অ্যামব্রোজ গুইনেট বিয়ার্স ছিলেন একজন আমেরিকান ছোটগল্প লেখক, সাংবাদিক, কবি এবং আমেরিকান সিভিল ওয়ারের সৈনিক। তার বিখ্যাত গল্প "অ্যান অকারেন্স অ্যাট আউল ক্রিক ব্রিজ" প্রথম প্রকাশিত হয় ১৮৯০ সালের ১৩ই জুলাই দ্য সান ফ্রান্সিসকো এক্সামিনার পত্রিকায় এবং পরে "টেলস অফ সোলজার্স অ্যান্ড সিভিলিয়ান্স" (১৮৯১) সংকলনে এটি স্থান পায়। এই সংকলনটি দুটি ভাগে বিভক্ত—"সোলজার্স" এবং "সিভিলিয়ান্স"। এই নির্দিষ্ট গল্পটি "সোলজার্স" অংশের অন্তর্ভুক্ত।
আমেরিকার উত্তর আলাবামার এক রেলসেতুর উপর দাঁড়িয়ে একজন লোক তার নিচের বিশ ফুট দূরে দ্রুত প্রবাহমান পানির দিকে তাকিয়ে ছিল। লোকটির হাত পিছনে নিয়ে কব্জিগুলো দড়ি দিয়ে শক্ত করে বাঁধা। তার গলায় শক্ত করে পেঁচানো একটি দড়ি যা তার মাথার উপরকার একটি মোটা ক্রসবারের সাথে যুক্ত এবং দড়ির ঢিলে অংশ তার হাঁটু পর্যন্ত নেমে এসেছে।
রেললাইনের ওপর রাখা কিছু আলগা তক্তা দিয়ে তার এবং মৃত্যুদণ্ড কার্যকরকারীদের জন্য দাঁড়ানোর জায়গা তৈরি করা হয়েছে। বেসামরিক জীবনে ডেপুটি শেরিফ হিসেবে কর্মরত থাকা একজন সার্জেন্ট, ফেডারেল সেনাবাহিনীর দুইজন প্রাইভেট সৈনিককে বিভিন্ন নির্দেশ দিচ্ছিলেন। একই অস্থায়ী প্ল্যাটফর্মে কিছুটা দূরে বিশেষ পদমর্যাদার ইউনিফর্ম পরিহিত একজন সশস্ত্র অফিসার দাঁড়িয়ে ছিলেন। তিনি একজন ক্যাপ্টেন। সেতুর দুই প্রান্তে একজন করে প্রহরী তাদের রাইফেল তাক করে দাঁড়িয়ে ছিল অর্থাৎ বাম কাঁধের সামনে উল্লম্বভাবে, রাইফেলের হাতল সোজা বুকের উপর প্রসারিত বাহুর উপর রাখা—এটি একটি আনুষ্ঠানিক ও অস্বাভাবিক ভঙ্গি যা দেহকে সম্পূর্ণ সোজা রাখতে বাধ্য করে। সেতুর দুই প্রান্ত অবরোধ করে রাখাই তাদের দায়িত্ব—মাঝখানে কী ঘটছে তা তাদের জানার প্রয়োজন নেই।
একজন প্রহরী ছাড়া আর কাউকে দেখা যাচ্ছিল না; রেললাইনটি সোজা একশ গজ বনের মধ্যে চলে গিয়ে বাঁক নিয়ে চোখের আড়ালে অদৃশ্য হয়ে গেছে। সম্ভবত আরও দূরে কোনো আউটপোস্ট ছিল। নদীর অপর পাড়ে খোলা মাঠের মধ্যে ঢালের ওপরে খাড়াখাড়ি গাছের গুঁড়ি দিয়ে তৈরি একটি বেড়া যার মধ্যে রাইফেলের লুপহোল করা আর একটি মাত্র ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে আছে সেতুর দিকে তাক করা পিতলের কামানের নল।
