একটা বড় বিষয়। আচ্ছা বলুন তো, ওই মহিলাটি কে?
মা-মি অগ্রসরমান খুবই চমৎকার সাজে সজ্জিত এক মহিলার দিকে ইঙ্গিত করলেন।

"গ্রিক ক্লিওপেট্রা," তিনি উত্তর দিলেন, "মিশরের শেষ সম্রাজ্ঞী—টলেমি বংশের একজন। ওই যে রোমান লোকটাকে তার পিছনে পিছনে ঘুরে বেড়ানো দেখেই তাকে চেনা যায়।"

"কোন রোমান?" মা-মি জিজ্ঞেস করলেন। আমি তো বেশ কয়েকজনকে দেখছি—অন্যান্য পুরুষও আছে। এই কি সেই হতভাগী যে মিশরকে ধুলোয় মিশিয়ে দিয়েছিল এবং বিশ্বাসঘাতকতা করেছিল?
আহ, যদি এই শান্তির নিয়ম না থাকত যা আমাদের এই সম্মেলনে মেনে চলতে হয়!"

"তুমি বলতে চাচ্ছ যে তাকে টুকরো টুকরো করে ছিঁড়ে ফেলা হত, মা-মি? আর তার আত্মাকে ওসাইরিসের অঙ্গের মতো ছড়িয়ে দেওয়া হত?
ফারাও ঠোঁটে হাসি ফুটিয়ে বললেন, "এই শান্তির নিয়ম না থাকলে আমাদের অনেকেরই একই পরিণতি হত কারণ এই শতাধিক রাজার মধ্যে আমি এমন একজনকেও শুনিনি যে তার পূর্ববর্তী বা উত্তরসূরিদের সম্পর্কে পুরোপুরি ভালো কথা বলেছে।"

"বিশেষ করে যারা তাদের আগে এসেছে এবং স্মৃতিস্তম্ভ দখলের পাশাপাশি তাদের কার্তুজগুলো ভেঙ্গে ফেলেছে" মা-মি ফারাও এর চোখে চোখ রেখে নির্লিপ্ত কণ্ঠে বললেন।

এই সরাসরি আঘাতে ফারাও যেন একটু কুঁকড়ে গেলেন। কোনো উত্তর না দিয়ে তিনি সেই রাজকীয় মহিলার দিকে ইঙ্গিত করলেন যিনি হলের শেষ প্রান্তের সিঁড়িতে দাঁড়িয়েছিলেন।

রানি ক্লিওপেট্রা তার হাত তুলে কিছুক্ষণ সেভাবেই দাঁড়িয়ে রইলেন। তিনি এতটাই অপরূপ ছিলেন যে নৌকার কাঠের আড়ালে হাঁটু গেড়ে বসে স্মিথ তার ভাগ্যকে ধন্যবাদ দিলেন। এই আধুনিক যুগে একমাত্র তারই এই জীবন্ত সৌন্দর্য দেখার সৌভাগ্য হয়েছে। সেখানে দাঁড়িয়ে তিনি ঝলমল করছিলেন—যিনি পৃথিবীর ভাগ্য পরিবর্তন করেছিলেন এবং জীবনে যতই ভুল করুন না কেন অন্তত কীভাবে মরতে হয় তা জানতেন।

ফারাও-রানিদের সেই ঝলমলে সমাবেশ এবং হলঘরের চারপাশে গ্যালারির দুই স্তরে ভিড় করা তাদের শত শত সন্তান-সন্ততি, নারী ও উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের উপর নীরবতা নেমে এলো।

"মিশরের রাজপরিবারের সদস্যগণ" মিষ্টি ও স্পষ্ট কণ্ঠে ক্লিওপেট্রা শুরু করলেন যার আওয়াজ হলের সর্বপ্রান্তে পৌঁছে গেল।


"আমি ক্লিওপেট্রা—এই নামের ষষ্ঠ এবং শেষ সম্রাজ্ঞী। মিশর দাসদের বাসভূমিতে পরিণত হওয়ার পূর্বে আমি উচ্চ ও নিম্ন ভূমিতে শাসন করেছিলাম। আজ আপনাদের ফারাওদের কিছু কথা বলতে চাই যারা জীবদ্দশায় সবাই সেই সিংহাসন যথাযোগ্য মর্যাদায় পূর্ণ করেছিলেন যেখানে একসময় আমি বসেছিলাম।


আমি মিশর ও তার নিয়তি অথবা আমাদের পাপের কথা বলছি না যদিও সেই পাপগুলোর প্রায়শ্চিত্ত আমি ও অন্যরা অন্যত্র করছি এবং যুগে যুগে আমরা সেগুলো সম্পর্কে যথেষ্ট শুনেছি। কিন্তু বছরের এই একটি মাত্র রাতে যাকে আমরা ওসাইরিসের উৎসব বলি—আমাদের আরও একবার এক ঘণ্টার জন্য জীবন দেওয়া হয়েছে। যদিও আমরা শুধু ছায়া তবুও আমাদের দীর্ঘকাল বিলীন হয়ে যাওয়া দেহের ভালোবাসা ও ঘৃণাকে আমরা পুনরুজ্জীবিত করতে পারি। এই এক ঘণ্টার জন্য আমরা আমাদের পূর্বের জাঁকজমকপূর্ণ জীবন নিয়ে আবারও মেতে উঠি—আমাদের মাথায় আবারও সেই মুকুট শোভা পায় এবং আমরা যেন আবারও আমাদের প্রজাদের প্রশংসা শুনতে পাই।


আমাদের আশা এখন নশ্বর জীবনের আশা আর আমাদের শত্রুরা সেই শত্রু যাদের আমরা ভয় পেতাম। আমাদের দেবতারা আবার জীবন্ত হয়ে ওঠে আর আমাদের প্রেমিকেরা কানে ফিসফিস করে। আরও একটি আনন্দ আমাদের দেওয়া হয়েছে—যৌবনে আমরা যেমন ছিলাম তেমনটি এখনো থেকে দেবতাদের মত জানার ক্ষমতা ও ক্ষমা প্রদর্শন করার—যদিও আমরা কখনও কখনও ঘৃণা ও অবজ্ঞা করি। আমার কথা শেষ। আমি প্রাচীন মিশরের সর্বকনিষ্ঠ শাসক, এখন মিশরের প্রথম রাজাকে আমার স্থান নিতে আহ্বান জানাচ্ছি।"


তিনি মাথা নত করলেন এবং সমাবেশও প্রতিউত্তরে মাথা নত করে তাকে সম্মান জানালো। তারপর তিনি সিঁড়ি দিয়ে নেমে ভিড়ের মধ্যে মিলিয়ে গেলেন। তার স্থানে এলেন সাধারণ পোশাকে সজ্জিত লম্বা দাড়িওয়ালা জ্ঞানী চেহারার এক বৃদ্ধ—তার ধূসর চুলে সাপের মাথা খোঁদাই করা একটি সাধারণ সোনার বেল্ট ছাড়া আর কোনো মুকুট নেই।


