.....



মাগেপা দ্য বাক' নামের গল্পটি প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল ১৯১২ সালে। এটা স্যার হেনরি রাইডার হ্যাগার্ডের 'স্মিথ অ্যান্ড দ্য ফারাওস, অ্যান্ড আদার টেলস' বইয়ের একটি গল্প। এই সংগ্রহে মোট ছয়টি গল্প আছে। গল্পগুলো হলো: 'স্মিথ অ্যান্ড দ্য ফারাওস', 'মাগেপা দ্য বাক', 'দ্য ব্লু কার্টেন্স', 'দ্য লিটল ফ্লাওয়ার', 'ওনলি আ ড্রিম' এবং 'বারবারা হু কেম ব্যাক'। বইটিতে 'ম্যাগেপা দ্য বাক' হচ্ছে দ্বিতীয় গল্প।

-----------------------------------------------

এটা প্রয়াত অ্যালান কোয়াটারমেইনের প্রথম জীবন নিয়ে লেখা 'মেরি' নামের একটি গল্পের ভূমিকায় বলা হয়েছিলো। অ্যালান কোয়াটারমেইন আফ্রিকায় মাকুমাজান নামে পরিচিত ছিলেন। স্যার হেনরি কার্টিসের ভাই মিস্টার কার্টিস জানিয়েছেন কীভাবে তিনি ইয়র্কশায়ারে মি. কোয়াটারমেইনের বাড়িতে রাখা বেশ কিছু পুরনো পাণ্ডুলিপি খুঁজে পেয়েছিলেন।

সেই পাণ্ডুলিপিগুলোর একটি ছিল 'মেরি'। সম্পাদক হিসেবে আমার কাছে এই পাণ্ডুলিপিগুলো প্রকাশের জন্য আসার কথা ছিল। আমি কিন্তু সেগুলো ছাড়াও আরও কিছু সম্পূর্ণ লেখা এবং অনেক অগোছালো নোট আর কাগজপত্র খুঁজে পেয়েছিলাম। এই কাগজগুলোর মধ্যে কিছু ছিল খেলাধুলা বা শিকার বিষয়ক লেখা। কিছু রয়েছে ঐতিহাসিক ঘটনা নিয়ে। কিছু লেখকের ব্যক্তিগত জীবনের ঘটনার স্মারক। আবার কিছুতে এমন সব অসাধারণ ঘটনার বিবরণ আছে যা তিনি নিজে দেখেছেন কিন্তু অন্য কোথাও উল্লেখ করেননি।

খুব ময়লা, ছেড়া, একটি পুরনো বইয়ের মধ্যে এই নোটটি পাওয়া গেছে যা দেখে মনে হয় মালিক বহু বছর ধরে এটি সঙ্গে নিয়ে ঘুরেছেন। তখন ইয়র্কশায়ারে মি. কোয়াটারমেইনের অতিথি থাকাকালীন অনেক আগের একটি আলোচনার কথা আমার মনে হয়। 

নোটটি ছোট। আমার ধারনা যে ঘটনার বিবরণী এটাতে বলা হয়েছে, সেটা ঘটার এক দুই ঘণ্টার মধ্যেই তিনি লিখে ফেলেছিলেন।

নোটটি নিচে দেওয়া হলো:—

আমি ভাবি, পরপারে খুব সাহস আর নিঃস্বার্থ ভালোবাসার মত কাজের জন্য কোনো স্বীকৃতি দেওয়া হয় কিনা? – অনেকটা আধ্যাত্মিক ভিক্টোরিয়া ক্রসের মতো। যদি দেওয়া হয় তবে আমার মনে হয় বেচারা সেই বুড়ো আদিবাসী মাগেপাকে এটা দেওয়া উচিত। এই ব্যাপারে আমার যদি কোনো অধিকার থাকত তবে আমি এটাই করতাম। সত্যি বলতে, সে আমাকে মানবজাতি নিয়ে গর্বিত হতে শিখিয়েছে। অথচ সে ছিল কেবল একজন ‘নিগার’ বা কালো মানুষ, কাফ্রিদের মানুষ যে নামে ডাকতো তেমন।