কৌতূহলী দর্শকরা সেতু ও দুর্গের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে। পদাতিক বাহিনীর একটি দল প্যারেড রেস্ট অবস্থায় রাইফেলের বাট মাটিতে; ব্যারেলগুলি ডান কাঁধের উপর পিছনে হেলান দিয়ে আর হাতগুলো স্টকের উপর আড়াআড়ি রেখে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে আছে। সারির ডানদিকে বাম হাত ডান হাতের উপর আর তলোয়ারের ডগা মাটিতে গেঁথে একজন লেফটেন্যান্ট দাঁড়িয়ে আছেন। সেতুর মাঝখানে থাকা চারজন ছাড়া একটি মানুষও নড়ছিল না। সমস্ত জটলা সেতুর দিকে মুখ করে পাথরের মতো স্থির নিস্পলক তাকিয়ে ছিল। নদী পাড়ের দিকে মুখ করে থাকা প্রহরীগুলো মূর্তির মতো নিশ্চল হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। ক্যাপ্টেন বাহু গুটিয়ে নীরবে দাঁড়িয়ে অধীনস্থদের কাজ পর্যবেক্ষণ করছিলেন—কোনো সংকেত দিচ্ছিলেন না। মৃত্যু যেন এক মর্যাদাসম্পন্ন অতিথি যার আগমন ঘোষণা করা হলে তাকেও সম্মানের সঙ্গে গ্রহণ করতে হয়—এমনকি যারা তার সাথে সবচেয়ে বেশি পরিচিত তারাও। সামরিক শিষ্টাচারের নিয়মে নীরবতা ও নিশ্চলতা হচ্ছে শ্রদ্ধার বহিঃপ্রকাশ।
যে লোকটির ফাঁসি কার্যকর হতে চলেছিল তার বয়স সম্ভবত পঁয়ত্রিশের মতো। বেশভূষা দেখে মনে হচ্ছিল তিনি একজন বেসামরিক ব্যক্তি—সম্ভবত একজন চাষী। সোজা নাক, দৃঢ় মুখমণ্ডল ও প্রশস্ত কপালের একজন সুশ্রী পুরুষ। পিছনের দিকে আঁচড়ানো লম্বা কালো চুলগুলো কানের পাশ দিয়ে তার সুবিন্যস্ত ফ্রক কোটের কলার পর্যন্ত নেমে এসেছে। গোঁফ ও সূঁচালো দাড়ি থাকলেও কোন জুলফি নেই। গাঢ় ধূসর বর্ণের বড় বড় চোখ দুটুতে এক সদয় অভিব্যক্তি ফুটে উঠছিল যা সাধারণত ফাঁসির দড়িতে ঝুলন্ত ব্যক্তির মধ্যে আশা করা যায় না। স্পষ্টতই ইনি কোনো সাধারণ খুনি ছিলেন না। উদার সামরিক বিধিমালায় অনেক প্রকারের লোকের ফাঁসির ব্যবস্থা আছে এবং ভদ্রলোকরাও এর বাইরে নয়।
প্রস্তুতি সম্পন্ন হওয়ার পর দুইজন সৈনিক একপাশে সরে দাঁড়িয়ে আলগা তাক্তাগুলো সরিয়ে নিল। সার্জেন্ট ক্যাপ্টেনের দিকে ঘুরে স্যালুট করল এবং সেই অফিসারের ঠিক পিছনে গিয়ে দাঁড়াল। এই গতিবিধির ফলে দণ্ডিত লোকটি এবং সার্জেন্ট একই তক্তার দুই প্রান্তে দাঁড়িয়ে রইল যেটা সেতুর তিনটি আড়াআড়ি কাঠকে সংযুক্ত করে ছিল। বেসামরিক ব্যক্তি যে প্রান্তে দাঁড়িয়েছিল সেটা চতুর্থ ক্রসবার পর্যন্ত পৌঁছেছিল। এই তক্তাটি ক্যাপ্টেনের ওজনে এতক্ষণ স্থির ছিল; এখন সেটি সার্জেন্টের ওজনে স্থির রইল। ক্যাপ্টেনের ইশারায় সার্জেন্ট সরে গেলে তক্তাটি কাত হয়ে যাবে এবং দণ্ডিত লোকটি দুটি ক্রসবারের মাঝখান দিয়ে নিচে পড়ে যাবে। এই ব্যবস্থা তার বিচার অনুযায়ী সহজ এবং কার্যকর মনে হয়েছিল। তার মুখ বা চোখ কোনটাই বাঁধাও হয়নি। সে এক মুহূর্ত তার পায়ের নিচ দিয়ে উন্মত্ত বেগে বয়ে চলা নদীর ঘূর্ণায়মান পানির দিকে তাকাল। কাঁপতে থাকা ভাসমান কাঠের একটি টুকরো তার দৃষ্টি আকর্ষণ করল এবং তার চোখ স্রোতের সাথে সেটাকে অনুসরণ করল। কত ধীর গতিতে এটি চলছিল! কী অলস স্রোত!