"আমার পরবর্তী ফারাওগণ" বৃদ্ধ লোকটি বললেন, "আমি মেনেস। যদিও আমার আগে অনেকেই আমার চেয়েও প্রকৃত অর্থে রাজা ছিলেন তারপরেও আমিই মিশরের প্রথম স্বীকৃত ফারাও। কারন আমিই প্রথম উচ্চ ও নিম্ন ভূমিকে একত্রিত করেছিলাম, রাজকীয় পদবী ও উপাধি গ্রহণ করেছিলাম এবং যথাসাধ্য শাসন করেছিলাম। সেই কারণে আজকের এই বিশেষ রাতে আমাকে আপনাদের সাথে কিছুক্ষণ কথা বলার সুযোগ দেওয়া হয়েছে। এটা অত্যন্ত আনন্দের যে আমাদের আত্মারা সর্বোচ্চ জগতের সর্বপ্রান্ত থেকে একত্রিত হয়ে একে অপরের মুখোমুখি হতে পেরেছে।


প্রথমে আসুন আমরা দেবতাদের রহস্য এবং তার অর্থ নিয়ে কথা বলি। এরপর আসুন আমাদের জীবনের রহস্য নিয়ে কথা বলি—সেগুলো কোথা থেকে আসে, পথে কোথায় থামে এবং শেষ পর্যন্ত কোথায় যায়। তারপর আমরা মুখোমুখি বসে অন্যান্য বিষয় নিয়ে কথা বলব যেমনটা আমরা মানুষ থাকাকালীন সময়ে করতাম। অতঃপর আমাদের বার্ষিক উৎসব উদযাপন করতে থিবেসে যাব। এটাই কি আপনাদের ইচ্ছা?"


"এটাই আমাদের ইচ্ছা," তারা সবাই উত্তর দিলেন।


স্মিথের মনে হল সেই স্থানটি ঘন অন্ধকারে আচ্ছন্ন হয়ে এক ভয়াবহ নিস্তব্ধতা নেমে এল। এ আঁধার ও নীরবতা কতক্ষণ স্থায়ী ছিল বলা মুশকিল—হয়তো কয়েক বছর কিংবা কয়েক মুহূর্ত স্মিথ স্থির বসে রইলেন।


অবশেষে আবার আলো ফিরে এল। উপরের দিকে একটি নীল স্ফুলিঙ্গের রশ্মি ছড়িয়ে পরে সমস্ত কিছু আলোকিত করে দিল। সেই একই রাজকীয় সমাবেশকে সামনে রেখে সিঁড়ির উপর মেনেস দাঁড়িয়ে ছিলেন।


"রহস্যের পরিসমাপ্তি হয়েছে" বৃদ্ধ ফারাও বললেন। "এখন যদি কারও কিছু বলার থাকে তবে তা খোলাখুলি বলুক।"


প্রাচীন রাজবংশের পোশাক ও অলংকারে সজ্জিত এক যুবক এগিয়ে এসে মেনেস এবং তাঁর পরবর্তী সকল ফারাওদের মাঝখানে সিঁড়িতে দাঁড়ালেন। যৌবনের প্রতীকস্বরূপ ডান কানের পিছনে ঝুলে থাকা কেশগুচ্ছ দেখে স্মিথের তাকে চেনা মনে হল।


কোথায় দেখেছিলেন? আহ মনে পড়ল।

এইতো কিছুক্ষণ আগে মিউজিয়ামের এক কেসে ফারাও উনাসের হাড়গুলোর সাথে শায়িত অবস্থায় তাকে দেখেছিলেন।


"মহামান্য ফারাওগণ" তিনি শুরু করলেন, "আমি রাজা মেটেসুফিস। যে বিষয়টি আমি আপনাদের সামনে তুলে ধরতে চাই তা হলো পৃথিবীতে বসবাসকারী মানুষ দ্বারা আমাদের সমাধির পবিত্রতা লঙ্ঘন। আজ রাতে এখানে সমবেত অনেকেরই মমিকৃত দেহ এই স্থানে পড়ে আছে কৌতূহলী মানুষের দ্বারা নিরীক্ষিত ও উপহাসিত হওয়ার জন্য। 


ভাঙ্গা চোয়াল বিকৃত ও বীভৎস চেহারার আমি নিজেও তাদের একজন। দিনের পর দিন আমার 'কা' কে পিরামিড থেকে ছিনিয়ে আনা আমার মমিকৃত দেহের পাশে বসে থাকতে হচ্ছে। এই তো সেই পিরামিড যা আমি অগণিত শ্রম ও ব্যয়ে নির্মাণ করেছিলাম আমার চিরন্তন আবাস হিসেবে যেন পুনরুত্থানের সময় পর্যন্ত লুকিয়ে থাকতে পারি। আমাদের মধ্যে অনেকে দূর দেশেও শুয়ে আছেন। যেমন, আমার পূর্বসূরী ম্যান-কাউ-রা যিনি নির্মাণ করেছিলেন তৃতীয় মহাপিরামিড 'পিরামিড অফ হের'—তিনি এখন সমুদ্রপারের এক অন্ধকার নগরী লন্ডন নামক শহরে জাগ্রত কিংবা শায়িত আছেন। অন্যদের আগুনে পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে এবং কারো কারো দেহ ছোট ছোট ধুলোয় ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। আমাদের অলঙ্কারগুলো চুরি হয়ে লোভীদের কাছে বিক্রি হয়েছে। আমাদের পবিত্র লেখাগুলো আর প্রতীকগুলো তাদের কাছে ঠাট্টার বিষয়। শীঘ্রই মিশরে লুণ্ঠিত হয়নি এমন একটিও পবিত্র সমাধি খুঁজে পাওয়া যাবেনা।"


"সেটা ঠিক" সমাবেশ থেকে একটি কণ্ঠস্বর বলে উঠলো। মাত্র চার মাস আগে সেফ্রেনের পিরামিডের ছায়ায় অবস্থিত আমার পিতার সমাধিস্থল খনন করা হয়েছে। সেখানে আমার জন্য নির্ধারিত কক্ষে দু হাতে দুই মুঠো সাদা হাড় নিয়ে আমি একা শুয়ে ছিলাম কারন আমার মৃত্যুর পর তারা আমার দেহটি মমিকরন করেনি। এখন আমি সেই হাড়গুলো দেখতে পাই যার পাশে আমার 'কা' পাঁচ হাজার বছর ধরে পাহারা দিচ্ছিল।


"ঠিক তাই" আরও শত শত কণ্ঠস্বর একসাথে প্রতিধ্বনিত হলো।


"তাহলে" তরুন রাজা ফারাও মেনেসের দিকে ফিরে বললেন "আমি আপনার কাছে জানতে চাই যারা আমাদের এইরকম নিকৃষ্টভাবে অপমান করেছে তাদের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নেওয়ার কোনো উপায় কি নেই?"


