.....

 


লিটল ফ্লাওয়ার (Little Flower)

হেনরি রাইডার হ্যাগার্ড

রূপান্তরঃ মেহেদী হাসান


“লিটল ফ্লাওয়ার” গল্পটি প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল ১৯২০ সালে। এটা স্যার হেনরি রাইডার হ্যাগার্ডের 'স্মিথ অ্যান্ড দ্য ফারাওস, অ্যান্ড আদার টেলস' বইয়ের একটি গল্প। এই সংগ্রহে মোট ছয়টি গল্প আছে। গল্পগুলো হলো: 'স্মিথ অ্যান্ড দ্য ফারাওস', 'মাগেপা দ্য বাক', 'দ্য ব্লু কার্টেন্স', 'দ্য লিটল ফ্লাওয়ার', 'ওনলি আ ড্রিম' এবং 'বারবারা হু কেম ব্যাক'। বইটিতে 'লিটল ফ্লাওয়ার' হচ্ছে চতুর্থ গল্প। পূর্বের তিনটি গল্প আমার টাইমলাইনে পাবেন। পড়ে দেখতে পারেন।

----------------------------------------------


পর্বঃ এক


রেভারেন্ড থমাস বুল ছিলেন পাথরের মত দৃঢ় চরিত্রের একজন মানুষ, তার কল্পনাশক্তি ছিলো না বললেই চলে। ভালো বংশের, ভালো মেধার, ভালো নীতির এবং ভালো খ্যাতির অধিকারী এই মানুষটির নাম থমাসের বদলে জন বুল হওয়া উচিত ছিল কারণ তিনি ছিলেন ব্রিটিশ মধ্যবিত্ত শ্রেণীর একজন আদর্শ প্রতিনিধি। স্বভাবগতভাবে তিনি ছিলেন সত্যিকারের একজন ধার্মিক মানুষ এবং তার মনের ভারসাম্যের কারণে অন্যদের মতো তিনি নানান দুর্বলতায় ভুগতেন না। জীবনের একেবারে শুরুতেই তিনি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন যে আধ্যাত্মিক বিষয়গুলো পার্থিব বিষয়ের চেয়ে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ, আর যেহেতু অনন্তকাল সময়ের চেয়ে অনেক দীর্ঘ, তাই আধ্যাত্মিকতার প্রতি নিজেকে উৎসর্গ করা এবং জাগতিক বিষয়গুলোকে নিজের পথে চলতে দেওয়াই হবে বুদ্ধিমানের কাজ। পুরস্কার এবং ধর্মীয় মতবাদে দৃঢ়ভাবে বিশ্বাসী এমন অনেক ভালো মানুষ আছেন যারা এই বাস্তব দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করেন। তাদের জন্য,


"হাজার গুণে ফিরে আসবে প্রতিদান।" — এটা তাদের প্রিয় স্তোত্রের একটি প্রিয় পংক্তি।


এটা সত্যি যে আধ্যাত্মিকতার ব্যাপারে তার ধারণা ছিল সীমিত! না, বরং বলা উচিত, এটা ছিল অসীম কারণ তার চারপাশে থাকা যা কিছুই তাকে শেখানো হোক না কেন, তিনি কোনরূপ সন্দেহ বা প্রশ্ন ছাড়াই তা গ্রহণ করতেন। বাল্যকালে বড় বড় পিল গিলে ফেলার দক্ষতার জন্য তিনি বিখ্যাত ছিলেন।


"ভেবো না," তিনি তার দুর্বল ভাই-বোনদের বলতেন, বিশেষত একটি বোনকে যার গলার গঠন এমন ছিল যে তাকে এই পিলগুলো কাঁচি দিয়ে কেটে নিতে হতো, "ভেবো না, গিলে ফেলো!"