স্ত্রী ও সন্তানদের কথা শেষবারের মতো স্মরণ করার জন্য সে চোখ বন্ধ করল। ভোরের সূর্যের স্পর্শে সোনালি হয়ে ওঠা জলরাশি, নদীতীরের কিছু দূরবর্তী স্থানে জমে থাকা ঘন কুয়াশা, কেল্লা, সৈন্যদল, আর সেই ভাসমান কাঠের টুকরো - সবকিছুই তার মনোযোগে বাধা দিচ্ছিল। এবার সে নতুন এক গোলমালের আভাস পেল; প্রিয়জনের স্মৃতির মাঝেই হঠাৎ একটি তীক্ষ্ণ স্পষ্ট ধাতব শব্দ কানে এল—যেন কামারের হাতুড়ি নেহাইয়ের উপর পড়ছে। সে ভাবল এটা কী? খুব দূরে নাকি একেবারে কাছে? যদিও দুটোই মনে হচ্ছিল। শব্দটি মৃত্যুর ঘণ্টাধ্বনির মত ধীরে ধীরে কিন্তু নিয়মিত বিরতিতে হচ্ছিল। প্রতিবার নতুন শব্দের জন্য সে অধৈর্য হয়ে অপেক্ষা করছিল এবং কেন জানি না—ভয়ে শঙ্কিত হচ্ছিল। নীরবতার বিরতি ক্রমশ দীর্ঘ হতে লাগল; প্রতীক্ষা তাকে পাগল করে তুলছিল। শব্দের ধারাবাহিকতা কমার সাথে সাথে সেটা আরও জোরালো ও তীক্ষ্ণ হয়ে উঠছিল। এগুলো ছুরির আঘাতের মতো কানে খোঁচা মারছিল; তার মনে হচ্ছিল সে চিৎকার করে উঠবে। আসলে সে তার নিজের ঘড়ির টিকটিক শব্দ শুনছিল।
চোখ খুলে আবার সে নিচের জলরাশির দিকে তাকাল। "যদি হাত ছাড়াতে পারতাম" সে ভাবল, "তাহলে হয়ত ফাঁস খুলে নদীতে ঝাঁপিয়ে পরতাম। ডুব দিয়ে গুলি এড়িয়ে সজোরে সাঁতরে তীরে পৌঁছাতে পারতাম। তারপর জঙ্গলে ঢুকে বাড়ি পালাতে পারতাম। আল্লাহকে ধন্যবাদ যে আমার বাড়ি এখনও শত্রুদের সীমানার বাইরে; আমার স্ত্রী ও ছোট্ট সন্তানরা এখনও আক্রমণকারীদের শেষ সীমান্তেরও ওপারে।"
পর্বঃ দুই
পেইটন ফারকুহার ছিলেন আলাবামার একটি প্রাচীন ও উচ্চমর্যাদাসম্পন্ন পরিবারের একজন স্বচ্ছল জমিদার। দাসমালিক এবং অন্যান্য দাসমালিকদের মতোই একজন রাজনীতিবিদ হিসেবে তিনি স্বাভাবিকভাবেই ছিলেন মূল বিচ্ছিন্নতাবাদী এবং দক্ষিণের আদর্শের প্রতি একনিষ্ঠ ভক্ত।
এখানে বলা অপ্রয়োজনীয় এমন কিছু জরুরি পরিস্থিতির কারণে তিনি সেই বীর সেনাবাহিনীতে যোগ দিতে পারেননি যে সেনাবাহিনী করিন্থের পতনের মাধ্যমে শেষ হওয়া দুর্ভাগ্যজনক অভিযানে লড়েছিল। এই অগৌরবজনক নিষেধাজ্ঞায় তিনি অস্থির হয়ে উঠেছিলেন; বস্তুত সৈনিকের বৃহত্তর জীবন ও খ্যাতি অর্জনের সুযোগের জন্য তিনি ব্যাকুল ছিলেন। তিনি বিশ্বাস করতেন যুদ্ধের সময় যেভাবে সবার জীবনে সুযোগ আসে—তারও আসবে। এদিকে তিনি যা পারতেন তাই করতেন। দক্ষিণের পক্ষে কোনো কাজই তার কাছে তুচ্ছ ছিল না এবং কোনো দুঃসাহসিক কাজই তার পক্ষে খুব বেশি বিপজ্জনক মনে হতো না যদি তা একজন বেসামরিক ব্যক্তির চরিত্রের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়। তিনি মনেপ্রাণে একজন সৈনিক ছিলেন এবং আন্তরিকভাবে খুব বেশি দ্বিধা ছাড়াই অন্তত আংশিকভাবে সেই নৃশংস উক্তিতে সম্মতি দিয়েছিলেন যে প্রেম ও যুদ্ধে সবকিছুই ন্যায্য।
এক সন্ধ্যায় ফারকুহার ও তার স্ত্রী তাদের বাড়ির প্রবেশপথের কাছে একটি কাঠের বেঞ্চে বসে ছিলেন। এমন সময় ধূসর পোশাকে একজন সৈনিক ঘোড়ায় চড়ে গেটের কাছে এসে এক গ্লাস পানি চাইল। মিসেস ফারকুহার খুশি মনে নিজ হাতে তাকে পানি দিলেন। তিনি যখন পানি আনতে যাচ্ছিলেন তখন তার স্বামী সেই ধুলোমাখা অশ্বারোহীর কাছে গিয়ে উৎসুকভাবে যুদ্ধক্ষেত্রের খবর জিজ্ঞেস করলেন।
"ইয়াঙ্কিরা রেললাইন মেরামত করছে" সৈন্যটি বলল "এবং আরেকটি আক্রমণের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। তারা আউল ক্রিক ব্রিজ পর্যন্ত পৌঁছে সেটি ঠিকঠাক করেছে এবং উত্তর পাড়ে একটি বেড়া (স্টকেড) তৈরি করেছে। কমান্ডেন্ট এর জারি করা একটি আদেশ সর্বত্র টাঙানো হয়েছে—যাতে ঘোষণা করা হয়েছে যে রেলপথ, সেতু, টানেল বা ট্রেনে হস্তক্ষেপ করতে গিয়ে কোনও বেসামরিক নাগরিক ধরা পড়লে তাকে তৎক্ষণাৎ ফাঁসি দেওয়া হবে। আমি সেই আদেশ দেখেছি।"
"আউল ক্রিক ব্রিজটি এখান থেকে কত দূরে?" ফারকুহার জিজ্ঞেস করল।
"প্রায় ত্রিশ মাইল।"
"ক্রিকের এপারে কি কোনও সৈন্যবাহিনী নেই?"