"যার জ্ঞান আছে সে কথা বলুক" বৃদ্ধ ফারাও বললেন।


মিশরের সিংহাসনের উত্তরাধিকারী ও আমেনের মহাযাজকের পালক ও প্রতীক পরিহিত এবং হাতে একটি দণ্ড নিয়ে খর্বকায় গম্ভীর চেহারার একজন মধ্যবয়সী ব্যক্তি সিঁড়ির দিকে এগিয়ে এলেন। স্মিথ তাকে সঙ্গে সঙ্গেই তার মূর্তি থেকে চিনতে পারলেন। তিনি তিনি ছিলেন খায়েমুয়াস—রামেসিস দ্য গ্রেটের পুত্র এবং মিশরের সর্বশ্রেষ্ঠ যাদুকর যিনি সিংহাসনে বসার সময় আসার আগেই স্বেচ্ছায় পৃথিবী ত্যাগ করেছিলেন।


"আমার জ্ঞান আছে, ফারাওগণ এবং আমি উত্তর দেব" তিনি বললেন। "সময় ঘনিয়ে আসছে যখন মৃত্যুভূমি অর্থাৎ জীবন—যাকে আমরা আমেনটি বলি, সেখানে আমাদের অন্যায়গুলো বিচারকদের সামনে উপস্থাপন করার সুযোগ পাবো এবং তারা এর প্রতিশোধ নেবেন। বছরের এই বিশেষ রাতেও যখন আমরা আমাদের পুরনো রূপ ফিরে পাই, তখন আমাদের কিছু প্রতিশোধ নেওয়ার ক্ষমতা থাকে—বলতে গেলে ন্যায়বিচার কার্যকর করার ক্ষমতা। কিন্তু আমাদের সময় কম এবং সূর্যদেবতা রা উদিত হওয়ার আগে আমাদের অনেক কিছু বলার ও করার আছে। তারপরই আমাদের প্রত্যেকে নিজ নিজ স্থানে ফিরে যেতে হবে। তাই এটাই উত্তম মনে হয় যে আমরা এই দুষ্টদের তাদের দুষ্টতার মধ্যেই ছেড়ে দিই যতক্ষণ না পৃথিবীর বাইরে আমরা তাদের মুখোমুখি হচ্ছি।


স্মিথ এতক্ষন কিছুতা উদ্বেগ নিয়ে খায়েমুয়াসের কথাগুলো মনোযোগ দিয়ে শুনছিলেন। তিনি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন এবং আল্লাহকে ধন্যবাদ জানালেন এই ভেবে যে এই প্রয়াত ফারাওদের এত ব্যস্ততা ও জরুরি কাজ রয়েছে যে তার দিকে নজর দেওয়ার সময়টুকুও তাদের নেই। তবুও অতিরিক্ত সাবধানতার জন্য তিনি পকেট থেকে মা-মি’র হাত সম্বলিত সিগার বাক্সটি বের করে যতদূর সম্ভব নিজের থেকে দূরে ঠেলে দিলেন।


এটা ছিল অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক একটি কাজ।


হয়তো সিগার বাক্সটি মেঝেতে ঘষা লেগে শব্দ করেছিলো নয়তো এই মমির অংশ স্পর্শ করার কারণে তিনি এই সমস্ত আত্মাদের সাথে আধ্যাত্মিক যোগাযোগে আবদ্ধ হয়ে পড়েছিলেন। যাই হোক, তিনি অনুভব করলেন সেই ভয়ঙ্কর যাদুকরের চোখ দুটি তার দিকে আটকে গেছে। তার অশুভ দৃষ্টি থেকে নিজেকে লুকানো একেবারেই অসম্ভব।


"যাই হোক" খায়েমুয়াস শীতল কণ্ঠে বলে চললেন, "আমি এখন দেখতে পাচ্ছি এই স্থানেই লুকিয়ে আছে ওই নিকৃষ্ট চোরদের মধ্যে সবচেয়ে জঘন্য একজন। আমি তাকে ওই শেষকৃত্যের নৌকার নিচে লুকিয়ে থাকতে দেখছি আর এই মুহূর্তেই তার কাছে রয়েছে আপনাদেরই একজন মহিমান্বিত রানীর মমিকৃত হাত যা থিবেসে তার সমাধি থেকে সে চুরি করেছে।


এবার সমাবেশের সকল রানী দৃশ্যত উত্তেজিত হয়ে উঠলেন। স্মিথ লক্ষ করলেন মা-মি তার হাত দুটি উঁচু করে তাকিয়ে দেখছেন আর সকল ফারাও একসঙ্গে তাদের আঙুল তুলে গর্জন করে বললেন:


"তাকে বিচারের কাঠগড়ায় নিয়ে আসা হোক!"


খায়েমুয়াস তার যাদুদণ্ড উঠিয়ে স্মিথ যেখানে লুকিয়ে ছিল সেই নৌকার দিকে ইশারা করে বললেন:


"ওহে দুষ্ট লোক, তুমি যা চুরি করেছ তা নিয়ে এসো।"


স্মিথ যেখানে ছিলেন সেখানেই বসে থাকার যথাসাধ্য চেষ্টা করলেন। তার গোড়ালি মেঝেতে শক্ত করে আটকে রাখলেন। পাঠক যেমনটা জানেন, স্বভাবগতভাবে তিনি সবসময় লাজুক ও অন্তর্মুখী ছিলেন এবং এই মুহূর্তে তার সেই স্বভাব তাকে আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি আচ্ছন্ন করে ফেলেছিল।


শৈশবে তার সবচেয়ে ভয়ঙ্কর দুঃস্বপ্ন ছিল যে একজন জুরি ফোরম্যান তাকে কোনো ভয়ঙ্কর অপরাধে দোষী সাব্যস্ত করেছিলো। এখন তিনি বুঝতে পারলেন সেই দুঃস্বপ্ন আসলে কীসের পূর্বাভাস দিচ্ছিল। সে এমন এক আদালতে দোষী সাব্যস্ত হতে চলেছে যেখানে মিশরের সকল রাজা-রানিই জুরি, মেনেস প্রধান বিচারপতি, আর যাদুকর খায়েমুয়াস ছিলেন অ্যাটর্নি জেনারেলের ভূমিকায়।


স্মিথ যতই শক্ত করে বসে থাকার চেষ্টা করুক না কেন, কোনো এক অদৃশ্য শক্তি তাকে আষ্টেপৃষ্ঠে ধরে ফেলল। প্রথমে তার হাত নিজে থেকেই সিগার বাক্সটা তুলে নিতে বাধ্য হল। এরপর সেই শক্তি তাকে নৌকার কাঠের আড়াল থেকে টেনে বের করে আনল।