জীবনের অন্য সব ক্ষেত্রেও থমাস একই কাজ করতেন; তিনি ভাবতেন না, গিলে ফেলতেন। এইভাবে বিশ্বাসের বিষয়গুলোতে সন্দেহ পোষণ করে যদি অন্য সকল তরুণরা "রূপকথা" নিয়ে কথা বলত অর্থাৎ যখন তারা তাদের আদিমাতা হাওয়া (আঃ)-এর এই পৃথিবীতে আগমনের সঠিক পদ্ধতি, ইয়ুশা ইবনে নুন (আঃ) এর জন্য সূর্য আসলেই স্থির ছিল কিনা বা নূহ (আঃ) তার নৌকায় অগণিত জীবজন্তুর জোড়া নিয়ে আরারাত পর্বতের চূড়ায় ভেসে উঠেছিলেন কিনা, অথবা ইউনুস (আঃ) পাচন রসকে অগ্রাহ্য করে তিমির পেটে তিন দিন বেঁচে থাকার মতো বিষয়ে সন্দেহ প্রকাশ করত, থমাস তখন করুণার হাসি দিয়ে তাদের দিকে তাকিয়ে মন্তব্য করতেন যে, মূসা (আঃ) আর অন্যান্য স্বীকৃত নবীদের লেখাই তার জন্য যথেষ্ট।


আসলে স্কুলে থাকার সময় তার সম্পর্কে একটা গল্প প্রচলিত ছিল যেটা তার এই মনোভাবের চমৎকার উদাহরণ হতে পারে। পড়াশোনার বোঝা হালকা করার জন্য একজন খুব বিখ্যাত ভূতত্ত্ববিদকে তার হাউসে বক্তৃতা দেওয়ার জন্য আনা হয়েছিল। তিনি তরুণ শ্রোতাদের আগ্রহী করে তোলা আর পৃথিবীর শিলাগুলিকে তাদের নিজস্ব ধর্মনিরপেক্ষ গল্প বলার শিল্পে পারদর্শী ছিলেন। এই বিশিষ্ট মানুষটি অসাধারণভাবে বক্তৃতা দিয়েছিলেন। তিনি দেখিয়েছিলেন কীভাবে কোনো সন্দেহ ছাড়াই প্রমাণিত হয় যে আমরা পৃথিবীতে বাস করি। কোটি কোটি বছর ধরে টিকে থাকা মহাকাশের সমুদ্রে ভাসমান একটি ধূলিকণার ন্যায় আমাদের এই পৃথিবী কীভাবে অগণিত যুগের বিবর্তনীয় পরিবর্তনের মাধ্যমে এটা শেষ পর্যন্ত মানুষের বসবাসের উপযোগী হয়ে উঠেছে। যারা সম্ভবত নিজেরাই কমপক্ষে দশ লাখ বছর ধরে এখানে বসবাস করছে, চলাফেরা করেছে।


আকর্ষণীয় এই গল্পের শেষে ছেলেদের প্রশ্ন করার জন্য আমন্ত্রণ জানানো হলো। থমাস বুল নামে একজন বড়সড়, ভুরু কুঁচকানো যুবক সাথে সাথে উঠে দাঁড়াল আর তাদের বিখ্যাত ও বয়স্ক অতিথি সেই বিশ্বব্যাপী খ্যাতিসম্পন্ন মানুষটির কাছে জানতে চাইলো, তিনি কেন রূপকথার গল্প বলে তাদের হাসানোর চেষ্টা করছেন?


বৃদ্ধ ভদ্রলোক খুব আগ্রহ নিয়ে তার চশমা লাগিয়ে এই অদ্ভুত ছেলেটিকে পর্যবেক্ষণ করে বললেন, "আমি নিজেও স্পষ্টভাষী, আর আমি তাদের পছন্দ করি যারা দৃঢ় বিশ্বাস থেকে স্পষ্ট কথা বলে; কিন্তু, আমার তরুণ বন্ধু, তুমি কেন মনে করো যে আমি রূপকথার গল্প বলছি?"


"কারণ বাইবেল তাই বলেছে," থমাস নির্ভীকভাবে উত্তর দিল। "বাইবেল আমাদের বলেছে পৃথিবী ছয় দিনে সৃষ্ট হয়েছে, লক্ষ কোটি বছরে নয়, আর সূর্য চাঁদ তারা আকাশে রাখা হয়েছে পৃথিবীকে আলো দেওয়ার জন্য; এছাড়া মানুষ সৃষ্ট হয়েছে খ্রিস্টপূর্ব চার হাজার বছরে। তাই হয় আপনি ভুল, স্যার, নয়তো বাইবেল ভুল, আর আমি বাইবেলের পক্ষে।"


বিশিষ্ট বিজ্ঞানী তার চশমা খুলে সাবধানে রেখে দিলেন, তারপর বললেন:


"অত্যন্ত যুক্তিপূর্ণ কথা। অনুরোধ করি যুবক, আমার বা অন্যদের নগণ্য অনুমানগুলো যেন তোমার বিশ্বাসে বাধা না দেয়। তবে আমি মনে করি, পৃথিবী খ্রিস্টপূর্ব চার হাজার বছরে শুরু হয়েছিল বলে যিনি বলেছিলেন, সেটা বাইবেল নয় বরং আর্চবিশপ উশার ছিলেন। আমার মনে হয় তুমি একদিন নিজের পথে একজন মহান মানুষ হতে পারবে। তবে আমি পরামর্শ দেব, বিতর্কে একটু ভদ্রতার মিষ্টতা মাখালে ভালো হয়।"


এরপর আর কোনো প্রশ্ন করা হল না, আর সভাটি বিশৃঙ্খলভাবে ভেঙে গেল।


এসব থেকে বোঝা যায়, যেহেতু আমরা কেউই নিখুঁত নই, থমাসের মধ্যেও দুর্বলতা ছিল। উদাহরণস্বরূপ, তার ছিল তথাকথিত "বদমেজাজ", এছাড়া নিজের এবং নিজের সামর্থ্য সম্পর্কে তার একটা উঁচু ধারণা ছিল।


যথাসময়ে থমাস বুল ধর্মতত্ত্বের ছাত্র হলেন। এমন ছাত্র খুব কমই ছিল। তিনি ডানে বামে তাকাতেন না, দিনে আট ঘন্টা পড়াশোনা করতেন আর প্রতিটি বিষয়ে সর্বোচ্চ ডিগ্রি নিয়েছিলেন। তারপর তিনি পুরোহিত পদে নিযুক্ত হলেন। এই সময়ে তিনি হঠাৎ করে একজন কলোনিয়াল বিশপের ধারাবাহিক কিছু উপদেশ শুনলেন যা তার মনকে মিশনারি কাজের দিকে উৎসাহিত করলো। এটা ঘটেছিল যখন তিনি ইস্ট এন্ডের একটি প্যারিশে ডিকন হিসেবে কাজ করছিলেন এবং পশ্চিমা বর্বরতার সঙ্গে পরিচিত হয়েছিলেন।


তিনি তার বন্ধুবান্ধব ও উর্ধ্বতনদের সাথে পরামর্শ করলেন যে তার সত্যিকারের কাজ পৃথিবীর দূর দূরান্তে পৌঁছে দিলে কেমন হয়? সবাই একবাক্যে উত্তর দিলেন, তারা তাই মনে করে; তাদের এই একতা দেখে মনে হল যে তারা আন্তরিকভাবে সম্মত হয়নি বরং তার থেকে মুক্তি পেতে মরিয়া হয়ে আছে। হয়তো তারা সত্যিই তাই চেয়েছিল; অথবা হয়তো তারা মনে করেছিল এই প্রচণ্ড জ্ঞানী মানুষটির জন্য এই সংকীর্ণ দেশ উপযুক্ত নয়।


কিন্তু আরেকজনের সঙ্গেও পরামর্শ করতে হয়েছিল কারণ এতদিনে রেভারেন্ড থমাস বুল লন্ডনের একজন মৃত ব্যবসায়ীর একমাত্র কন্যার সঙ্গে বাগদান করেছিলেন—আসলে তিনি ছিলেন একজন বড় মাপের দোকানদার। এই সম্মানিত নাগরিক, মিস্টার হামফ্রিজ, জীবনের শেষ দিকে দ্বিতীয় বিয়ে করেছিলেন এবং বেছে নিয়েছিলেন তার চেয়ে কিছুটা উঁচু শ্রেণীর একজন সুন্দরী আর বেশ ফ্যাশনেবল মহিলাকে, যিনি নিজেও ছিলেন বিধবা। দ্বিতীয় স্ত্রীর গর্ভে তার কোনো সন্তান হয়নি, তার কন্যা ডরকাস ছিল প্রথম স্ত্রীর গর্ভজাত সন্তান। মিস্টার হামফ্রিজ একটি অদ্ভুত উইল করেছিলেন; তিনি তার বিপুল সম্পত্তির সবটাই তার তরুণী বিধবা স্ত্রীর জন্য রেখে গিয়েছিলেন, আর তার কন্যা ডরকাসের জন্য বছরে মাত্র তিনশো পাউন্ডের একটি ভাতা নির্ধারণ করেছিলেন।