"শুধু রেললাইনের উপর আধমাইল দূরে একটা পিকেট পোস্ট, আর সেতুর এ মাথায় একজন প্রহরী।"
"ধরুন বেসামরিক এবং ফাঁসির ব্যাপারে অভিজ্ঞ একজন লোক—পিকেট পোস্ট এড়িয়ে এবং হয়তো প্রহরীকেও কাবু করতে পারল," ফারকুহার হেসে বললেন, "তাহলে সে কী করতে পারবে?"
সৈনিক খানিকটা ভেবে বলল "আমি এক মাস আগে সেখানে ছিলাম। দেখেছি গত শীতের বন্যায় সেতুর এ মাথার কাঠের খুঁটির সাথে প্রচুর ভাসমান কাঠ জমে আছে। এখন সেগুলো শুকনো এবং বারুদের মতো জ্বলবে।"
ততক্ষণে ভদ্রমহিলা পানি নিয়ে এসেছেন, সৈনিকটি তা পান করল। সে বিনীতভাবে তাকে ধন্যবাদ জানিয়ে তার স্বামীকে কিঞ্চিৎ বাউ করে ঘোড়া নিয়ে চলে গেল। এই ঘটনার ঘণ্টাখানেক পর রাতের অন্ধকারে সেই বাড়ী পেরিয়ে সৈনিকটি যে দিক থেকে এসেছিল সেই উত্তর দিকে চলে গেল। মূলত সে ছিল একজন ফেডারেল গুপ্তচর।
পর্বঃ তিন
পেইটন ফারকুহার সেতু থেকে সোজা নিচের দিকে পড়তে পড়তে জ্ঞান হারিয়ে ফেললেন, যেন মরেই গেছেন। মনে হলো যেন বহুযুগ পরে এই অবস্থা থেকে তিনি জেগে উঠলেন। গলায় এক তীব্র ব্যথা এবং এর পরে শ্বাসরোধের অনুভূতি হলো। তীব্র, তীক্ষ্ণ যন্ত্রণা তার গলা থেকে শরীরের প্রতিটি তন্তু ও অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের দিকে নেমে যেতে লাগল। এই ব্যথাগুলো স্পষ্ট শাখা-প্রশাখায় বিভক্ত পথ ধরে বিদ্যুতের মতো ছুটে বেড়াচ্ছিল এবং অবিশ্বাস্য গতিতে স্পন্দিত হচ্ছিল। মনে হচ্ছিল যেন জ্বলন্ত আগুনের স্রোত তাকে অসহনীয় তাপমাত্রায় পুড়িয়ে দিচ্ছে। মাথার ভেতর রক্ত জমাট বাঁধার মতো এক ধরনের শিরশির অনুভূতি হচ্ছিল। এই অনুভূতিগুলোর সাথে কোন চিন্তা জড়িত ছিল না। তার বুদ্ধিবৃত্তিক অংশ ইতিমধ্যেই লুপ্ত হয়ে গিয়েছিল; তার কেবল অনুভব করার ক্ষমতা অবশিষ্ট ছিল আর তা ছিল এক ভয়াবহ যন্ত্রণা।
তিনি নিজের গতিবিধি উপলব্ধি করতে পারছিলেন। এক উজ্জ্বল মেঘে আবৃত হয়ে তার জ্বলন্ত হৃদয় অকল্পনীয়ভাবে একটি বিশাল পেন্ডুলামের মতো দুলছিলো। তারপর হঠাৎ এক ভয়াবহ আকস্মিকতায় তার চারপাশের আলো একটি জোরে ছপাঁছ শব্দ করে উপরের দিকে ছুটে গেল; তৎক্ষণাৎ তার কানে ভেসে এল এক ভয়ঙ্কর গর্জন—তারপর সবকিছু ঠাণ্ডা ও অন্ধকারে ঢেকে গেল।
চিন্তার ক্ষমতা ফিরে এলে বুঝতে পারলেন যে তিনি দড়িটি ছিঁড়ে নদীতে পরে গেছেন। অতিরিক্ত কোন শ্বাসরোধ হচ্ছিল না; তার গলার ফাঁস ইতিমধ্যেই তাকে শ্বাসরুদ্ধ করে রেখেছিল এবং ফুসফুসে পানি ঢুকতে বাঁধা দিচ্ছিল।
নদীর তলায় ফাঁসিতে মরা!—ব্যাপারটা তার কাছে হাস্যকর মনে হলো। তিনি অন্ধকারে চোখ খুলে উপরে এক ঝলক আলো দেখতে পেলেন কিন্তু কত দূরে আর কতই না দুর্গম! তিনি তখনও ডুবে চলেছেন কারণ আলো ক্রমশ ম্লান হয়ে হয়ে শুধু একটা ক্ষীণ আভায় পরিণত হলো। তারপর আলো আবার বাড়তে ও উজ্জ্বল হতে শুরু করল এবং বুঝতে পারলেন যে তিনি পানির উপরের দিকে উঠছেন।
"ফাঁসিতে ঝুলে ডুবে মারা" তিনি ভাবলেন "এটা তেমন খারাপ না; কিন্তু গুলি খেয়ে মরতে চাই না।
না; গুলি খেতে চাই না; এটা ন্যায়সঙ্গত হবেনা।
যদিও তিনি সচেতনভাবে কোন চেষ্টাই করছিলেন না কিন্তু কবজিতে তীব্র ব্যথা জানিয়ে দিল যে তিনি অবচেতনভাবে হাত মুক্ত করার চেষ্টা করছেন। বাঁধন খুলতে পারবেন কি পারবেন না এই ফলাফলের ব্যাপারে চিন্তা না করেই তিনি হাত মুক্ত করার কাজে সম্পূর্ণ মনোযোগ দিলেন।
কী দুর্দান্ত প্রয়াস!—কী চমৎকার, কী অতিমানবীয় শক্তি!