কিছুক্ষণ আমি (এই গল্পের সম্পাদক) ভেবেছিলাম এই লেখাটা কীসের ইঙ্গিত দিচ্ছে। হঠাৎ আমার সব মনে পড়ে গেল। আমার মনে পড়ল আমি তখন যুবক। ইয়র্কশায়ারে কোয়াটারমেইনের বাড়িতে তার অতিথি হয়ে রয়েছি। ডিনার শেষে এক সন্ধ্যায় হলের ভেতর আমরা বসেছিলাম। আমার সঙ্গে ছিলেন স্যার হেনরি কার্টিস আর ক্যাপ্টেন গুড। আমরা ধূমপান করছিলাম। কথা হচ্ছিল বীরত্বের নানা কাজ নিয়ে। আমাদের প্রত্যেকেই এমন কিছু সাহসিকতার কাজের কথা বললাম যা আমাদের মনে গভীর ছাপ ফেলেছিল। আমাদের বলা শেষ হলে বুড়ো অ্যালান বললেন —

যদি আপনাদের আপত্তি না থাকে, আমি এমন একটি ঘটনার কথা বলব যাকে আমি আমার দেখা সবচেয়ে সাহসী কাজগুলোর একটি মনে করি। এটা ঘটেছিল জুলু যুদ্ধের শুরুতে, যখন সৈন্যরা জুলুল্যান্ডে ঢুকছিল। তখন আমি সরকারের হয়ে মালপত্র আনা-নেওয়ার কাজ করতাম, যাকে ট্রান্সপোর্ট-রাইডিং বলে – আসলে সেনাবাহিনীর জন্য করতাম এই কাজ। আমি তাদের জন্য তিনটি ওয়াগনের ব্যবস্থা করেছিলাম। সেগুলোর সাথে দরকারি ফোরলুপার ও চালকরাও ছিল। প্রতিটি ওয়াগনের জন্য ছিল ষোলোটা ভালো তাগড়া ষাঁড়্র। আর পুরো দলটার দায়িত্বে আমি ছিলাম।

তারা আমাকে বেশ ভালো টাকা দিয়েছিল। আসলে কত দিয়েছিল তা আর নাই বললাম – বলতে গেলে একটু লজ্জা লাগে। আসলে সত্যিটা হলো, সেই জুলু যুদ্ধের সময় ইম্পেরিয়াল অফিসাররা অনেক বেশি দাম দিয়ে জিনিসপত্র কিনত। আমি এমন কিছু লোকের গল্প বলতে পারি, যাদের সবাই কিন্তু আমাদের কলোনির ছিল না, যারা কমিশন বা ঐ ধরনের কাজের মাধ্যমে খুব তাড়াতাড়ি ধনী হয়ে গিয়েছিল। তবে এ সব কথা মনে না রাখাই ভালো।

আমার কথা যদি বলেন, আমি আমার ওয়াগন ভাড়ার জন্য বেশ ভালো দাম চেয়েছিলাম এক ইউনিফর্ম পরা তরুণ ভদ্রলোকের কাছে। মাত্র তিন সপ্তাহ হলো তিনি এই দেশে এসেছিলেন। আর আমাকে অবাক করে দিয়ে তিনি সেই দাম দিতে রাজি হয়ে যান।

কিন্তু যখন আমি কমান্ডারদের কাছে গিয়ে তাদের সতর্ক করলাম যে তারা যেভাবে এগোচ্ছে তাতে বিপদ হতে পারে, তখন তাদের অহংকার এতটাই বেশি ছিল যে তারা এই বুড়ো শিকারী আর মাল আনা-নেওয়া করা লোকটার কথা শুনলই না। আমাকে ভদ্রভাবে বিদায় করে দিল। যদি তারা আমার কথা শুনত তাহলে ইজান্দলওয়ানা বিপর্যয় ঘটত না।

কোয়াটারমেইন কিছুক্ষণ চুপ করে কী যেন ভাবলেন। আমি জানতাম, এটা তার জন্য একটা কষ্টের বিষয় ছিল। তিনি এটা নিয়ে খুব কমই কথা বলতেন। যদিও তিনি নিজে বেঁচে ফিরেছিলেন, তবে সেই ভয়াল যুদ্ধে কোয়াটারমেইনের কয়েকজন বন্ধু মারা গিয়েছিল। এরপর তিনি আবার বলতে আরম্ভ করলেন:—

