.....



লেখক: মোঃ শহীদুল ইসলাম
বিজনেস ডেভলপমেন্ট ম্যানেজার-এজি, এ্যাডভান্স এনিমেল সায়েন্স কোং লিঃ
জামালপুর জেলার ইসলামপুরের প্রত্যন্ত অঞ্চলে স্থাপিত "ভাই ভাই পোল্ট্রি ফার্ম" ডিম উৎপাদনের ক্ষেত্রে ঈর্ষণীয় সাফল্য অর্জন করেছে। আলোচ্য লেয়ার খামারের মালিক জনাব রঞ্জু খান লোহানী বিগত ২০০৭ সালে খামারটি স্থাপন করেন। তিনি এ্যাডভান্স এনিমেল সায়েন্স কোং লিঃ-এর মাধ্যমে সর্বপ্রথম ২/০৬/২০০৭ তারিখে ১৫০০টি এক দিনের Lohmann Brown LSD বাচ্চা তাঁর খামারে আনেন এবং সম্পূর্ণ বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে প্রতিপালন শুরু করেন। প্রথম থেকেই তিনি নিজে খাদ্য প্রস্তুত করেন এবং অদ্যাবধি একই উপায়ে খাদ্য প্রস্তুত করে মুরগীকে পরিবেশন করছেন। যখন তাঁর মুরগীর বয়স ২০ সপ্তাহ হয় তখন থেকে ডিম উৎপাদন শুরু হয়। ২১ সপ্তাহ বয়সে ডিম উৎপাদন ৭০% এ পৌছায়। বর্তমানে তাঁর মুরগীর বয়স ১১২ সপ্তাহ অথচ এখনও ডিম উৎপাদন হচ্ছে প্রায় ৭০% হারে। উল্লেখ্য যে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে সাধারণত ডিম উৎপাদন সর্বোচ্চ পর্যায়ে থাকে ৭৫-৮০ সপ্তাহ বয়সে এবং এর পরবর্তী পর্যায়ে ধীরে ধীরে কমতে থাকে কিন্তু জনাব রঞ্জুর খামারে অদ্যাবধি ডিম উৎপাদন প্রায় একই পর্যায়ে রয়েছে যা অনেকটা বিষ্ময়কর। অবশ্য এর আগে তাঁর খামারে ডিম উৎপাদন ৯০% এর উপরে ছিল।

জনাব রঞ্জুর খামারের এই বিষ্ময়কর সাফল্যের কারণ জানার জন্য তাঁর সাথে যোগাযোগ করা হয়েছিল। সরেজমিনে খামারটি পরিদর্শন ও তাঁর বাস্তব অভিজ্ঞতার চিত্রটি উপস্থাপিত হলো।

০ তিনি বাচ্চা আনার পূর্বে পরিকল্পিতভাবে ফার্মের স্থান ও সঠিক মাপের ঘর তৈরি করেন।
০ টিনের নীচে বাঁশের চাটাইয়ের সিলিং দিয়ে তাপমাত্রা কিছুটা নিয়ন্ত্রণে রাখার ব্যবস্থা করেন।
০ মুরগির ঘরের ওভার হ্যাং ৪-৫ ফুট রাখা হয়েছে যার ফলে সূর্যের আলো কোনো ক্রমেই ঘরের ভিতর প্রবেশ করতে পারে না।
০ বাচ্চা আনার ২৪ ঘন্টা পূর্বে ঘরটি ফিউমিগেশন করা হয়েছে।
০ পরিমিত সংখ্যক ফিডার, ড্রিংকার, লিটার ও বাচ্চা পালনের অন্যান্য সরঞ্জামাদির প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হয়।
০ বাচ্চা আনার ১২ ঘন্টা পূর্বে খামার পুনরায় পরিষ্কার করে ফিউমিগেশন করা হয়েছিল।