এবার স্মিথ উঠে দাঁড়ালেন এবং মেনেস যেখানে দাঁড়িয়ে ছিলেন তার থেকে অনেক দূরে বিপরীত দিকের সিঁড়িগুলো বেয়ে নিচে নামতে লাগলেন। তিনি সমাবেশের ঠান্ডা ও বিস্মিত চোখের মালিকদের মাঝ দিয়ে পথ করে এগিয়ে গেলেন।


তারা সবাই ছিলেন রাজকীয় আত্মা; শতাব্দীর পর শতাব্দী পেরিয়ে গেলেও তাদের রাজকীয় মর্যাদা একটুও কমেনি। তবে একজন ছাড়া, তাদের কেউই তার দুর্দশার প্রতি কোনো করুণা দেখাচ্ছিল না। সে ছিল এক ছোট্ট রাজকুমারী যে তার মায়ের পাশে দাঁড়িয়ে ছিল—সেই একই ছোট্ট রাজকুমারী যার মমি স্মিথ পরিচালকের ঘরে দেখেছিলেন এবং যার মমির কাপড়ের গোলাপি বাঁধনের নিচে একটি পদ্ম ফুল গোঁজা দেখে তার মায়া হয়েছিল। পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় স্মিথ তাকে বলতে শুনলেন:


"এই দুষ্ট লোক ভয় পেয়েছে। সাহসী হও, দুষ্ট লোক!"


স্মিথের আত্মসম্মান তাকে সাহায্য করল। আধুনিক বিশ্বের একজন ভদ্রলোক হয়ে তিনি প্রাচীন মিশরীয় আত্মাদের সামনে দুর্বলতা দেখাবেন না। শিশুটির দিকে ফিরে কিঞ্চিৎ হেঁসে তিনি সম্পূর্ণ সোজা হয়ে দাঁড়ালেন এবং শান্তভাবে হেঁটে চললেন। উল্লেখ্য, স্মিথ ছিলেন লম্বা খুবই সুদর্শন একজন তরুন—গাঢ় মায়াবী চোখ ও ছোট কালো দাড়ির সুগঠিত দেহের অধিকারী।


"অন্তত সে একজন সুশ্রী চোর" একজন রানি অন্যজনকে বললেন।


"হ্যাঁ" উত্তর দিলেন দ্বিতীয় রানী, "আমি অবাক হচ্ছি যে এমন একজন অভিজাত চেহারার মানুষ সমাধি নষ্ট করতে এবং মৃতদের নৈবেদ্য চুরি করতে যায় কী করে!"


এই কথাগুলো স্মিথকে গভীর চিন্তায় ফেলে দিল। তিনি বিষয়টি এভাবে কখনো বিবেচনা করেননি।


এখন তিনি মা-মির সামনে এসে দাঁড়ালেন। তার পাশে সেই কালো ভ্রুওয়ালা ফারাও স্বামী দাঁড়িয়ে আছে। কোনো অদৃশ্য শক্তি স্মিথকে সেই সিগার বাক্সটি বুকের সাথে চেপে ধরে রাখতে বাধ্য করছে—সোনার তৈরি বেসের আংটিটি তখনো জ্বলজ্বল করছিলো।


এগিয়ে যাওয়ার সময় তিনি মাথা ঘুরিয়ে মা-মি'র দিকে তাকালেন। তাদের চোখাচোখি হওয়ামাত্র মা-মি ভীষণভাবে চমকে উঠলেন। তারপর যখন তার হাতের আংটিটি দেখলেন তখন আরও বেশি চমকে উঠলেন।


"মহারানীর কী হয়েছে?" ফারাও প্রশ্ন করলেন।


"ও কিছু না" তিনি উত্তর দিলেন। "তবে এই পৃথিবীবাসী কি আপনাকে কারো কথা মনে করিয়ে দিচ্ছে?"


"হ্যাঁ, দিচ্ছে" ফারাও উত্তর দিলেন। "সে আমাকে সেই অভিশপ্ত ভাস্করের কথা মনে করিয়ে দিচ্ছে যার সঙ্গে আমাদের বিবাদ হয়েছিল।"


"আপনি কি রাজসভার শিল্পী সেই হোরুর কথা বলছেন যিনি সমাধিতে আমার মূর্তি তৈরি করেছিলেন আর যাকে আপনি কুশের মরুভূমিতে আপনার মূর্তি খোদাই করার জন্য পাঠিয়েছিলেন এবং শেষ পর্যন্ত বেচারা জ্বরে অথবা বিষপ্রয়োগে মারা গিয়েছিল?"


"হ্যাঁ; হোরুই—অন্য কেউ নয়, সেত তাকে নিয়ে যাক!" ফারাও গর্জন করলেন।


আর কিছু শোনার অপেক্ষা না করে স্মিথ এগিয়ে গেলেন। এখন তিনি সম্মানিত মেনেসের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন। তার স্বাভাবিক প্রবৃত্তি তাকে এই ফারাওর প্রতি মাথা নত করতে বাধ্য করল—বিনিময়ে ফারাও তার প্রতি মাথা নত করলেন। তারপর তিনি ঘুরে রাজকীয় সমাবেশের প্রতি মাথা নত করলেন এবং তারাও শীতল কিন্তু বিনীতভাবে প্রত্যুত্তর দিলেন।


"হে পৃথিবীর বাসিন্দা—যেখানে একসময় আমাদের স্থান ছিল এবং সেই সূত্রে তুমি আমাদের মৃতদের ভাই" মেনেস শুরু করলেন, "এই পুরোহিত ও যাদুকর"—তিনি খায়েমুয়াসের দিকে ইশারা করলেন—দাবি করছেন যারা আমাদের সমাধি লুণ্ঠন করে আমাদের মমিকে অবমাননা করে তুমি তাদের একজন। তিনি আরও বলেন এই মুহূর্তে তোমার কাছে একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির মমিদেহের একটি অংশ রয়েছে যার আত্মা এখানে বর্তমানে উপস্থিত রয়েছে। বলো, এই অভিযোগগুলো কি সত্য?"


স্মিথ বিস্মিত হয়ে দেখলেন যে তিনি অত্যন্ত সহজেই সেই মধুর প্রাচীন ভাষায় উত্তর দিতে পারছেন।


"হে রাজা, অভিযোগগুলো একইসাথে সত্য এবং মিথ্যা। মিশরের শাসকগণ আমার কথা শুনুন—এটা সত্য যে আমি আপনাদের সমাধি অনুসন্ধান করেছি কারণ আমার হৃদয় আপনাদের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিল এবং আমি আপনাদের সম্পর্কে সব জানতে চেয়েছিলাম। কারণ এখন আমার মনে হচ্ছে যে একসময় আমি আপনাদেরই একজন ছিলাম—রাজা না হলেও হয়তো রাজবংশের রক্ত বহন করেছি। এছাড়াও আমি এতদিন ধরে বিশেষ একটি সমাধির সন্ধান করছিলাম।


"ওহে মানুষ, কেন? বিচারক প্রশ্ন করলেন।"


"কারণ একটি মুখ আমাকে আকর্ষণ করেছিল, পাথরে খোদাই করা একটি মোহনীয় মুখ।"


বিশাল সমাবেশ তার দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকাল, তার কথায় যেন তারা আবেগাপ্লুত হয়ে পরেছে।


"তুমি কি সেই পবিত্র সমাধি খুঁজে পেয়েছিলে?" মেনেস জিজ্ঞাসা করলেন। "যদি পেয়ে থাকো, তাহলে সেখানে কী পেয়েছ?"