এবার সেই বুড়ো মাগেপার কথায় ফিরে আসি। আমি তাকে বহু বছর ধরে চিনতাম। আমাদের প্রথম দেখা হয় টুগেলার যুদ্ধে। আমি তখন রাজার ছেলে সুদর্শন উম্বেলাজির পক্ষে টুলওয়ানা রেজিমেন্টে লড়ছিলাম। যাই হোক, আগেই আপনাদের বলেছি, টুলওয়ানা রেজিমেন্ট প্রায় শেষ হয়ে গিয়েছিল। প্রায় তিন হাজার লোকের মধ্যে মনে হয় মাত্র পঞ্চাশ জন বেঁচে ছিল। যদিও তারা সেটওয়ায়ো এর পাঠানো তিনটি রেজিমেন্টকে শেষ করে দিয়েছিল। কিন্তু ভাগ্য ভালো, মাগেপা তাদের মধ্যে একজন যে বেঁচে গিয়েছিল।

পরে রাজা পান্ডার গ্রামে তার সাথে আমার দেখা হয়। আমার মনে পড়ল সে আমার পাশেই লড়েছিল। যখন আমি তার সাথে কথা বলছিলাম, যুবরাজ সেটওয়ায়ো পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন। আমার প্রতি তিনি বেশ নরম ছিলেন, কারণ তিনি জানতেন কী কারণে আমি সেই যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলাম। কিন্তু তিনি মাগেপার দিকে তাকিয়ে কটমট করে দেখলেন আর বললেন:—

‘কী মাকুমাজান! তুমি কিছুদিন আগে টুগেলায় যাদের নিয়ে আমাকে কামড়ানোর চেষ্টা করেছিলে, এ কি সেই কুকুরগুলোর একজন নয়? এ নিশ্চয়ই খুব ধূর্ত কুকুর, খুব দ্রুত দৌড়াতেও পারে। নইলে এত লোক মারা যাওয়ার পরও সে কীভাবে বেঁচে আছে আর ফোঁস ফোঁস করছে? ইস! আমার ইচ্ছে হয়, ওর গলায় একটা চামড়ার ফালি খুঁজে দেই।’

না, যুবরাজ, তা নয়,’ আমি উত্তর দিলাম। ওর রাজার দেওয়া সুরক্ষা আছে ওর কাছে আর ও একজন সাহসী মানুষ। আমার চেয়েও বেশি সাহসী। কারণ আমি টুলওয়ানা রেজিমেন্ট ছেড়ে পালিয়েছিলাম, কিন্তু ও যেখানে ছিল সেখানেই দাঁড়িয়েছিল।

‘তুমি বলতে চাও তোমার ঘোড়াটা ছুটে পালিয়েছিল, মাকুমাজান। ঠিক আছে, যেহেতু তুমি এই কুকুরটাকে পছন্দ করো, আমি ওকে আঘাত করব না।’ এই বলে কাঁধ ঝাঁকিয়ে তিনি চলে গেল।
তবুও আজ হোক বা কাল, ও আমাকে আঘাত করবেই,’ যুবরাজ চলে গেলে মাগেপা বলল। সেটওয়ায়ো এর স্মৃতি সূর্যাস্তের সময় গাছের ছায়ার মতো লম্বা। তাছাড়া, সে ভালো করেই জানে যে আমি ছুটে পালিয়েছিলাম, মাকুমাজান। তবে সেটা সব শেষ হওয়ার পরেই, আর স্থির দাঁড়িয়ে থেকে যখন কিছু করার ছিল না। আপনার মনে আছে, আমরা সেটওয়ায়োয়ের প্রথম রেজিমেন্টকে শেষ করে দেওয়ার পর দ্বিতীয় রেজিমেন্টটা আমাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিল আর আমরা সেটাও শেষ করে দিয়েছিলাম।
লড়াইয়ের সময় আমার মাথায় একটা লাঠির আঘাত লেগেছিল। এটা লেগেছিল আমার সদ্য লাগানো পুরুষদের আংটির উপর। আমি সম্ভবত সেই পুরনো যোদ্ধাদের দলের সবচেয়ে কমবয়সী ছিলাম। আংটিটা আমাকে বাঁচিয়েছিল। তবুও কিছুক্ষণ আমি জ্ঞান হারিয়ে মরা মানুষের মতো পড়ে ছিলাম। যখন আমার জ্ঞান ফিরল, দেখি লড়াই শেষ। আর সেটওয়ায়োয়ের লোকেরা আমাদের আহতদের খুঁজছে তাদের মেরে ফেলার জন্য। কিছুক্ষণ পর তারা আমাকে খুঁজে পেল। দেখল আমার শরীরে কোনো আঘাত নেই।

