.....


ভূমিকা :
ভয়। দুটি ব্যাঞ্জন বর্নের সমন্বয়ে গঠিত একটি শব্দ। শব্দটি ছোট হলেও এর তাৎপর্য বা ব্যপকতা অনেক। এই শব্দটির ক্ষমতা এতই বেশি যে এই ব্যাপারটি সৃষ্টির সেরা জীব মানুষকে সবসময় তাড়া করে বেড়ায়। ভয় সম্পর্কে কিছু বলার পূর্বে এর মোটামুটি একটি সংজ্ঞা দেওয়া প্রয়োজন। অনেক চিন্তা করার পর যে সংজ্ঞাটি আমার মনোপুত হয়েছে তা হল "যার কারনে হৃদপিন্ডের রক্তচলাচল অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যায়,অনুশোচনা করতে ইচ্ছে করে,মস্তিষ্ক-চোখ-মুখ তপ্ত হয়ে ওঠে,একপ্রকার ঠান্ডা শিহরন মস্তিষ্ক ও শিরদাড়া বেয়ে নীচে নেমে যায়,হাত-পা অস্বাভাবিকভাবে কাপতেঁ থাকে,দম বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়,চলাচল করার বা নড়াচড়া করার শক্তি হারিয়ে যায় এছাড়াও সমস্ত শরীরে ঘাম এসে যায় ইত্যাদি কারনকে সামগ্রিকভাবে ভয় বলে।" উপরোক্ত কারনগুলোর কোন না কোনটা প্রায় প্রত্যেকের ক্ষেত্রেই ঘটে থাকে। ভয়ের অনেক প্রকারভেদ রয়েছে।

প্রকারভেদ :
১। সৃষ্টিকর্তার ভয়,
২। মৃত্যুর ভয়,
৩। সম্পদ হারানোর ভয়,
৪। স্বাস্থ্য হারানোর ভয়,
৫। সম্মান হারানোর ভয়,
৬। অলৌকিক সত্ত্বার ভয়,
৭। চাকরি হারানোর ভয়,
৮। অঙ্গহানীর ভয়,
৯। আত্মবিশ্বাসের ভয়,
১০। শিক্ষার ভয় বা পরিক্ষার ভয় ইত্যাদি।

আলোচনা:
আমি আজকে যে ভয়কে নিয়ে আলোচনা করব সেটি হচ্ছে অলৌকিক সত্ত্বার ভয়। অলৌকিক সত্ত্বার ভয় বলতে আমি বুঝিয়েছি কোন অতৃপ্ত আত্মার ভয়,ভূতের ভয়,অন্ধকারের আলো আধারীর ভয়,অজানা ভয় ইত্যাদি। আমি উপরের যতগুলো ভয়ের কথা বলেছি আসলে প্রকৃতপক্ষে তার কোনটাই সরল স্বাভাবিক ভয় নয়। প্রত্যেকটাই অস্বাভাবিক ভয়। মানুষের মনের অজানা কোন কুঠুরিতে এই অস্বাভাবিকতার জন্ম। সকল ভয়ই মানুষের মনের অবদান। প্রত্যেক ভয়ই মানুষের অবচেতন মন থেকে উত্পত্তি লাভ করে থাকে। সে ভয়ের সুনির্দিষ্ট কোন কারন নেই। যা মানুষের অস্বাভাবিক চিন্তার ফসল।