তবে মৃত্যুর একদিন আগে তিনি উইলে একটা শর্ত যোগ করেছিলেন যা মিসেস হামফ্রিজকে খুব রাগিয়েছিল, শর্তে বলা হয়েছিলো, যদি তিনি পুনরায় বিয়ে করেন তাহলে সম্পত্তির তিন-চতুর্থাংশ তৎক্ষণাৎ ডরকাসের কাছে চলে যাবে এবং তার স্ত্রীর মৃত্যুর পরে ডরকাস বা তার উত্তরাধিকারীরা পুরো সম্পত্তি পাবে।


এই উইলের ব্যবস্থাপনার ফলাফল ছিল একটি বাড়ি, যদিও সেটা বেশ বড়ই ছিল, কিন্তু মিসেস হামফ্রিজ এবং তার সৎ মেয়ে ডরকাসের জন্য সেটা যথেষ্ট হলো না। ডরকাস ছিল উল্টানো নাক, হালকা খয়েরী রঙের নরম চুল আর অস্পষ্ট মুখাবয়বের একটি নম্র মেজাজের ভীরু মেয়ে। তবুও তার মনের মধ্যে সৎ মায়ের ফ্যাশনেবল চলাফেরার বিরুদ্ধে একটি প্রতিবাদের চেতনা জাগ্রত ছিল। শেষ পর্যন্ত সে তার তিনশো পাউন্ড বার্ষিক আয় নিয়ে ইস্ট এন্ডে গিয়ে ভালো কাজকর্ম করার সিদ্ধান্ত নিল—দৃঢ়ভাবে স্থির করেছিল নিজের জন্য একটা পেশা গড়ে তুলবে, যদিও এ কাজের জন্য সে মোটেও উপযুক্ত ছিল না।


এভাবেই ডরকাসের সঙ্গে রেভারেন্ড থমাস বুলের পরিচয় হল। প্রথমবার সে তার ভবিষ্যৎ স্বামীকে দেখেই সম্পূর্ণরূপে মুগ্ধ হয়ে গেল। তিনি তখন মিম্বরে ছিলেন, আর সত্যিই সেখানে তার বলিষ্ঠ দেহ, বড় কালো চোখ, আর দৃঢ় চেহারা নিয়ে তাকে খুব সুদর্শন লাগছিল। তাছাড়া সে তার নিজস্ব জোরালো ভঙ্গিতে চমৎকার বক্তৃতা দিচ্ছিলেন।


বক্তৃতায় তিনি আধুনিক মহিলাদের—বিশেষ করে উচ্চশ্রেণির আধুনিক মহিলাদের চারিত্রিক দোষত্রুটি আর ক্ষুদ্র মন-মানসিকতার নিন্দা করছিলেন, যাদের সম্পর্কে তার আসলে কোনো ধারণাই ছিল না। এই বিষয়টি ইস্ট এন্ডের জনসাধারণের কাছে বেশ আকর্ষণী ছিল। তিনি দেখিয়েছিলেন কীভাবে এই বিলাসী ধরনের মহিলারা মূল্যহীন, তারা পোশাক আর অন্যান্য আরও নিষিদ্ধ আনন্দের প্রতি কতটা মনোযোগ দেয়। তিনি তাদের তুলনা করেছিলেন ফ্লোরেন্সের মহিলাদের সঙ্গে, যাদের স্যাভোনারোলা (যদিও মনে মনে থমাস নিজের সাথে সেই সংকীর্ণ মানুষগুলোর মিল খুঁজে পেত) বলে তিরস্কার করেছিলেন যতক্ষণ না তারা অনুতপ্ত হয়ে কাঁদতে লাগলো এবং তাদের অলংকার ও সাজসজ্জা পুড়িয়ে দেওয়ার জন্য স্তূপ করে রাখল।


তারা তাদের জীবন নিয়ে কী করে, তিনি জিজ্ঞেস করলেন। তাদের দশ হাজারের মধ্যে একজনও কি এমন আছে যে বিলাসিতা ত্যাগ করে পৃথিবীর অন্ধকার স্থানে আলো ছড়াতে যাবে বা অন্তত নিজেকে কষ্ট দিয়ে হলেও অন্যদের সাহায্য করবে? এভাবে তিনি তিরিশ মিনিট ধরে বলে গেলেন।