আহ, এটা ছিল এক দারুণ প্রচেষ্টা! শাবাশ!
দড়িটি খুলে গেল; তার বাহুগুলো আলাদা হয়ে উপরে ভাসল। ক্রমবর্ধমান আলোয় হাত দুটি অস্পষ্টভাবে দেখা যাচ্ছিল। নতুন আগ্রহ নিয়ে তিনি দুই হাত দিয়ে গলায় ফাঁসের দড়ি খুলতে লাগলেন। কিছুক্ষণের প্রচেষ্টায় সেটা ছিঁড়ে গেল এবং তিনি সজোরে সেটাকে দূরে ছুড়ে মারলেন। দড়িটাকে তখন জলসাপের মত দেখাচ্ছিল।
"এটাকে ফিরিয়ে দাও, ফিরিয়ে দাও!" মনে হলো তিনি হাত দুটোর দিকে চিৎকার করে এই কথা বললেন কারন ফাঁসটি খোলার পরেই তিনি জীবনের সবচেয়ে ভয়াবহ যন্ত্রণা অনুভব করলেন। তার গলা ভয়ানকভাবে ব্যথা করতে লাগল; মগজ জ্বলছিল আর মৃদুভাবে স্পন্দিত হৃদয় একটা বিশাল লাফ দিয়ে মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করল।
তার সমস্ত শরীর এক অসহনীয় যন্ত্রণায় মোচড় দিচ্ছিল! কিন্তু তার অবাধ্য হাত দুটো আদেশের তোয়াক্কা করল না। তারা দ্রুত নিচের দিকে স্ট্রোক দিয়ে প্রবলভাবে পানিতে আঘাত করে তাকে উপরের দিকে ঠেলে দিল। অবশেষে মাথা ভেসে উঠলো; মনে হলো প্রবল সূর্যালোক চোখ ঝলসে দিয়েছে। তার বুক কাঁপতে লাগল আর সর্বোচ্চ যন্ত্রণায় তার ফুসফুস বিশাল এক শ্বাস নিল যা তৎক্ষণাৎ এক চিৎকারে বের করে দিল!
তার শারীরিক ইন্দ্রিয়গুলো এখন পুরোপুরি সচেতন হয়ে উঠেছে। বরং সেগুলো অস্বাভাবিক রকমের তীক্ষ্ণ আর সতর্ক হয়ে গেছে। তার শরীরের সেই ভয়াবহ বিপর্যয়ের মধ্যে এমন কিছু ঘটেছে যা তাঁর ইন্দ্রিয়গুলিকে এতটাই উন্নত ও পরিশীলিত করেছে যে তারা এমন সব জিনিসের রেকর্ড রাখছিল যা আগে কখনো অনুভূত হয়নি। তিনি তার মুখে ঢেউয়ের স্পর্শ অনুভব করতে পারছেন এমনকি প্রতিটি ঢেউ আঘাত করার আলাদা আলাদা শব্দ শুনতে পাচ্ছিলেন। তিনি নদীতীরের বনভূমির দিকে তাকিয়ে প্রতিটি গাছ, প্রতিটি পাতার শিরা-উপশিরা—এমনকি পাতার উপর বসে থাকা কীটপতঙ্গগুলোও দেখতে পেলেন। সেখানে রয়েছে পঙ্গপাল, চকচকে শরীরের মাছি এবং ধূসর রঙের মাকড়সাগুলো ডাল থেকে ডালে তাদের জাল বুনছিল। এইতো লক্ষ কোটি ঘাসের পাতায় জমে থাকা শিশিরবিন্দুর রংধনুর মতো রং তিনি দেখতে পাচ্ছেন। নদীর ঘূর্ণায়মান পানিতে নেচে বেড়ানো মশার গুঞ্জন, ফড়িংদের ডানার ঝাপটানি, নৌকার দাঁড় টানা শব্দের মত জলমাকড়শার সাঁতার—এ সবই তাঁর কানে শ্রুতিমধুর সুরের মতো বাজছিল। একটি মাছ তাঁর চোখের সামনে দিয়ে সাঁতার কাটল এবং মাছের দেহে জল কাটার শব্দ তিনি শুনতে পেলেন।
নদীর স্রোতের দিকে মুখ করে তিনি যখন পানির উপর ভেসে উঠলেন মুহূর্তের মধ্যেই দৃশ্যমান জগতটি ধীরে ধীরে ঘুরতে লাগল যেন তিনিই সেই ঘূর্ণনের কেন্দ্রবিন্দু। তিনি দেখতে পেলেন সেই সেতু, কেল্লা, সেতুর উপর দাঁড়ানো সৈন্যরা, ক্যাপ্টেন, সার্জেন্ট, দুজন প্রহরী—যারা তাঁর ফাঁসির দায়িত্বে ছিল। নীল আকাশের পটভূমিতে তাদের অবয়ব কালো ছায়ার মতো দেখাচ্ছে। তারা তাঁর দিকে আঙুল তুলে চিৎকার ও ইশারা করছিল। ক্যাপ্টেন তার পিস্তল বের করেছিলেন কিন্তু গুলি করেননি; বাকিরা নিরস্ত্র ছিল। তাদের নড়াচড়া ছিল উদ্ভট ও ভয়ঙ্কর।