"এই তো একজন মরা সেজে আছে, একটা মরা দুর্গন্ধযুক্ত বেড়ালের মতো। একটা বড়সড় লোক বর্শা উঁচিয়ে বলল।"

তখনই আমি লাফিয়ে উঠে দৌড় দিলাম। আমি সদ্য বিয়ে করেছিলাম আর বাঁচতে চেয়েছিলাম। সে আমাকে বর্শা দিয়ে মারতে গেল, কিন্তু আমি বর্শার উপর দিয়ে লাফিয়ে গেলাম। আর অন্যরা যে বর্শাগুলো ছুড়েছিল সেগুলো আমার শরীরে লাগেনি।

তারপর তারা আমাকে তাড়া করতে শুরু করল। কিন্তু মাকুমাজান, আমার নাম রাখা হয়েছে "হরিণ" কারণ আমি জুলুল্যান্ডের যে কোনো মানুষের চেয়ে দ্রুত দৌড়াতে পারি। আমি তাদের সবাইকে পেছনে ফেলে নিরাপদে পালিয়ে এলাম।

‘সাবাশ মাগেপা,’ আমি বললাম। তবুও তোমাদের লোকজনের একটা প্রবাদ মনে রেখো – "শেষ পর্যন্ত শক্তিশালী সাঁতারু স্রোতের সাথে ভেসে যায় আর দ্রুত দৌড়ানো লোকটা ধরা পড়ে।"
হ্যাঁ, এটা আমি জানি, মাকুমাজান,’ সে মাথা নেড়ে বলল। আর হয়তো ভবিষ্যতে কোনোদিন এটা আমি আরও ভালোভাবে বুঝতে পারব।

সেই সময় আমি তার কথাগুলো তেমন পাত্তা দেইনি। কিন্তু ত্রিশ বছরেরও বেশি সময় পর আমার সেই কথাগুলো মনে পড়েছিল। মাগেপার সাথে আমার প্রথম পরিচয় এভাবেই হয়েছিল। এবার শুনুন বন্ধুরা, জুলু যুদ্ধের সময় কীভাবে আবার তার সাথে আমার দেখা হয়।

আপনারা তো জানেনই, আমি মূল সেনাদলের সাথে ছিলাম যারা বাফেলো নদীর ধারের রোর্ক'স ড্রিফট হয়ে জুলুল্যান্ডে ঢুকছিল। যুদ্ধ ঘোষণার আগে, যখন হয়তো যুদ্ধটা এড়ানো যেত আর অনেকেই সেটা ভেবেছিল তখন আমি রোর্ক'স ড্রিফট নামের সেই ছোট্ট স্টেশনটিতে মালপত্র নিয়ে যেতাম। সেটা পরে খুব বিখ্যাত হয়েছিল। আর ঐ সময়ে আমি সেটওয়ায়োয়ের পরিকল্পনা সম্পর্কে যতটা সম্ভব খবর জোগাড় করতাম।

শুনেছিলাম নদীর অন্য পাড়ে এক মাইলের মতো দূরে একটা ক্রাল আছে। সেখানকার লোকেরা নাকি ইংরেজদের খুব পছন্দ করে। তাই আমি সেখানে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। হয়তো ভাবছেন এটা একটা দুঃসাহসিক কাজ ছিল। কিন্তু আমি জুলুল্যান্ডে এতটাই পরিচিত ছিলাম যে রাজার বিশেষ অনুমতিতে আমি যেখানে খুশি যেতে পারতাম। কেউ আমাকে বিরক্ত করত না। আমি রাজকীয় সুরক্ষার মধ্যেই ছিলাম বলা যায়। তাই একা গেলে নিজের জন্য কোনো ভয় ছিল না।

সেই মতো এক সন্ধ্যায় আমি নদী পার হলাম এবং একটা গিরিপথের ভেতরের ক্রালের দিকে চললাম। আমাকে বলা হয়েছিল ক্রালটা সেখানেই আছে। মিনিট দশেক ঘোড়ায় চড়ার পর আমি গ্রামটা দেখতে পেলাম। এটা খুব বড় ক্রাল ছিল না। হয়তো ছয় কি আটটা কুঁড়েঘর ছিল আর একটা গরুর খোঁয়াড় ছিল যা সাধারণ বেড়া দিয়ে ঘেরা। জায়গাটা অবশ্য খুব সুন্দর ছিল। গিরিপথের জঙ্গল ঢাকা ঢালের সামনে একটু উঁচু জায়গায় গ্রামটা ছিল। আমি যখন কাছে গেলাম, দেখলাম মহিলা ও বাচ্চারা গ্রামের ভেতর ছুটে গিয়ে লুকিয়ে পড়ছে। আর আমি যখন গেটের কাছে পৌঁছলাম, কিছুক্ষণ কারো কোন সাড়াশব্দ ছিল না। শেষে একটা ছোট ছেলে বেরিয়ে এল এবং আমাকে জানাল গ্রামটা 'শুকনো লাউয়ের মতো খালি।