ব্রুডারে বাচ্চা ছাড়ার পর গৃহীত ব্যবস্থাদি
০ বাচ্চা অতি দ্রুত বক্স থেকে ব্রুডারে ছেড়ে দেয়া হয়।
০ সঠিক তাপমাত্রার পানি পরিমিত সংখ্যক পানির পাত্রে সরবরাহ করা হয়েছিল।
০ শুকনা, পরিষ্কার ও জীবাণুমুক্ত লিটার ব্যবহার করা হয়েছে।
০ ব্রুডারে বাচ্চা নেয়ার ১২ ঘন্টা পূর্ব হতে তাপ প্রদান শুরু হয়।
০ পানিতে ৩ পি.পি.এম. ক্লোরিন মিশ্রিত করা হয়েছিল।
০ প্রথম ৩-৪ ঘন্টা পানির সাথে ৪% গ্লুকোজ খাওয়ানো হয়েছে যাতে বাচ্চার রক্তের ভিসকোসিটি ও অসমোলারিটি নিয়ন্ত্রণে থাকে।
০ বাচ্চার যাতে তরল পায়খানা বা পেস্টিভেন্ট দেখা না দেয় সেজন্য ১ম ও ২য় দিন পরিষ্কার ভুট্টা ভাঙ্গা খাওয়ানো হয়েছে।

খাদ্য সরবরাহ
০ বাচ্চা ফোটার ১ম দিন থেকেই সব সিস্টেমের কার্যক্রম চালু হয়। কাজেই এসময় বাচ্চাকে নিয়মিত পুষ্টিসমৃদ্ধ খাবার দিতে হবে।
০ বিজ্ঞানী ডিবনার্সের গবেষণায় দেখা গেছে যে, বাচ্চা ফোটার ১ম দিন থেকেই বাচ্চার বিভিন্ন সিস্টেমসমূহ কার্যকর হতে শুরু করে। যেমন- ক্ষুদ্রান্ত্রের উন্নতি সাধন, ইমিউন সিস্টেমের উন্নয়ন, মাংস পেশী বৃদ্ধি এবং তাপ সহিষ্ণুতা বৃদ্ধি ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ কার্যাবলী সঠিক সময়ে উপযুক্তভাবে সংগঠিত হতে থাকে।
০ এই ফার্মে ১ম দিন থেকেই পুষ্টি সমৃদ্ধ লেয়ার স্টার্টার ফিড পর্যাপ্ত সংখ্যক ফিডারে নিয়মিতভাবে বারংবার পরিবেশন করা হয়েছে। ফলে বাচ্চাতে দীর্ঘ মেয়াদী ডিম উৎপাদনের ক্ষমতা অর্জিত হয়েছে।

ব্রুডিং ব্যবস্থাপনা
ব্রুডারটি বাচ্চা প্রবেশ করানোর ১২ ঘন্টা পূর্বেই তাপায়িত করা হয়েছিল।

তাপমাত্রা
১) বাচ্চার ঘরে সর্বদা ৩০-৩২ সে. তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছে।
২) এই খামারী ব্রডারের তাপমাত্রা সবসময় বাচ্চার ঘরের তাপমাত্রা অপেক্ষা ১-২০ সে. বেশি রেখেছে। ফলে বাচ্চা সুস্থ অবস্থায় সঠিকভাবে বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়েছে।
৩) উক্ত ফার্মে নিয়ন্ত্রিত তাপমাত্রার সিডিউল ছিল নিম্নরূপঃ


দিন/সপ্তাহ তাপমাত্রা মেঝেতে (সেলসিয়াস/ ফারেনহাইট)
দিন ১ম-২য় ৩০ সে/ ৯৩.২০ ফা
দিন ৩য়-৪র্থ ৩২ সে/ ৮৯.৬০ফা
দিন ৫ম-৭ম ৩০ সে/ ৮৬০ ফা
সপ্তাহ ২য় ২৯ সে/ ৮৪.২০ ফা
সপ্তাহ ৩য় ২৭ সে/ ৮০.৬০ ফা
সপ্তাহ ৪র্থ ২৪ সে/ ৭৫.২০ ফা
সপ্তাহ ৫ম ১৯ সে/ ৬৬.২০ ফা