হঠাৎ একটি তীক্ষ্ণ গুলির শব্দ শুনে তিনি চমকে উঠলেন এবং কিছু একটা তাঁর মাথার কয়েক ইঞ্চি কাছেই পানিতে সজোরে আঘাত করে তাঁর মুখে জলকণা ছিটিয়ে দিল। দ্বিতীয় গুলির শব্দ শুনে তিনি দেখলেন সেতুর এক প্রান্তে একজন প্রহরী রাইফেল কাঁধে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে এবং রাইফেলের নল থেকে নীল ধোঁয়ার একটি হালকা মেঘ উঠছে। তিনি দেখলেন সেতুর উপর দাঁড়ানো লোকটি রাইফেলের টার্গেটের মাধ্যমে তার দিকে তাকিয়ে আছে। তিনি লক্ষ্য করলেন সেটা একটি ধূসর রঙের চোখ এবং তাঁর মনে পড়ল তিনি পড়েছিলেন যে ধূসর চোখই সবচেয়ে তীক্ষ্ণ হয় এবং সকল বিখ্যাত নিশানাবাজদের এমন চোখই থাকে। তবুও এই লোকটির নিশানা লক্ষ্যভ্রষ্ট হচ্ছিলো।
একটি বিপরীত ঘূর্ণিস্রোত ফারকুহারকে ধরে নিয়ে অর্ধেক ঘুরিয়ে দিল; তিনি আবার কেল্লার বিপরীত তীরের জঙ্গলের দিকে তাকালেন। তার পিছন থেকে একটি স্পষ্ট উচ্চ কণ্ঠস্বরের একঘেয়ে সুরেলা ধ্বনি ভেসে এল এবং পানির উপর দিয়ে এমন স্পষ্টতার সাথে আসল যা অন্য সমস্ত শব্দকে, এমনকি তার কানে ঢেউয়ের শব্দকেও স্তব্ধ করে দিল। যদিও তিনি সৈনিক নন তবুও ক্যাম্পে এতটা সময় কাটিয়েছেন যে সেই ধীর, টানা, উচ্চারিত সুরের ভয়াবহ তাৎপর্য বুঝতে একটুও দেরি হলোনা। তীরে থাকা লেফটেন্যান্ট কতটা ঠাণ্ডা মাথায় ও নিষ্ঠুরভাবে—কতটা শান্ত স্বরে নিখুঁত মাপা বিরতিতে সেই নিষ্ঠুর শব্দগুলো উচ্চারণ করছিলঃ
"কোম্পানি!... অ্যাটেনশন!... শোল্ডার আর্মস!... রেডি!... এইম!... ফায়ার!"
ফারকুহার যতটা সম্ভব গভীরে ডুব দিলেন। তাঁর কানে পানির গর্জন নায়াগ্রার মতই প্রবল শোনালো তবুও তিনি গুলির মন্থর বজ্রধ্বনি শুনতে পেলেন। আবার উপরের দিকে উঠতে গিয়ে দেখলেন অদ্ভুতভাবে চ্যাপ্টা হয়ে যাওয়া কতগুলো চকচকে ধাতুর টুকরো ধীর গতিতে নিচে নেমে যাচ্ছে। কিছু টুকরো তাঁর মুখ ও হাতে স্পর্শ করল, তারপর পিছলে দূরে সরে গিয়ে তাদের পতন অব্যাহত রাখল। একটা টুকরো তাঁর কলার এবং ঘাড়ের মাঝখানে আটকে গেল; সেটা অস্বস্তিকর গরম ছিল তাই দ্রুত সেটাকে বের করে ফেলে দিলেন।
শ্বাস নেওয়ার জন্য পানির উপরে উঠে এসে হাঁপাতে হাঁপাতে দেখলেন তিনি অনেকক্ষণ পানির নিচে ছিলেন। তিনি স্রোতের টানে বেশ খানিকটা দূরে নিরাপদ স্থানের আরও কাছাকাছি চলে এসেছেন। সৈন্যরা পুনরায় গুলি ভরা শেষ করেছে। ব্যারেল থেকে বের করে বাতাসে ঘুরিয়ে সকেটে ঢোকানোর সময় ধাতব রামরডগুলো একসাথে রোদে চকচক করে উঠলো। দুজন প্রহরী আবার গুলি করল। এক নিষ্ফল প্রচেষ্টা।
পলায়নরত মানুষটি স্রোতের সাথে প্রবলভাবে সাঁতার কাটতে কাটতে তার কাঁধের উপর দিয়ে এই সব দেখতে পেলেন। তার হাত-পায়ের মত মাথাটাও সক্রিয় ছিল; তিনি বিদ্যুতের গতিতে চিন্তা করলেন:
"অফিসারটি" তিনি যুক্তি দিলেন, "সেই প্রহরীটির মত দ্বিতীয়বার ভুল করবেন না। একটি গুলিকে এড়ানো সহজ। তিনি সম্ভবত ইতিমধ্যেই ইচ্ছামতো গুলি করার আদেশ দিয়েছেন। আল্লাহ আমাকে সাহায্য করুন, আমি সবগুলো গুলি এড়াতে পারব না!"