মানুষের মাঝে ভয় যেভাবে জন্ম নেয়:
মানুষ সবকিছুই তার পরিবার থেকে শিখে। পরিবারের পাট চুকিয়ে সে প্রকৃতি ও আশপাশের পরিবেশ থেকে শিখতে থাকে। প্রায় প্রত্যেকটি জিনিসই সে পরিবেশ থেকে শিখে। তবে তার মন পরিপূর্ণতা লাভ করলে সে নিজের কাছ থেকেই অনেক কিছু শিখতে থাকে। বহুকাল পূর্বে থেকে যা চলে এসেছে তা মানুষ সাধারনত সমাজ বা পরিবেশ থেকেই শিক্ষা লাভ করে। ভয়ও ঠিক তেমনি। এ জিনিসটিও মানুষ আশপাশের মানুষের আচরন,কথাবার্তা বা পরিবেশ থেকে শিক্ষা লাভ করে। ভয় পাওয়া অনেকটা স্কুলে শিক্ষা লাভের মতই। কেউ যদি ছোটকাল থেকেই ভয়ের সাথে পরিচিত না হয় তাহলে আশা করা যায় বড় হলে তার মধ্যে ভয় নামক জিনিসটি ঠিক মত কাজ করবে না। অর্থাত ভয় মানুষ পরিবেশ থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে লাভ করে থাকে।

মানুষ কেন ভয় পায়?
মানুষ কেন ভয় পায়, এই প্রশ্নটির উত্তর বেশ কঠিন । একথা সত্য যে প্রত্যেক মানুষই তার রিপু দ্বারা প্রভাবিত। অন্ধকার দিয়ে হাটছি হঠাত যদি কোথাও একটি অস্বাভাবিক শব্দ হয় তাহলে অবশ্যই আমাকে থমকে দাড়াতে হবে। হয়তো তখন দেহে রক্ত চলাচল বৃদ্ধি পাবে। হ্যা, প্রশ্ন ছিল মানুষ ভয় পায় কেন? এ প্রশ্নটির উত্তর জানতে আমাকে কথা বলতে হয়েছিল এমন কিছু মানুষের সাথে যারা প্রকৃতপক্ষেই এ সব অলৌকিক অস্বাভাবিক সত্ত্বাকে ভয় পায়। তাদের সাথে কথা বলে আমি যে কয়টি তথ্য উদ্ধার করতে পেরেছি সেগুলো হল:

১। যখনই আমি একা হয়ে যাই তখনই মনে হয় কেউ আমাকে তাড়া করছে। কোন কোন সময় মনে হয় সে আমার আশপাশেই ঘুরঘুর করছে। যেকোন সময় আমার উপর ঝাপিয়ে পড়ে ঘাড়টা মটকে দিতে পারে।
২। একা হাটলেই মনে হয় কেউ আমার পিছু নিয়েছে। বাতাসের সাথে সাথে সেও আমাকে ঘীরে আছে। যেকোন সময় সে তার অস্তিত্ব প্রকাশ করতে পারে।
৩। একা থাকা মানেই ভয়। আর একা হলেই আমার ভয় লাগে। সে যে কারনেই হোক না কেন। হয়ত এটা আমার অভ্যাসে পরিনত হয়েছে।
৪। একা খাটে শুলেই মনে হয় রাতে অতিপ্রাকৃত কোন কিছু আমার সাথে শোবে। সে আমাকে মেরে ফেলবে। মাঝে মাঝে আমি তার অস্তিত্ব অনুভব করি। তার ছবি আমার চোখের সামেনে ভেসে উঠে। সে তো একা নয়। তার সাথে আছে আরও অনেক সে। সে মানে ভূত।