০ ঘরের তাপমাত্রা, আদ্রর্তা এবং ঠান্ডা ও মুক্ত বাতাস চলাচলের জন্য তিনি ঘরের পাশ দিয়ে পানি প্রবাহের একটি পাকা নালা (১৫০'×৫' × ৩") চালু রেখেছেন যেখান দিয়ে সর্বদা টাটকা পানি প্রবাহিত হয়। এই পানি প্রবাহের ফলে ঘরের তাপমাত্রা ও আদ্রর্তা নিয়ন্ত্রিত হয়। এছাড়াও সর্বদা ধূলিমুক্ত ঠান্ডা বাতাস ঘরে প্রবেশ করে। এর ফলে ঘরে কোনো গ্যাস সঞ্চিত হতে পারে না এবং ঘর দুর্গন্ধমুক্ত থাকে।
০ খামারে বাচ্চা আনার পর থেকে তিনি ব্রুডিং, রিয়ারিং ইত্যাদি অত্যন্ত নিবিড়ভাবে নিয়ন্ত্রণ করেছেন। বাচ্চা আনার পর ২-৩ দিন পর্যন্ত তিনি এ বিষয়ে অত্যন্ত সতর্ক ছিলেন।
০ বাচ্চা আনার পর ৭-১০ দিন পর্যন্ত ঘরের আলোক নিয়ন্ত্রণ করেছেন নিবিড়ভাবে।
০ বাচ্চা আনার পর ব্রুডিং পর্বে তিনি বাচ্চাদের এমনভাবে পরিচর্যা করেছেন যে এরা নিয়মিত খাদ্য ও পানি গ্রহণ করেছে এবং এদের মাঝে সবসময় কর্মচাঞ্চল্য লক্ষ্য করা গেছে।
০ ব্রুডিং ব্যবস্থা উন্নততর হওয়ায় বাচ্চারা একই সাথে অবসর নেয় বা নিদ্রা যায়। বাচ্চাদেরকে সতত ব্যস্ত রাখা হয়েছে যাতে সবল ও অপেক্ষাকৃত দুর্বল বাচ্চারা সকলেই খাদ্য গ্রহণ ও পানি পানে উৎসাহিত থাকে। এর ফলে ঝাঁকের সব বাচ্চার মাঝে সমতা ও সামঞ্জস্য নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয়েছে।
০ ব্রুডিং পর্যায় যথাযথভাবে নিয়ন্ত্রিত হওয়ায় বাচ্চাদের থাইরয়েড গ্রন্থি, পরিপাকতন্ত্র ও দেহের অভ্যন্তরীণ অর্গানসমূহ সঠিকভাবে গড়ে ওঠে ও এদের দৈহিক বর্ধন আশানুরূপ হয়।
০ খামারে বহিরাগতদের প্রবেশ নিষিদ্ধ ছিল।
০ খামারের প্রবেশ পথে জীবাণুনাশক পূর্ণ ফুটডিপ রয়েছে যা সপ্তাহে দুই বার পরিবর্তন করা হয়।
০ খামারে যারা কাজ করেন তারা সকলেই খামারের কাপড়-চোপড় ও জুতা/স্যান্ডেল ব্যবহার করেন।
০ খামারে জীবনিরাপত্তা ব্যবস্থা অনুসারিত হলেও পারিপার্শ্বিক ও ভৌগলিক কারণে তা অত্যন্ত কঠোরভাবে পালন করা সম্ভব হয় না এটা স্পষ্টত বোধগম্য। তথাপি তিনি তাঁর খামার সম্পূর্ণ রোগমুক্ত রাখতে সক্ষম হয়েছেন কতকগুলি কারণে-
* তিনি তাঁর খামারের মুরগীকে সঠিক রুটিন অনুযায়ী প্রতিটি সংক্রামক রোগের বিরুদ্ধে নিয়মিত ভ্যাকসিন প্রদান করিয়ে নিয়েছেন এবং এসকল ভ্যাকসিনই অত্যন্ত নির্ভরযোগ্য ও বিশ্বস্ত প্রতিষ্ঠান হতে উৎপাদিত।