তার মাথার কাছাকাছি প্রায় দুই গজ দূরে একটা ভয়ানক ছপাৎ শব্দ হল তারপর একটা জোরালো গর্জন যেন ক্রমশ ক্ষীণ হয়ে বাতাসে ভেসে কেল্লার দিকে ছড়িয়ে পড়ল এবং একটি বিস্ফোরণের মাধ্যমে শেষ হলো যা নদীর গভীরতম অংশকেও কাঁপিয়ে দিল! পানির একটি উঁচু ঢেউ তার ওপর আছড়ে পরে তাকে প্রায় একইসঙ্গে অন্ধ ও শ্বাসরোধ করে ফেলল। কামান এবার খেলায় অংশ নিয়েছে। আঘাতপ্রাপ্ত পানির আলোড়ন থেকে মাথা উঠাতেই শোনা গেল বিচ্যুত গোলাটি বাতাসে গুঞ্জন করে এগিয়ে যাচ্ছে এবং মুহূর্তেই সেটা ওপারের জঙ্গলে গাছের ডালপালা ভেঙে চুরমার করে দিচ্ছে।
"ওরা আর এটা করবে না" তিনি ভাবলেন, "পরের বার ওরা গ্রেপশট ব্যবহার করবে। আমাকে কামানের ওপর নজর রাখতে হবে; ধোঁয়া আমাকে সতর্ক করবে—গর্জনটা তো গোলার পেছনে পেছনে দেরি করে আসে। ভালো কামান বটে।"
হঠাৎ অনুভব করলেন তিনি চারপাশে লাটিমের মতো ঘুরছেন। পানি, তীর, জঙ্গল, অনেক দূরের সেতু, কেল্লা আর মানুষগুলো সব মিলেমিশে অস্পষ্ট হয়ে গেছে। জিনিসগুলো শুধু তাদের রঙ দিয়ে চেনা যাচ্ছিলো। তিনি একটা ঘূর্ণিস্রোতে আটকে গেছেন এবং এত দ্রুত গতিতে এগিয়ে যাচ্ছেন আর ঘুরছেন যে তার মাথা ঘুরে উঠল এবং বমি পেতে লাগল। কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই তিনি নদীর দক্ষিণ পাড়ের পাদদেশে নুড়িপাথরের ওপর ছিটকে পড়লেন এবং একটা বেরিয়ে থাকা শিলার পিছনে এসে পড়লেন যা তাকে শত্রুদের কাছ থেকে আড়াল করে রেখেছিল। আকস্মিক গতি থামায় আর নুড়িতে একটা হাতের ছড়ে যাওয়ায় তার হুঁশ ফিরল এবং তিনি আনন্দে কেঁদে ফেললেন।
আঙুল দিয়ে বালিতে খোঁচা দিলেন, মুঠো মুঠো করে নিজের ওপর ছিটিয়ে দিলেন আর চিৎকার করে সেই বালিকে ধন্যবাদ জানাতে লাগলেন। বালিগুলো দেখতে হীরে, মানিক, পান্নার মতো লাগছিল; সুন্দর বলতে যা কিছু আছে তার সবকিছুর সাথেই তিনি বালির মিল খুঁজে পেলেন। তীরের গাছগুলো দেখতে লাগছে বিশাল বাগানের গাছের মতো। তাদের সাজানোর মধ্যে একটা নির্দিষ্ট ক্রম লক্ষ করলেন, বুকভরে তাদের ফুলের সুগন্ধ নিলেন। গাছের কাণ্ডের ফাঁক দিয়ে একটা অদ্ভুত গোলাপি আলো ঝলমল করছিল আর বাতাস তাদের ডালপালায় বাতাসী বীণার সুর তুলছিল। তার পালাতে ইচ্ছে করছিলো না—পুনরায় ধরা পড়ার আগ পর্যন্ত এই মোহনীয় জায়গায় থেকে যেতে পারলেই তিনি খুশি হতেন।
মাথার ওপর গাছের ডালপালার মধ্যে গ্রেপশটের শোঁ শোঁ শব্দ আর খটখট আওয়াজে তার স্বপ্নভঙ্গ হলো। হতাশ কামানের গোলন্দাজ তাকে বিদায় জানাতে এলোমেলোভাবে গোলা ছুঁড়ছিল। তিনি লাফিয়ে উঠে ঢালু তীর দিয়ে দৌড়ে জঙ্গলে ঢুকে পড়লেন।
সেদিন সারাটাদিন তিনি সূর্যের গতিপথ অনুসরণ করে পথ চললেন। বন যেন অন্তহীন; কোথাও কোনো ফাঁকা স্থান নেই—এমনকি কাঠুরের রাস্তা পর্যন্ত না। এতটা বুনো অঞ্চলে বাস করেন এটা তিনি এতদিন জানতেনই না। এই আবিষ্কারে কেমন যেন অদ্ভুত কিছু অশুভ ব্যাপার ছিল।
