.....
- Back to Home »
- কৃষি জিজ্ঞাসা , চমকপ্রদ তথ্য »
- মধুপুরের মধুর ফসল ভুট্টা
পাবনার মধুপুরের চাষিরা ভুট্টাকে সোনার দানাজ্ঞান করে চাষ করছেন। চাষিদের আগ্রহ, কৃষি গবেষণা কেন্দ্র ও কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের চেষ্টায় মাত্র তিন বছরের ব্যবধানে এখানে ভুট্টা চাষে রীতিমতো বিপ্লব ঘটে গেছে। মুনাফা বেশি হওয়ায় চাষিরা অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ হয়েছেন। শুধু ভুট্টা চাষেই নয় এখানে ভুট্টা চাষের কলাকৌশল নিয়ে গবেষণা হচ্ছে। বেশির ভাগ চাষিকে প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে।
গোড়ার কথা: ২০০০ সালের কথা। কৃষি গবেষণা কেন্দ্র পাবনার কর্মকর্তা-কর্মচারীরা সদর উপজেলার মধুপুর এলাকার চাষিদের ভুট্টা চাষের উপযোগিতা, বেশি ফলন, উৎপাদন খরচ কম, লাভজনক দিক ইত্যাদি বিষয়ে উদ্বুদ্ধ করার পর চাষিরা ভুট্টা চাষে এগিয়ে আসেন। বীজ ও সার বিনামূল্যে দেয়ার পরও মাত্র পাঁচ-ছয়জন চাষি ২১ বিঘা জমিতে ভুট্টা চাষ করেন। অনেক চাষি কথা দিয়েও অন্য ফসল বুনেছিলেন। কিন্তু ভুট্টার ফলন, দাম ও লভ্যাংশ হাতে পেয়ে চাষিদের চোখ খুলে যায়। ২০০১ সাল থেকে এ মাঠে ভুট্টা চাষে চাষিদের মধ্যে জোয়ার বইতে থাকে।
বর্তমান চাষাবাদ: পাবনা-নগরবাড়ী মহাসড়কে আতাইকুলা পাড়ি দিলেই রাস্তার দু’পাশের মাঠে উঁচু উঁচু সবুজের সারি। আতাইকুলা, গঙ্গারামপুর, কুচিয়ামোড়া পাড়ি দিয়ে মধুপুর এলেই মনে হবে কোনো এক সবুজ অরণ্য। এখন মধুপুর ব্লকে ৬০০ বিঘা জমিতে ভুট্টা আবাদ হচ্ছে। অন্তত ২০০ চাষি পরিবার এখন অন্যান্য শীতকালীন ফসল কমিয়ে ভুট্টা চাষ বাড়িয়ে দিয়েছেন। আগামী মৌসুমে মধুপুরের মাঠে অন্তত দুই হাজার বিঘা ভুট্টা চাষ হবে বলে চাষিরা জানান।
এখানকার চাষিরা উচ্চফলনশীল জাতের সব ভুট্টা চাষ করে অধিক ফলন লাভ করছেন। এখানে হাইব্রিড জাতের প্যাসিফিক-১১, প্যাসিফিক-৯৮৩, প্যাসিফিক-৯৮৪, মুক্তা ৯০০ এম, ডব্লিউটিএল প্রভৃতি উফশী জাতের ভুট্টা চাষ হচ্ছে।
গবেষণা ও চাষি প্লট: মধুপুর ভুট্টা ব্লক দেশের অন্য ১০টি ব্লক থেকে আলাদা। কারণ এই ব্লকের অর্ধশত বিঘা জমি গবেষণা প্লট হিসেবেই ব্যবহৃত হচ্ছে। কৃষি গবেষণা কেন্দ্র ব্যবস্খাপনার বিষয়গুলো সরেজমিন পর্যবেক্ষণ করছে। সঠিক ব্যবস্খাপনায় অর্থাৎ সার বীজ ঠিকমতো বপন, প্রসেসিং, সংরক্ষণ দ্বারা চাষি কতটুকু লাভবান আর অন্যথা হলে কেমন ক্ষতি হয় তা পর্যালোচনা করছেন। গবেষণা প্লটে বিভিন্ন সারের ফলন পরীক্ষার পাশাপাশি কোন প্লটে সার কম, কোনোটিতে বেশি, কোনোটিতে জৈব সার বেশি, কোনোটিতে অ্যাকটিভ কম্পোস্ট, কোনোটিতে শুধু রাসায়নিক সার, শুধু জৈবসার, কোনো প্লটে রাসায়নিক সার না দিয়ে ভুট্টা চাষ করা হচ্ছে। চাষিরা সরেজমিন দেখে ভালো ফল পাওয়া প্লটের অনুসরণ করছেন। কৃষি গবেষণা কেন্দ্রের সিনিয়র বৈজ্ঞানিক সহকারী চণ্ডিদাস কুণ্ডু আমাদের বিভিন্ন প্লট ঘুরিয়ে দেখানোর পাশাপাশি জানালেন, ৭৫ শতাংশ রাসায়নিক সার আর ২৫ শতাংশ জৈবসারে সবচেয়ে ভালো ফলন পাওয়া গেছে। গবেষণা প্লটের ফলন এসেছে বিঘাপ্রতি ৩৬ মণ। চাষি পর্যায়ে তা ৩০-৩২ মণ। সর্বোচ্চ ফলন দেয়া পদ্ধতিটিই চাষির জন্য সুপারিশ করা হয়।
চাষি পর্যায়ে ভুট্টা চাষেও এখানে আরেকটি গবেষণার ধারাবাহিকতা কাজ করছে। পারিবারিক প্রশিক্ষণের মাধ্যমে চাষিদের ভুট্টা চাষে আগ্রহী ও অভিজ্ঞ করে তোলা হচ্ছে। পারিবারিক প্রশিক্ষণ ও এর উপযোগিতা সম্বন্ধে তারা বলছিলেন, ভুট্টা চাষ যে লাভজনক তা চাষি পরিবারের সবাইকে বোঝানো হয়। এতে ভুট্টা চাষ নিয়ে পারিবারিকভাবে আর দ্বিমত আসে না। আর প্রযুক্তিগত সুবিধা হলো পরিবারের প্রত্যেকটি লোকই জানতে পারে ভুট্টা আবাদে প্রতি লাইন ও বীজের মাঝে কতটুকু দূরত্ব রাখতে হয়। কতটুকু রাসায়নিক ও জৈবসার দিতে হয়। এ ছাড়া অন্যান্য কলাকৌশলও জানেন। এতে সুবিধা হলো একজন ভুলে গেলেও অন্যজনের খেয়ালে থাকে। সঠিক প্রযুক্তিটি প্রয়োগ হয়। ফলে ভালো ফলন আসে।
আন্ত:ফসল:
ভুট্টা চাষে নয়া দিগন্ত:
পেঁপে ক্ষেতে হলুদ, আখ ক্ষেতে ফুলকপি এরকম সাথী ফসলের চাষ দেশে এখন নতুন কোনো প্রযুক্তি নয়। এরকম চাষ অহরহ হচ্ছে। কিন্তু ভুট্টা ক্ষেতে সাথী ফসল নতুন কথাই বটে। তাও আবার গোল আলুর মতো অন্যতম প্রধান অর্থকরী ফসল। এতে লাভের ওপর ডাবল লাভ। হ্যাঁ, এমন লাভজনক প্রযুক্তির সফল প্রয়োগ হয়েছে পাবনায় মধুপুর ভুট্টা ব্লক থেকে। ২০০৫ সাল থেকে চাষিরা ভুট্টার ক্ষেত থেকে বোনাস হিসাবে আলু পান। শুধু আলু নয় চাষ হয়েছে লালশাক, পালংশাক, মুলা ইত্যাদি। ভুট্টার সাথে আন্ত:ফসল সমন্ধে মধুপুরের চাষি বজলুর রহমান দুলাল, বাক্কী বিল্লাহ জানালেন, ভুট্টার দুই সারির মাঝে ৭৫ সেন্টিমিটার সিড টু সিড দূরত্ব থাকে ২৫ সেন্টিমিটার । দুই সারির মাঝে ওই ৭৫ সেন্টিমিটারের মধ্যে এক সারি কিংবা দুই সারি করে গোল আলু লাগিয়ে দেয়া হয়। গোল আলুর বদলে লালশাক, পালংশাকও চাষ করা যায়। তারা গোল আলুর আবাদ করে ভালো মুনাফা পেয়েছেন। কৃষি গবেষণা ও কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের কর্মীরা জানালেন, সাথী ফসল হিসাবে আলু বিঘাপ্রতি ২০-৩৫ মণ পর্যন্ত পাওয়া যায়। এতে ভুট্টার ফলনের কোনো ব্যাঘাত ঘটে না। কৃষি কর্মীরা জানান, ভুট্টার আন্ত:ফসল হিসাবে আলু চাষ করে ভুট্টা ছাড়াই শুধু আলু বিক্রি করে বিঘাপ্রতি পাঁচ হাজার থেকে আট হাজার টাকা পাওয়া সম্ভব। আর অন্যান্য সবজি চাষ করে ভুট্টা চাষের খরচ উঠে যায়।