ডরকাস শুনতে শুনতে তার সৎ মায়ের কথা ভেবে মনে করছিল এসব কথা কতটা আশ্চর্যজনকভাবে সত্য। রেভারেন্ড যদি ডরকাসের সৎ মাকে ব্যক্তিগতভাবে চিনতেন, তবে এর চেয়ে নিশ্চয়ই ভালো বর্ণনা দিতে পারতেন না। এটাও নিশ্চিত যে মিসেস হামফ্রিজ আর তার বন্ধুরা কোনো ধরনের আলো ছড়ানোর কোনো ইচ্ছা রাখেন না, যদি না সেটা তাদের নিজেদের চোখ আর গয়নার ঝলকানি হয়।


তিনি যে উচ্চতর জীবনের ছবি আঁকলেন তা কত মহৎ, আত্মত্যাগ আর উঁচু লক্ষ্যের জীবন! সে এই উচ্চতর জীবন যাপন করতে চায়, কারণ সত্যি বলতে সে ছিল ধার্মিক প্রেরণায় পূর্ণ একটি ভালো হৃদয়ের মেয়ে; শুধু দুর্ভাগ্যবশত সে জানত না কীভাবে সেটা সম্ভব।


তখনই তার মনে একটা অনুপ্রেরণা এল; সে মিস্টার বুলের সাথে পরামর্শ করবে।


সে তাই করল, আর এর ফলাফল তিন মাসের মধ্যে তারা বাগদান করল, আর ছয় মাসের মধ্যে বিয়ে।


বাগদানের সেই উত্তেজনাপূর্ণ সপ্তাহগুলোতে তারা একমত হল (যদিও ডরকাসের কিছুটা দ্বিধা ছিল) যে যথাসময়ে তারা মিশনারি হয়ে পৌত্তলিকদের ধর্মান্তরিত করতে আফ্রিকা যাবে; যাকে ডরকাস "কালো আফ্রিকা" বলে চিনত। তবে তার আগে তাদের প্রস্তুতি নিতে হবে; তাদের দুই জনকেই দীর্ঘ প্রশিক্ষণের মধ্য দিয়ে যেতে হবে; সোয়াহিলি আর জুলুর মতো বিভিন্ন বর্বর ভাষা শিখতে হবে।


ওহ! বেচারি ডরকাস। সে খুব একটা বুদ্ধিমতী ছিল না এবং ভাষা শেখার কোনো প্রতিভাও তার মধ্যে ছিল না। একসময় সে সেই বর্বর উপ-ভাষাগুলোকে ঘৃণা করতে আরম্ভ করল। তবুও অনিচ্ছাসত্ত্বেও সে বীরাঙ্গনার মতো সেগুলো শিখতে থাকল এবং শেষ পর্যন্ত বুদ্ধিমত্তা ও ব্যবহারিক দূরদর্শিতায় শুধু গৃহস্থালীর বিষয়ে প্রয়োজনীয় শব্দ ও বাক্যগুলো শিখে ফেলল, যেমন, "আগুন জ্বালাও", "কেটলিতে পানি ফোটাও", "বোন, তুমি কি কাঠ কেটেছ?",  "রান্নাঘরের কুঁড়েতে এত হৈচৈ বন্ধ করো।", "সিংহ যদি আমাদের গরু খায়, তাহলে আমাকে জাগিয়ো" ইত্যাদি।


বিয়ের পর এক বছরেরও বেশি সময় ধরে এই প্রাথমিক প্রস্তুতি চলতে থাকল। থমাস ঘোড়ার মতো খাটতেন, যদিও এটা সত্য যে ডরকাস আনুসাঙ্গিক কাজের চাপে সোয়াহিলি আর জুলু ব্যাকরণের প্রতি তার মনোযোগ কমিয়ে দিয়েছিল। বিশেষভাবে যখন তাদের প্রথম সন্তানের জন্ম হল—মায়ের মতোই খয়েরী চুলের ফুটফুটে একটি মেয়ে, থমাস তার নাম রাখল তাবিথা এবং পরবর্তী বছরগুলোতে সে এই গল্পের "লিটল ফ্লাওয়ার বা ছোট্ট ফুল" হয়ে উঠল। তারপর চলে যাওয়ার সময় ঘনিয়ে এলে আরেকটি ঘটনা ঘটল। ডরকাসের সৎ মা মিসেস হামফ্রিজ, লেন্টের সময় একটি নাচের অনুষ্ঠানে গিয়ে ঠান্ডা লাগিয়ে ফুসফুসে প্রদাহে আক্রান্ত হলেন এবং মারা গেলেন।