ফোস্কা পড়া পায়ে ক্ষুধায় কাতর ফারকুহার সন্ধ্যা নাগাদ প্রচণ্ড ক্লান্ত হয়ে পরলেন। স্ত্রী ও সন্তানদের কথা চিন্তা করে তিনি শত কষ্টের মাঝেও এগিয়ে চললেন। অবশেষে একটি রাস্তা খুঁজে পাওয়া গেল—তিনি জানতেন এটা তাকে সঠিক দিকে নিয়ে যাবে। যদিও এটা শহুরে রাস্তার মতোই চওড়া ও সোজা তবু মনে হচ্ছিল কেউ এপথে চলাচল করে না। কোথাও কোনো জমি বা বাড়িঘর দেখা যাচ্ছিলো না। এমনকি কুকুরের ডাক পর্যন্ত শোনা গেল না যা শুনে তিনি অন্তত বুঝতে পারতেন আশেপাশে কোথায় মানব বসতি রয়েছে। গাছের কালো কাণ্ড দুই পাশে সোজা দেয়াল তৈরি করে দিগন্তে একটা বিন্দুতে গিয়ে মিলিত হয়েছে—যেন দৃষ্টিবিজ্ঞান পাঠের আঁকা কোন ছবি।
মাথার ওপর গাছের ফাঁক দিয়ে তাকাতেই অদ্ভুত নক্ষত্রপুঞ্জে সাজানো উজ্জ্বল সোনালী তারার ঝলমলে আলো দেখা গেল । তিনি নিশ্চিত যে এদের এভাবে সাজানোর নিশ্চয়ই একটা গোপন আর অশুভ তাৎপর্য রয়েছে। দুপাশের বন বিচিত্র শব্দে পরিপূর্ণ—তার মধ্যে একবার, দুবার, এইতো আবারও তিনি যেন একটি স্পষ্ট অজানা ভাষার ফিসফিসানি শুনতে পেলেন!
ঘাড় প্রচণ্ড ব্যথা করছিলো; হাত তুলে স্পর্শ করলে দেখা গেল সেটা ভয়ানকভাবে ফুলে রয়েছে। তিনি জানতেন দড়ির ঘষায় সেখানে একটি কালো দাগের বৃত্ত তৈরি হয়েছে। চোখ দুটো ভারি হয়ে উঠায় সেগুলো তিনি বন্ধ করতে পারছিলেন না। তৃষ্ণায় জিহ্বা ফুলে উঠেছে; তিনি দাঁতের ফাঁক দিয়ে ঠাণ্ডা বাতাসে জিহ্বা বের করে সেই জ্বালা কমানোর চেষ্টা করলেন। নরম ঘাস কি দারুণভাবে অচেনা পথটিকে মখমলের মতো ঢেকে রেখেছিল—তিনি এখন তার পায়ের নিচে রাস্তার স্পর্শ অনুভব করতে পারছিলেন না।
এতো কষ্টের মধ্যেও তিনি হাঁটতে হাঁটতে ঘুমিয়ে পড়লেন কারণ এখন তিনি ঘোরের মধ্যে অন্য একটি দৃশ্য দেখছেন—"হয়তো তিনি কেবল প্রলাপ থেকে সেরে উঠেছেন। তিনি নিজ বাড়ির গেটে দাঁড়িয়ে আছেন। সব কিছু তেমনই আছে যেমনটি তিনি রেখে গিয়েছিলেন আর সকালের রোদে সবকিছু উজ্জ্বল ও সুন্দর দেখাচ্ছে। নিশ্চয়ই তিনি সারারাত হেঁটেছেন। গেট ঠেলে সাদা চওড়া পথ ধরে এগোতেই মেয়েলি পোশাকের একটি ঝলক দেখতে পেলেন; সতেজ শান্ত ও মিষ্টি দেখতে মিসেস ফারকুহার তাকে অভ্যর্থনা জানানোর জন্য বারান্দা থেকে নিচে নেমে এলেন। অতুলনীয় মর্যাদা আর সৌন্দর্যের ভঙ্গিতে মুখে অপার্থিব আনন্দের হাসি নিয়ে তিনি সিঁড়ির নিচে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছেন।
আহ, সে কত সুন্দরী!
তিনি বাড়ানো বাহু নিয়ে সামনের দিকে দ্রুত এগিয়ে গেলেন। ঠিক যখন তাকে আলিঙ্গন করতে যাবেন তখনই তার ঘাড়ের পিছনে এক তীব্র আঘাত অনুভব করলেন; অন্ধকারের মাঝে কামানের বিস্ফোরণের মতো সাদা আলোয় চারপাশ ঝলসে ওঠে—তারপর সবকিছু অন্ধকার ও নিস্তব্ধ!
পেইটন ফারকুহার মারা গিয়েছিলেন; তার দেহ, ভাঙা ঘাড় নিয়ে আউল ক্রিক সেতুর কাঠের নিচে মৃদুভাবে দুলছিল।