"হ্যাঁ, ফারাও এবং সেখানে আমি এগুলো পেয়েছি" বলে স্মিথ বাক্স থেকে শুকনো হাতটি, পকেট থেকে ভাঙ্গা ব্রোঞ্জের মূর্তিটি এবং আঙুল থেকে আংটিটি খুলে দেখালেন।


"আমি আরও কিছু জিনিস পেয়েছি যা এই স্থানের পরিচালককে দিয়েছি এবং কিছু গহনা যা আজ রাতে আমি আপনাদের মধ্যে উপস্থিত একজনের গায়ে দেখতে পাচ্ছি বলে মনে হচ্ছে।"


"এই মূর্তির মুখটি কি সেই মুখ যা তুমি খুঁজছিলে?" বিচারক প্রশ্ন করলেন।


"এটাই সেই মোহনীয় মুখ" তিনি উত্তর দিলেন।


মেনেস ব্রোঞ্জের মূর্তিটি হাতে নিয়ে এর বুকের নিচে খোদাই করা কার্তুজটি পড়লেন।


"যদি আমাদের মধ্যে এখানে এমন কেউ থাকেন"—তিনি কিছুক্ষণ পর বললেন, "যিনি আমার সময়ের অনেক পরে মিশরের রানী হিসেবে শাসন করেছিলেন এবং যিনি মা-মি নামে পরিচিত, তিনি এগিয়ে আসুন।"


মা-মি যেখানে দাঁড়িয়েছিলেন সেখান থেকে ধীর পায়ে এগিয়ে এসে স্মিথের সামনে দাঁড়ালেন।


"বলুন, হে রানী" মেনেস জিজ্ঞাসা করলেন, "আপনি কি এই বিষয়ে কিছু জানেন?"


"আমি এই হাতটিকে চিনি; এটি আমার নিজের হাত ছিল" তিনি উত্তর দিলেন। "আমি এই আংটিটিকে চিনি; এটি আমারই আংটি ছিল। আমি ব্রোঞ্জের এই মূর্তিটিকে চিনি; এটি আমারই মূর্তি ছিল। আমার দিকে তাকিয়ে নিজেরাই বিচার করুন যে এটি সত্য কিনা। একজন ভাস্কর এটি তৈরি করেছিলেন, রাজপুত্রের পুত্র হোরু। ভাস্করদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ এবং আমার রাজসভার প্রধান শিল্পী। ওই যে ওখানে অদ্ভুত পোশাকে সজ্জিত হয়ে সে আপনাদের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। হোরু অথবা হোরুর প্রতিরূপ—যে আমার শাসনামলে এই মূর্তিটি তৈরি করেছিল সে-ই এই মূর্তিটি খুঁজে পেয়েছে এবং যে মানুষটি আপনাদের সামনে দাঁড়িয়ে আছে অথবা সম্ভবত একই ছাঁচে তৈরি তার প্রতিরূপ।"


ফারাও মেনেস যাদুকর খায়েমুয়াসের দিকে ফিরে বললেন—


"এইসব কি সত্য, ও জাদুকর?"


"হ্যাঁ, এগুলো সত্য" খায়েমুয়াস উত্তর দিলেন। "এই পৃথিবীবাসী হচ্ছে সেই ব্যক্তি যে অনেক আগে ভাস্কর হোরু নামে পরিচিত ছিল। কিন্তু এতে কী আসে যায়? সে পুনরায় জীবিত হয়ে মৃতদের সমাধি লুণ্ঠন করেছে। তাই আমি বলি তার দেহের উপর শাস্তি কার্যকর করা উচিত যাতে আগামীকাল সকালের আলো ফুটলে সে নিজেই মৃতদের সাথে মিলিত হতে পারে।"


মেনেস তার বুক বরাবর মাথা ঝুঁকিয়ে গভীরভাবে চিন্তা করতে লাগলেন। স্মিথ কিছুই বললেন না। তার কাছে পুরো ঘটনাটি এত কৌতূহলোদ্দীপক ছিল যে তিনি এর অগ্রগতিতে কোনো হস্তক্ষেপ করতে চাননি। যদি এই আত্মারা তাকে তাদের দলে নিতে চায় তাতে সে আপত্তি করবে না। পৃথিবীতে তার কোনো বন্ধন ছিল না এবং এখন যখন তিনি সম্পূর্ণরূপে নিশ্চিত হলেন যে এই পার্থিব জীবনের বাইরেও একটি জীবন আছে তখন তিনি এর রহস্য উদ্ঘাটনের জন্য সম্পূর্ণ প্রস্তুত ছিলেন। তাই তিনি তার বাহু বুকের উপর ভাঁজ করে রায়ের জন্য অপেক্ষা করতে লাগলেন।


কিন্তু মা-মি অপেক্ষা করলেন না। তিনি এত দ্রুত তার হাত তুললেন যে তার কব্জিতে চুড়িগুলো ঝনঝন করে উঠল এবং সাহসের সাথে স্পষ্ট কণ্ঠে বলে উঠলেন:

"রাজকুমার খায়েমুয়াস, যাদুকর" তিনি বললেন "আপনার মতো আমিও শতাব্দী আগে মিশরের উত্তরাধিকারী ছিলাম এবং ভালোভাবেই দুই ভূমির শাসন করেছিলাম যা আপনার ভাগ্যে কখনো জোটেনি। সব জ্ঞান কি শুধু আপনার মধ্যেই সীমাবদ্ধ? আমাকে উত্তর দিন! জীবন-মৃত্যুর রহস্য কি শুধু আপনিই জানেন? আমাকে উত্তর দিন! আপনার দেবতা আমেন কি আপনাকে শিখিয়েছিলেন যে ক্ষমার আগে প্রতিশোধ নিতে হবে? আমাকে উত্তর দিন! তিনি কি আপনাকে শিখিয়েছিলেন যে মানুষকে না শুনেই বিচার করা উচিত? যে তাদের সময়ের আগেই হিংসাত্মকভাবে জোর করে ওসাইরিসের কাছে পাঠানো উচিত এবং এর ফলে তাদের প্রিয় মৃতদের থেকে বিচ্ছিন্ন করে এই পাপিষ্ঠ পৃথিবীতে আবার জীবন যাপন করতে বাধ্য করা উচিত?"