থমাস যাকে প্রভুর ইচ্ছা বলেছিলেন, এই ঘটনার ফলে ডরকাস হঠাৎ ধনী হয়ে গেল। বছরে তার আয় প্রায় দুই হাজার পাউন্ড, কারণ তার বাবা তার ধারনার চেয়েও অনেক বেশি ধনী ছিলেন। এখন প্রলোভন তাকে পেয়ে বসল। সে নিজেকে প্রশ্ন করল, কেন থমাসকে আফ্রিকায় গিয়ে কালো মানুষদের শিক্ষা দিতে হবে, যখন তার প্রতিভা আর সম্পদ কাজে লাগিয়ে সে ঘরেই আরামে থেকে খুব শীঘ্রই একজন বিশপ, অথবা অন্তত একজন ডিন হতে পারে?


খুব সাহস করে সে এই বিষয়টি তার স্বামীর কাছে তুলল, কিন্তু বুঝল যে তার মাথা দিয়ে পাথরের দেয়াল ভাঙার চেষ্টা করা তার পরিকল্পনা পরিবর্তন করানোর চেয়ে সহজ হত। তিনি ধৈর্য সহকারে তার কথা শুনলেন—তারপর ঠান্ডা গলায় বললেন যে তিনি তার কথায় বিস্মিত হয়েছেন।


"যখন তুমি গরিব ছিলে" তিনি বলে চললেন, "তুমি এই সেবার জন্য নিজেকে উৎসর্গ করেছিলে, আর এখন আমরা ধনী হয়েছি বলে, তুমি বিশ্বাসঘাতক হয়ে মিশরের মাংসের হাঁড়ির পিছনে ছুটতে চাও? আমাকে আর কখনো এই বিষয়ে কিছু বলতে যেওনা।"


"কিন্তু আমাদের মেয়ের কথা একবার ভাবো" ডরকাস চেঁচিয়ে উঠল। "আফ্রিকা গরম, ওর জন্য উপযুক্ত নাও হতে পারে।"


"স্বর্গ তার দেখাশোনা করবে," তিনি উত্তর দিলেন।


"আমি ঠিক সেই ভয়টাই পাচ্ছি," ডরকাস কাঁদতে কাঁদতে বলল।


তারপর তাদের প্রথম ঝগড়া হল, যার মধ্যে স্বীকার করতেই হবে, সে দুয়েকটি কটু কথা বলে ফেলেছিল। উদাহরণস্বরূপ, সে বলল যে তিনি বিদেশে যেতে চান তার আসল কারণ হল তিনি দেশে তার সহকর্মী পাদ্রিদের, বিশেষ করে তার ঊর্ধ্বতনদের কাছে অপ্রিয়, যাদের তিনি ক্তৃতা আর তিরস্কার করতে পছন্দ করতেন।


এই ঝগড়ার শেষ হল তার সম্পূর্ণ পরাজয়ের মধ্য দিয়ে, ভাঙা ডানার প্রজাপতির মতো যা বাগানের রোলারের পথে পড়ে যায়। তিনি দাঁড়িয়ে তার ওপরে ঝুঁকে পড়লেন।


"ডরকাস," তিনি বললেন, "তুমি যা ইচ্ছে করো। চাইলে এখানে থাকো, তোমার টাকা আর বিলাসিতা উপভোগ করো। আমি পরের মাসের প্রথমেই আফ্রিকার উদ্দেশ্যে জাহাজে চড়ব। তুমি দুর্বল বলে কি আমি শক্তিশালী হওয়া বন্ধ করে দেব?"


"না, তা মনে করি না," সে কাঁদতে কাঁদতে উত্তর দিল, আর পরাজয় মেনে নিল।


অবশেষে তারা জাহাজে চড়লেন।


"তোমাকে নিজের সন্তানের দেখাশোনা করা শিখতে হবে," তিনি বললেন; এই মন্তব্যে ডরকাস একটু মুখ বাঁকাল।


ই-মেইল সাবস্ক্রিপশন

Enter your email address:

Delivered by FeedBurner

ক্যাটাগরীসমূহ

পৃষ্ঠাসমূহ

Creative Commons License
This work is licensed under a Creative Commons Attribution 3.0 Unported License.
Protected by Copyscape

ব্লগটি মোট পড়া হয়েছে

বাঙলা ব্লগ. Powered by Blogger.

- Copyright © মেহেদী হাসান-এর বাঙলা ব্লগ | আমার স্বাধীনতা -Metrominimalist- Powered by Blogger - Designed by Mahedi Hasan -