ভয় পাওয়ার কতগুলো প্রকৃত উদাহরন:
১। জ্যোৎস্না রাত। রিকশায় বসে আছি একা (কোন এক কারনে,রিকশা ওয়ালা কিছু সময়ের জন্য অনুপস্থিত)। মনে হল আশপাশের সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে। রাত আনুমানিক সাড়ে দশটা। গ্রামে এমনিতেই লোকজন তারাতারি ঘুমিয়ে পড়ে। আমি যেখানে রিকশায় বসে আছি তার পাশে বাঁশঝাড়ের নীচেই দুটি 'কবর'। 'কবর' থেকে কিছুদূর গেলেই বেশ প্রশস্থ খাল। কবরের ঠিক বিপরীত দিকে কিছুদূরে কৃত্রিম বন-জঙ্গল। তার উপরে পূর্ণিমা চাঁদ উঁকি দিয়ে রয়েছে। উত্তর দক্ষিন থেকে হাওয়া বইছিল ঝিরঝির করে। হাওয়ার তালে বাঁশের পাতা নড়ছিল আর খসখস শব্দ হচ্ছিল। যার ফলে চাঁদের আলোয় এক আলো আধারীর খেলা চলছিল, মনে হচ্ছিল কবর থেকে উঠে আসা প্রেতাত্মাগুলো নাচছে। নদীর দিকে তাকাতেই মনে হল এই বুঝি ভেসে উঠল কোন অজানা কিছু। কিন্তু সেই অজানা কিছুটি কী?
২। নিজ এলাকা থেকে কিছু দূরে ওয়াজ মাহফিল হচ্ছে। ওয়াজ মাহফিলে হরেক রকমের খাবার আসত। ছোট ছিলাম বলে এগুলোর প্রতিই ঝোক ছিল বেশি। তো ওয়াজ শুনছি আর খাবার খাচ্ছি। রাত তখন এগারোটা। হঠাত খেয়াল হল আমার বন্ধুদেরকে আশপাশে দেখছি না। খোঁজকরে বুঝলাম আমাকে রেখেই বাছাধনরা বাড়িতে চলে গেছে। আমাবস্যা রাত। নিজ গ্রামের কাউকে না পেয়ে একাই রওনা দিলাম। হাটছি একা। মাঝে মাঝে রাস্তায় হয়তো দু একজনের সাথে দেখা হচ্ছে। হাটছি তালগাছের নীচ দিয়ে। মনে হল এই বুঝি তালগাছের আগা থেকে আমার কাধে ঝাপিয়ে পড়ল সে। যাচ্ছি নদীর পাশ দিয়ে। যাচ্ছি বাঁশঝারের পাশ দিয়ে। মাথার উপর বাঁশের পাতা খসখস করছে। মনে হয় যেন নি:শ্বাস ফেলছে কোন অতৃপ্ত কেউ। অথবা কখনও মনে হল আমাকে কেউ পেছন থেকে তাড়া করছে। যাক বাড়িতে এস পৌঁছলাম শেষ পর্যন্ত একদম একাই।

আপনি নিজেও ইচ্ছে করলেই ভয় পেতে পারেন:
১। হরর ফিল্ম দেখছেন। ফিল্ম দেখা শেষ হলে ঘুমোতে যাবেন্ ঘরের বাতি নিভান। একটি জানালা খুলে দিন। মনে করুন হরর ফিল্মে যা দেখেছেন তাই ঘটতে যাচ্ছে আপনার সাথে। চতুর্দিক থেকে ওরা আসছে আপনাকে তাড়া করতে। একটু ভাবুন তো তখন আপনার অবস্থাটা কী হবে?
২। ছোট বেলায় দাদীর কাছে একটি ভূতের গল্প শুনেছেন। ঠিক এমন একটি গল্পই মনে করার চেষ্ঠা করুন। দাদী ভূতের চেহারা আকৃতির যে বর্ণনা দিয়েছেন তা মনে করার চেষ্ঠা করুন। রাস্তায় বা ঘরের মধ্যে অন্ধকারে সেই ভূতের ছবিটি ভিজুয়ালাইজ করুন। আশ্চর্য হয়ে যাবেন আপনি যখন দেখবেন আপনার ঠিক চোখেন সামনেই দাড়িয়ে আছে আপনার কল্পিত সেই ভূতটি।
৩। রুমে আপনি একা। রুমটি অন্ধকার। বাইরেও বেশ অন্ধকার। সম্ভবত আমাবস্যা রাত। ভাবুন আপনার রুমের জানালার একটি কপাট ফাকঁ  হয়ে আছে। তার মধ্য দিয়ে একজোড়া লাল রাগত চোখ আপনাকে অনেকক্ষন যাবত লক্ষ করছে। যেকোন সময় জানালার ফাঁক গলে সে আপনার কাছে চলে আসতে পারে। তখন আপনার কী অবস্থাটা হবে চিন্তা করেছেন?
৪। আর হ্যা খুব বেশী সাহসী হলে কবরস্থানের মধ্যখানে গিয়ে বসে থাকুন একদম একলা। ভয় কাকে বলে হয়ত তখন টের পাবেন।