সম্ভাবনায় উজ্জ্বল বেবিকর্ন:
মধুপুর ভুট্টা ব্লকের অনেক চাষি বেবিকর্নের চাষ করেও লাভবান হচ্ছেন। পুড়িয়ে খাওয়ার উপযোগী কচি ভুট্টাই বেবিকর্ন। এখানে উৎপাদিত বেবিকর্ন জেলার বিভিন্ন স্খানে সরবরাহ হয়। ফেরিওয়ালারা কচি মোচা পুড়িয়ে বিক্রি করে। এতে চাষিরা আগাম অর্থ ঘরে তোলেন।
ভুট্টার ফলন বিপণন ও মুনাফা:
মধুপুরের মাঠে বিঘাপ্রতি ফলন আসছে ২৮-৩০ মণ, যাতে চাষিরা বিঘাপ্রতি আট থেকে নয় হাজার টাকা পেয়ে থাকেন। সাথী ফসল থেকে আরো তিন হাজার টাকা আসে। বিঘাপ্রতি হাজার তিনেক টাকা খরচ বাদ দিয়েও চাষিদের ভালো মুনাফা থাকে। এ ছাড়া বিঘাপ্রতি অন্তত ৫০-৬০ মণ জ্বালানি পাওয়া যায়; যার বাজার মূল্য অন্তত দুই হাজার টাকা আর ভুট্টা উত্তোলনের সময় কচি ডগা ও পাতা পাওয়া যায় উত্তম গোখাদ্য হিসেবে।
গনি মিয়ারা এখন গরিব নয়:
গনি মিয়ারা এখন গরিব নয়। গনি মিয়া একজন গরিব চাষি, শৈশবের পাঠ্য বইয়ের এ বহুল প্রচলিত কথাটি আর যা হোক মধুপুরের চাষি গনি মিয়ার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। তিনি এখন অগ্রসর ও উন্নত চাষি। কারণ তার ১২ বিঘা জমির ছয় বিঘাতেই ভুট্টা চাষ করেন। ৭০ বছর বয়সী আবদুল গনি বলেছিলেন, গমে বিঘাপ্রতি চার-সাত মণ ফলন পাওয়া যায়। গমের তুলনায় ভুট্টা দ্বিগুণ লাভজনক। লাভজনক এ ফসল চাষ করে শুধু তিনি নন, লাভবান হয়েছেন মধুপুরের খন্দকার বজলুর রহমান দুলাল, বাক্কী বিল্লাহর মতো শত শত চাষি। আবতুল করিমের ছেলে বাক্কী বিল্লাহ এ অঞ্চলের পথিকৃৎ ভুট্টাচাষি। কৃষি গবেষণা কেন্দ্রের কথামতো কেউ যখন ভুট্টা করতে চাইছিল না তখন এই বাক্কী বিল্লাহই প্রথম ঝুঁকি নেন। তিন বিঘা জমিতে ভুট্টা করেছিলেন। এ বছর চাষ করেছিলেন ১০ বিঘা জমিতে। তিনি শুধু ভুট্টা চাষই করেন না; উন্নত হাইব্রিড জাতের বীজও চাষিদের কাছে সরবরাহ করেন।
শেষ কথা:
দারিদ্র্যবিমোচন, কর্মসংস্খান, অধিক মুনাফা, জ্বালানির অভাব দূর হওয়াসহ এ অঞ্চলে ভুট্টা চাষের অনেক সুবিধার পাশাপাশি কিছু প্রতিবìধকতা তো রয়েছেই। হাইব্রিড ভুট্টার বীজ পেতে এখানে বেশ বিলম্ব হয়। এ জন্য চাষাবাদে একটু বিঘিíত হয়। মোচা থেকে ভুট্টা আহরণের জন্য চাষিদের বড় মেশিন নেই এবং ভুট্টা বেশি দিন সংরক্ষণের জন্য এখানে কোনো সংরক্ষণাগার নেই। এ বিষয়গুলোর সমাধান হলে মধুপুরের ভুট্টা চাষ সারাদেশের জন্য একটি মডেল হতে পারে।
তথ্যসূত্র: দৈনিক নয়াদিগন্ত