"শুনুন: শেষ পূর্ণিমার কাছাকাছি সময়ে আমার আত্মা রানীদের সমাধিক্ষেত্রে আমার সমাধিতে বসে ছিল। আমার আত্মা দেখেছিল এই লোকটি আমার কবরে প্রবেশ করে সেখানে সে কী করেছে। নত মস্তকে সে আমার সেই হাড়গুলো দেখল যা এক পুরোহিত চোর আমার দাফনের বিশ বছরের মধ্যেই চুরি করে পুড়িয়ে দিয়েছিল। আর এই মানুষটি যিনি একসময় হোরু ছিলেন, সেই হাড়গুলো নিয়ে কী করল? আমি বলছি, সে সেগুলো সমাধির মধ্যে এমন জায়গায় লুকিয়ে রাখল যেখানে সেগুলো আর কেউ খুঁজে পাবেনা। তাহলে চোর এবং লুণ্ঠনকারী কে? যে আমার হাড়গুলো চুরি করে পুড়িয়েছিল নাকি যে সেগুলোকে শ্রদ্ধার সাথে দাফন করেছিল? আবার, সে সেই গহনাগুলো খুঁজে পেয়েছিল যা আপনার ব্রাদারহুডের পুরোহিত পালানোর সময় ফেলে গিয়েছিল যখন পোড়া মাংস ও মশলার ধোঁয়া তাকে কাবু করে ফেলেছিল আর সাথে ছিল সেই হাতটি যা সেই দুষ্ট চোর আমার মহিমান্বিত দেহ থেকে ভেঙে নিয়েছিল। এই মানুষটি তখন কী করল? সে গহনাগুলো নিল। আপনি কি চাইতেন সেগুলো রেখে দিক যেন কোনো কৃষক চুরি করে নিয়ে যায়? আর হাতটা? আমি বলছি, সে সেই মৃত হাতটিকে চুম্বন করল যা একদিন আমার রাজকীয় দেহের অংশ ছিল আর এখন সে এটিকে একটি পবিত্র স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে সংরক্ষণ করছে। আমার আত্মা তাকে এই কাজগুলো করতে দেখেছিল এবং আমাকে জানিয়েছিল। তাই আমি আপনাকে প্রশ্ন করছি, রাজকুমার এবং সাথে আপনাদের সবাইকে; হে মিশরের রাজপরিবারের সদস্যবৃন্দ—এমন কাজের জন্য কি এই মানুষটির মৃত্যু হওয়া উচিত?"

এবার প্রতিশোধের পক্ষপাতী খায়েমুয়াস কাঁধ ঝাঁকিয়ে অর্থপূর্ণ হাসি দিলেন কিন্তু রাজা-রানিদের সমাবেশ একসাথে গর্জন করে উত্তর দিল—

"না!"

মা-মি মেনেসের দিকে তাকালেন রায় দেবার জন্য। তিনি কথা বলার আগেই সেই কালো ভ্রূওয়ালা ফারাও যিনি তাকে স্ত্রী বলে সম্বোধন করেছিলেন, এগিয়ে এসে সবার উদ্দেশ্যে বললেন:

"মহারানী, মিশরের উত্তরাধিকারিণী, রাজকীয় স্ত্রী, দুই ভূমির অধিশ্বরী কথা বলেছেন, "তিনি গর্জে উঠলেন। "মহারানীর স্বামী হিসেবে এখন আমাকে বলতে দিন। এই মানুষটি কি সত্যিই একদিন হোরু ভাস্কর ছিল কিনা তা আমি জানি না। যদি তাই হয় তবে সেও একজন অপরাধী ছিল যাকে আমার আদেশে কুশের দেশে নির্বাসনে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছিল। সে যাই হোক না কেন সে স্বীকার করেছে যে সে মহারানীর সমাধি লুণ্ঠন করেছে এবং পুরানো চোরদের ফেলে যাওয়া জিনিস চুরি করেছে। মহারানী আরও বলছেন এবং সে তা অস্বীকারও করেনি—যে সে তার হাতে চুমু খেয়েছে আর একজন পুরুষ যদি মিশরের বিবাহিত রানির হাতে চুমু খায় তবে তার শাস্তি মৃত্যুদণ্ড। আমি দাবি করছি এই মানুষটিকে সময়ের আগেই পৃথিবী থেকে বিদায় নিতে হবে যাতে ভবিষ্যতে তাকে আবার পৃথিবীতে ফিরে এসে কষ্ট ভোগ করতে হয়। বিচার করুন, হে মেনেস।"

মেনেস মাথা তুলে বললেন:

"আমাকে সেই আইনটি পুনরায় বলুন, হে ফারাও, যার অধীনে একজন জীবিত মানুষকে একটি মৃত হাতে চুম্বনের জন্য মরতে হবে। আমার সময়ে এবং আমার পূর্বপুরুষদের সময়ে মিশরে এমন কোনো আইন ছিল না। যদি একজন বিবাহিত রানীর জীবিত হাত তার স্বামী বা আত্মীয় ছাড়া অন্য কোনো জীবিত মানুষ আনুষ্ঠানিকতায় চুম্বন করত তাহলে হয়তো তাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া যেতো। হয়তো এমনই কোন কারণে একদিন হোরুকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু সমাধিতে কোনো বিবাহ নেই—তাই যদি সে তাকে জীবিত অবস্থায় সমাধিতে পেত এবং তার হাত বা ঠোঁটে চুমু খেত তবে ভালোবাসার অপরাধে কেন তার মরতে হবে?"

"শুনুন সবাই; এই বিষয়ে এটাই আমার রায়। যেই পুরোহিত প্রথমে রানি মা-মি'র সমাধি লুণ্ঠন করেছিল তার আত্মাকে ধরা হোক এবং ধ্বংসকারীর মুখে ফেলা হোক যেন সে মৃত্যুর সর্বশেষ গভীরতা জানতে পারে। কিন্তু এই মানুষটিকে আমাদের মধ্য থেকে নিরাপদে চলে যেতে দেওয়া হোক কারণ সে যা করেছে তা করেছে শ্রদ্ধা ও অজ্ঞতায় এবং কারণ প্রেমের দেবী হাথোর তাকে প্রাচীনকাল থেকেই পথ দেখিয়েছেন। ভালোবাসাই এই পৃথিবী শাসন করে—যেখানে আমরা আজ রাতে মিলিত হয়েছি এবং সেই সব জগত যেখান থেকে আমরা এসেছি বা যেখানে আমাদের যেতে হবে। কে এর শক্তিকে অগ্রাহ্য করতে পারে? কে এর রীতিকে প্রত্যাখ্যান করতে পারে? এখন থিবেসের দিকে চলুন!"