ভয়ের সাথে বন্ধুত্ব করা:
আমাদের প্রত্যেকেরই কম বেশী বন্ধু আছে। আমরা বন্ধুদেরকে সাধারনত ভয় পাই না। তাই আমাদের ভয়কে বন্ধু ভাবতে হবে। পার্থিব জগতে সবার সাথেই ভয় আছে। ভয় থাকবেই। ভয় তো আমার বন্ধু। সে আমাকে সঙ্গ দেয়। আমি যখন একা থাকি তখন তার থেকে ভালো বন্ধু আর কোথায় পাবো? ভয় আমারে অনেক বন্ধুদের মাঝে একজন।
ভয়কে খেলা ভাবা:
ফুটবল,ক্রিকেট,হকি কত ধরনের খেলাইতো আমরা খেলি। ভয়ও তেমনি একটি খেলা। এ খেলাটির নাম ভয়-ভয় খেলা। এ হচ্ছে খেলাচ্ছলে ভয় পাওয়া। সবসময় ভাবুন ভয়কে নিয়ে আমি খেলা করি। আর এ খেলায় আমার জয় অবশ্যাম্ভাবী।
জগতে ভূত বলে কিছু নেই:
জগতে সত্যিই ভূত বলে কিছু নেই। মানুষ ভয় পায় তার মনের জন্য। তার উদ্ভট কল্পনার জন্য সে ভয় পায়। ভূত পেত্নী এ সব তার নিজের বানানো চরিত্র। প্রকৃতিতে বা বাস্তবে এদের কোন অস্তিত্ব নেই। মানুষ যখন কল্পনায় এসব নিয়ে ভাবে তখন সে বাস্তবে এ চরিত্রগুলো ভিজুয়ালাইজ করে যার ফলে এসব চবিত্র তার সামনে বাস্তব রূপে ধরা দেয়।
অন্ধকারই ভালো:
অন্ধকারই ভালো। আলোর চেয়ে অন্ধকারই ভালো। ভয় যারা পান তাদেরকে এ কথাটিই মনে প্রানে বিশ্বাস করতে হবে। অন্ধকারেই আমি স্বস্তি বোধ করি। নিজের মত করে নিজেকে ভাবার সুযোগ পাই। নিজের মনকে নিয়ন্ত্রনের সুযোগ মেলে অন্ধকারেই।

ভয় নেই !
কি বুঝছেন? এখন আর আপনি ভয় পাচ্ছেন না। ঠিক তাই? ভয়কে বন্ধু ভাবা,অন্ধকার ভালো লাগা,ভয়-ভয় খেলা এগুলো প্রত্যহ অনুশীলন করলে ভয়ই বরং আপনাকে ভয় পাবে। চেষ্ঠা করেই দেখন না।


*** উপরোক্ত প্রতিবেদন কোন বৃহৎ গবেষনার ফসল নয়। যার ফলে এত ভূল থাকাই স্বাভাবিক।

Leave a Reply

Subscribe to Posts | Subscribe to Comments

ই-মেইল সাবস্ক্রিপশন

Enter your email address:

Delivered by FeedBurner

ক্যাটাগরীসমূহ

পৃষ্ঠাসমূহ

Creative Commons License
This work is licensed under a Creative Commons Attribution 3.0 Unported License.
Protected by Copyscape

ব্লগটি মোট পড়া হয়েছে

বাঙলা ব্লগ. Powered by Blogger.

- Copyright © মেহেদী হাসান-এর বাঙলা ব্লগ | আমার স্বাধীনতা -Metrominimalist- Powered by Blogger - Designed by Mahedi Hasan -