* এখানে উল্লেখ্য যে তিনি তার মুরগীকে ১দিন বয়স থেকেই অদ্যাবধি "খা চিং লিং" (চীন হতে আমদানিকৃত) দেহবর্ধক সম্পূরক খাদ্যোপাদান খাদ্যের সাথে সাথে প্রদান করে থাকেন। "খা চিং লিং" প্লীহা ও পরিপাকতন্ত্রকে সুদৃঢ় করে। এটা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে। শুধু তাই নয় এটা নিয়মিত ব্যবহারের ফলে পোল্ট্রির উৎকর্ষতা যেমন দৈহিক ওজন বৃদ্ধি, খাদ্য সদ্ব্যবহারের হার ও ডিম উৎপাদন বৃদ্ধি করে। এছাড়াও রাণীক্ষেত রোগ ও অন্যান্য ভাইরাল রোগের বিরুদ্ধেও খা চিং লিং প্রতিরক্ষা প্রদান করে থাকে।

এ প্রসঙ্গে জনাব রঞ্জু বলেন, তাঁর খামারের আশেপাশে অনেক মুরগির খামার ছিল কিন্তু এভিয়ান ইনফ্লুয়েঞ্জার ক্রমাগত সংক্রমণের ফলে ঐ সকল খামারের মুরগি রোগাক্রান্ত হয়ে পড়ে এবং শেষ পর্যন্ত উক্ত সকল খামার বন্ধ হয়ে গেছে। এই মারাত্তক মহামারীর ব্যাপারে তিনি অত্যন্ত উদ্বিগ্ন ছিলেন এবং তা প্রতিরোধের ব্যাপারে সম্ভাব্য সকল সহযোগিতা কামনা করেন ঢাকাস্থ এ্যাডভান্স এনিমেল সায়েন্স কোং লিঃ এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক ডাঃ এম এম খানের নিকট। প্রকৃতপক্ষে তাঁরই পরামর্শক্রমে তিনি প্রথম থেকেই নিয়মিতভাবে মুরগিকে খা চিং লিং প্রদান করেন এবং ফলশ্রুতিতে অদ্যাবধি তাঁর খামার সম্পূর্ণরূপে রোগমুক্ত রয়েছে।

জনাব রঞ্জু জানান, তিনি তাঁর খামার স্থাপন করার শুরু থেকে তা পরিচালনার ক্ষেত্রে সার্বক্ষণিক কারিগরি ও সর্বপ্রকার সহায়তা পেয়েছেন ডাঃ এম এম খানের নিকট থেকে। তার খামারের অভূতপূর্ব সাফল্যের জন্য তিনি ডাঃ এম এম খানের সার্বিক সহায়তার জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন।


তথ্যসূত্র: পোলট্রি, পশুসম্পদ ও মৎস্য বিষয়ক মাসিক পত্রিকা ‘খামার’

Leave a Reply

Subscribe to Posts | Subscribe to Comments

ই-মেইল সাবস্ক্রিপশন

Enter your email address:

Delivered by FeedBurner

ক্যাটাগরীসমূহ

পৃষ্ঠাসমূহ

Creative Commons License
This work is licensed under a Creative Commons Attribution 3.0 Unported License.
Protected by Copyscape

ব্লগটি মোট পড়া হয়েছে

বাঙলা ব্লগ. Powered by Blogger.

- Copyright © মেহেদী হাসান-এর বাঙলা ব্লগ | আমার স্বাধীনতা -Metrominimalist- Powered by Blogger - Designed by Mahedi Hasan -