হাজার হাজার ডানার শব্দের মতো একটি ঝড় উঠল এবং সবাই চলে গেল।

না, সবাই নয়—কারণ স্মিথ তখনও দাঁড়িয়ে ছিলেন সেই পর্দাবৃত দৈত্যাকার মূর্তি এবং খালি সিঁড়ির সামনে আর তার পাশে জ্যোতির্ময়, অলৌকিক মা-মি ঝলমল করছিল।

"আমাকেও যেতে হবে" তিনি ফিসফিস করে বললেন "তবে যাওয়ার আগে তোমার সাথে একটি কথা বলতে চাই। মিশরের একজন ভাস্কর থাকাকালে তুমি আমাকে ভালোবেসেছিলে এবং সেই ভালোবাসাই তোমার জীবন নিয়েছিল। তুমি একবার সাহস করে আমার এই হাতটি চুম্বন করেছিলে যা তুমি আবার সেই সমাধিতে চুম্বন করেছ।

কারণ আমি ছিলাম নামমাত্র ফারাওয়ের স্ত্রী; ভালো করে বুঝে নাও, শুধু নামমাত্র; কারণ রাজকীয় মাতার যে উপাধিটা আমাকে দেওয়া হয়েছিল তা ছিল মিথ্যা খোদাই করা একটি উপাধি। হোরু, আমি কখনোই কারো স্ত্রী ছিলাম না আর যখন তুমি মারা গেলে, আমি দ্রুত তোমাকে অনুসরণ করে সমাধিতে গিয়েছিলাম। ওহ, তুমি ভুলে গেছ কিন্তু আমি মনে রেখেছি! আমি অনেক কিছু মনে রেখেছি। তুমি ভেবেছ সেই পুরোহিত চোরটি আমার এই মূর্তিটি ভেঙে ফেলেছিল যা তুমি আমার সমাধির বাইরে বালিতে পেয়েছিলে। তা নয়। আমি এটি ভেঙেছিলাম কারণ তুমি সাহস করে সেখানে লিখেছিলে "প্রিয় হোরুর" অথচ তোমার লেখার কথা ছিল "প্রিয় দেবতা হোরাসের"। তাই যখন আমাকে সমাধিস্থ করা হচ্ছিল, ফারাও সব জানতেন। তিনি আমার মোড়ক থেকে মূর্তিটি সরিয়ে দূরে ছুঁড়ে ফেললেন। আমি সেই মূর্তিটি তৈরির স্মৃতিও মনে রেখেছি এবং আমার পক্ষ থেকে তোমাকে দেয়া সোনার চেইনটা ব্রোঞ্জের সাথে গলিয়ে ফেলে বলেছিলে যে শুধু সোনাই আমাকে গড়ার উপযুক্ত ধাতু। আর এই সিলমোহরটি যা আমি ধরে আছি—এটি তুমিই তৈরি করেছিলে। এটা নাও, নাও, হোরু আর এর বদলে তোমার হাতে থাকা বেসের আংটিটি আমাকে ফিরিয়ে দাও। এটা নাও এবং যতদিন তুমি আবার মারা না যাও ততদিন পরে থেকো আর একদিন যখন তুমি আবার মরবে সেটাও তোমার সঙ্গে সমাধিতে যাবে যেমন একদিন আমার সঙ্গে গিয়েছিল।

"এখন শোন। যখন সূর্যদেবতা রা আবার উদিত হবেন এবং তুমি জেগে উঠবে তখন তোমার মনে হবে তুমি একটি স্বপ্ন দেখেছো। তোমার মনে হবে এই স্বপ্নে তুমি মিশরের একজন নারীকে দেখেছো এবং তার সাথে কথা বলেছো যে তিন হাজার বছরেরও বেশি আগে মারা গিয়েছিল কিন্তু পাথরে ও ব্রোঞ্জে খোদাই করা যার সৌন্দর্য আজ তোমার হৃদয়কে মুগ্ধ করেছে। তবে জেনে রেখো ও মানুষ, এই ধরনের স্বপ্ন অনেক সময় সত্যের ছায়া হয়। জেনে রেখো এই জ্যোতি যা তোমার সামনে ঝলমল করছে তা সত্যিই আমার, সেই দূর-নিকট ভূমিতে যেখানে আমি চিরকাল বাস করি এবং যা আমার তা তোমার ছিল, আছে এবং চিরকাল তোমারই থাকবে। দেবতারা হয়তো তাদের রাজ্য ও নাম বদলাবে; মানুষ বেঁচে থাকবে, মরবে, আবার বেঁচে উঠবে এবং আবার মরবে; সাম্রাজ্য ভেঙ্গে পরবে এবং যারা শাসন করত তারা বিস্মৃত ধুলোয় পরিণত হবে। তবুও সত্যিকারের ভালোবাসা অমর আত্মাদের মতো অম্লান থাকে যাদের মধ্যে এটা জন্ম নিয়েছিল। আর এই দুঃখ ও বিচ্ছেদের রাত শেষে আসন্ন ভোরে তোমার ও আমার জন্য জন্ম নেবে মিলন ও শান্তির মহিমা। সেই পূর্বনির্ধারিত সময় না আসা পর্যন্ত আমাকে আর খুঁজো না—যদিও আমি চিরকাল তোমার কাছাকাছি থাকব, যেমনটি আমি সবসময় ছিলাম। সেই পরম সময় পর্যন্ত, হোরু, বিদায়।

তিনি তার দিকে ঝুঁকে এলেন; তার মিষ্টি ঠোঁট স্মিথের কপালে স্পর্শ করল; তার নিশ্বাস ও চুলের সুগন্ধ স্মিথকে আচ্ছন্ন করল; তার আশ্চর্য চোখের আলো স্মিথের আত্মার গভীরে প্রবেশ করে সেখানে লেখা উত্তরটি পড়তে লাগল।

স্মিথ তাকে আলিঙ্গন করার জন্য বাহু বাড়িয়ে দিয়ে দেখেন—তিনি নেই।

পরদিন সকালে কায়রো মিউজিয়ামের কেন্দ্রীয় হলের একটি শেষকৃত্যের নৌকার নিচে সিমেন্টের মেঝেতে ঠাণ্ডায় জমে আড়ষ্ট হয়ে শুয়ে থাকা স্মিথের ঘুম ভাঙল। তিনি কাঁপতে কাঁপতে তার আশ্রয়স্থল থেকে বেরিয়ে এলেন এবং দেখলেন গোটা হলঘর গতরাতের মতোই সম্পূর্ণ খালি। ফারাও মেনেস বা সেই সব রাজা-রানীদের কোন চিহ্নই নেই যাদের সে এত স্পষ্টভাবে স্বপ্নে দেখেছিল।

ঘুমে ক্লান্ত ও উত্তেজিত স্নায়ু মনের মধ্যে কত রকম অদ্ভুত কল্পনা আনতে পারে তা ভাবতে ভাবতে স্মিথ বড় দরজার দিকে এগিয়ে গেলেন এবং ছায়ায় দাঁড়িয়ে প্রার্থনা করতে লাগলেন। যদিও সেদিন মুসলমানের ছুটির দিন ছিল তবুও কেউ হয়তো সবকিছু ঠিক আছে কিনা দেখার জন্য জাদুঘর পরিদর্শনে আসবে।

বাস্তবিকই একজন প্রহরী এসে অবহেলায় দরজা খুলে একটা ঘুঘু ও দুটি কাকের লড়াই দেখার জন্য কাঁধের উপর দিয়ে তাকাল। মুহূর্তের মধ্যে স্মিথ প্রহরীকে পেছনে ফেলে পোর্টিকোর নিচ দিয়ে স্মৃতিস্তম্ভ থেকে স্মৃতিস্তম্ভে পাথরের টুকরোগুলোর মধ্যে দিয়ে সাপের মতো সর্পিল গতিতে ছায়ায় লুকিয়ে গেটের দিকে এগিয়ে গেলেন। প্রহরীর হাজারটা প্রশ্নের উত্তর দিতে তিনি একেবারেই অনিচ্ছুক।

প্রহরী তাকে দেখতে পেয়ে ভয়ে চিৎকার করে উঠল; কারণ হঠাৎ কোনো আফ্রিত (ভূত) দেখা অশুভ ব্যাপার। সে মাথা ঘুরিয়ে নিল। যখন আবার ফিরে তাকাল ততক্ষণে স্মিথ গেট পেরিয়ে বাইরের রাস্তায় ভিড়ের সাথে মিশে গেছেন।

স্যাঁতসেঁতে পাথরের মেঝেতে দীর্ঘক্ষণ শুয়ে থাকার ফলে সবচেয়ে খারাপ মিশরীয় ঠাণ্ডা লেগেছে বলে দুশ্চিন্তায় থাকা স্মিথের কাছে সূর্যের আলো খুবই মনোরম মনে হলো। তিনি শেফার্ডস হোটেলের দিকে হেঁটে চললেন এবং এক মাইলেরও কিছুটা দূরের পথে যেতে যেতে হোটেল পোর্টারকে বলার জন্য একটি বিশ্বাসযোগ্য গল্প বানিয়ে ফেললেন। বলবেন যে কিভাবে তিনি পিরামিডের পাশে মেনা হাউসে ডিনার করতে গিয়েছিলেন এবং শেষ ট্রামটি মিস করার ফলে সেখানেই রাত কাটিয়েছিলেন।

এভাবে ব্যস্ত অবস্থায় চলার পথে হঠাৎ করেই তার বাম হাত পকেটে রাখা মা-মি'র স্মৃতিচিহ্ন রাখা সিগার বাক্সের কোণে ধাক্কা খেল। ব্যথায় তিনি তার আঙুলগুলো পরীক্ষা করে দেখলেন আঘাত লেগেছে কিনা এবং দেখলেন তার এক আঙুলে সেই আংটিটি পরা আছে। পরিচালক যে আংটিটি তাকে দিয়েছিলেন নিশ্চয়ই এটা সেই আংটি নয় কারন সেই আংটিতে দেবতা বেসের ছবি খোদাই করা ছিল। আর এটিতে রয়েছে মহারানী মা-মি'র কার্তুজ! আর সে যে স্বপ্ন দেখেছিল - ওহ, সে যে স্বপ্ন দেখেছিল...!

আজও স্মিথ ভাবছেন হয়তো মুহূর্তের তাড়াহুড়োতে তিনি ভুলে গিয়েছিলেন যে পরিচালক সেই আংটিগুলোর মধ্যে কোনটি তাকে রানিদের উপত্যকায় আবিষ্কৃত রাজকীয় সমাধির লুটের ভাগ হিসেবে দিয়েছিলেন। পরে স্মিথ জানতে চেয়ে চিঠি লিখেছিলেন কিন্তু পরিচালক শুধু মনে করতে পারলেন যে তিনি তাকে দুটি আংটির একটি দিয়েছিলেন এবং তাকে আশ্বাস দিলেন যে "বেস আংক, আংক বেস" খোদাই করা আংটিটি মা-মি'র অন্যান্য গহনার সাথে জাদুঘরের গোল্ড রুমে আছে।

স্মিথ আরও ভাবছেন, মিশরের প্রাচীন রাজপরিবারের অন্য কোনো ব্রোঞ্জের মূর্তিতে কি মা-মি'র ভাঙা মূর্তির মতো এত বেশি সোনার অংশ থাকে? কারণ মা-মি যেন তাকে মূর্তি গড়ার সময় সোনার চেইন গলানোর গল্পটি বলেছিলেন।

সবটাই কি কেবল স্বপ্ন ছিল নাকি এটি—আরও কিছু—দিনরাত তিনি শূন্যতার কাছে প্রশ্ন করেন?

কিন্তু মা-মী, কাছে থাকুক বা দূরে, কোনো উত্তর দেয় না। যার গর্বিত উপাধিগুলো ছিল: "মহারানী, ওসাইরিসের ন্যায়বিচারপ্রাপ্ত দেবী; আমেনের কন্যা, রাজকীয় উত্তরাধিকারিণী, রাজকীয় বোন, রাজকীয় স্ত্রী, রাজকীয় জননী; দুই ভূমির অধিশ্বরী; শ্বেত ও রক্তিম দ্বৈত মুকুটের ধারক; প্রেমের মিষ্টি ফুল, চিরসুন্দরী।

তাই আমাদের মতোই স্মিথকেও অনেক সত্য জানার জন্য অপেক্ষা করতে হবে—বিশেষ করে দুইটি প্রাচীন সোনার আংটির মধ্যে কোনটি পরিচালক তাকে কায়রোতে দিয়েছিলেন।

এটি একটি সামান্য ব্যাপার মনে হলেও তার কাছে এটা সমগ্র জগতের চেয়েও বেশি মূল্যবান!

তার সহকর্মীদের বিস্মিত করে স্মিথ আর কখনো মিশরে ফিরে যাননি। তিনি তাদের বোঝান যে তার স্বাস্থ্য সম্পূর্ণরূপে পুনরুদ্ধার হয়েছে এবং তার আর বার্ষিক জলবায়ু পরিবর্তনের প্রয়োজন নেই।

এখন প্রশ্ন হলো - মহারানী মা-মি'র মমিকৃত হাতে পরিচালক স্মিথকে দুটি রাজকীয় আংটির মধ্যে কোনটি ফিরিয়ে দিয়েছিলেন?"

_______সমাপ্ত_______

ই-মেইল সাবস্ক্রিপশন

Enter your email address:

Delivered by FeedBurner

ক্যাটাগরীসমূহ

পৃষ্ঠাসমূহ

Creative Commons License
This work is licensed under a Creative Commons Attribution 3.0 Unported License.
Protected by Copyscape

ব্লগটি মোট পড়া হয়েছে

বাঙলা ব্লগ. Powered by Blogger.

- Copyright © মেহেদী হাসান-এর বাঙলা ব্লগ | আমার স্বাধীনতা -Metrominimalist- Powered by Blogger - Designed by Mahedi Hasan -