'ঠিক আছে, আমি উত্তর দিলাম। তবুও যাও এবং মোড়লকে বলো মাকুমাজান তার সঙ্গে কথা বলতে চান।'

ছেলেটি চলে গেল। কিছুক্ষণ পর আমি গেটের পাশ থেকে একটি মুখ উঁকি দিতে দেখলাম যা আমার চেনা মনে হচ্ছিল। ভালো করে দেখার পর সেই লোকটা বাইরে বেরিয়ে এল। তিনি ছিলেন একজন লম্বা, রোগা মানুষ, বয়স বোঝা যাচ্ছিল না, হয়তো ষাট থেকে সত্তর বছরের মধ্যে হবে। সুন্দর গড়নের মুখ, ছোট ধূসর দাড়ি, দয়ালু চোখ এবং খুব সুন্দর হাত - পা। তার আঙুলগুলো ছিল অসাধারণ লম্বা এবং অনবরত নড়ছিল।

'অভিবাদন মাকুমাজান,' তিনি বললেন। দেখছি আপনি আমাকে মনে করতে পারছেন না। আচ্ছা, টুগেলা যুদ্ধের কথা মনে করুন। আর টুলওয়ানা বাহিনীর শেষ মুহূর্তের লড়াইয়ের কথা। আর আমাদের প্রয়াত বাবা'র (রাজা পান্ডা) গ্রামে একটি নির্দিষ্ট আলোচনার কথা। আর মনে করুন যিনি তার জায়গায় বসেছেন (মানে সেটওয়ায়ো) তিনি কীভাবে আপনাকে বলেছিলেন যে তার সুযোগ থাকলে একটি নির্দিষ্ট লোকের গলার জন্য চামড়ার দড়ি খুঁজে নিতেন!"

আহ! আমি বললাম, এখন আমি তোমাকে চিনতে পেরেছি। তুমি মাগেপা হরিণ। তাহলে এখনো দৌড়বিদকে ধরা যায়নি!

'না মাকুমাজান, এখনো যায়নি। তবে সময় এখনো আছে। আমার মনে হয় খুব তাড়াতাড়ি অনেক দ্রুতগামী পা দৌড়াবে (যুদ্ধ শুরু হবে)।'

তোমার জীবন কেমন চলছে?' আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম।

‘ভালোই চলছে মাকুমাজান, সবদিক দিয়ে তবে একটি ছাড়া। আমার তিনজন স্ত্রী আছে। কিন্তু আমার ছেলেমেয়ে কম এবং তারা মারা গেছে। শুধু একটি মেয়ে বেঁচে আছে, যার বিয়ে হয়েছে আর সে আমার সঙ্গেই থাকে। কারণ তার স্বামীও মারা গেছে। একটি মহিষ তাকে মেরে ফেলেছিল। আর সে আর বিয়ে করেনি। আসুন ভেতরে এসে দেখুন।'

তাই আমি ভেতরে গিয়ে মাগেপার স্ত্রীদের দেখলাম। তারা সবাই ছিল বৃদ্ধা। এছাড়াও, তার মেয়ে গীতা আমাকে কিছু জমাট বাঁধা দুধ এনে দিল পান করার জন্য। সে ছিল সুন্দর গড়নের একজন মহিলা, দেখতে অনেকটা তার বাবার মতো, কিন্তু মুখটা ছিল বিষণ্ণ। হয়তো ভবিষ্যতে খারাপ কিছু হতে চলেছে এমন ভয় তার মুখে ছিল। তার আঙুল আঁকড়ে ধরে ছিল দু'বছরের কম বয়সী একটি সুন্দর ছেলে। সে মাগেপাকে দেখে তার দিকে ছুটে গেল এবং ছোট্ট হাত দিয়ে তার পা জড়িয়ে ধরল। বুড়ো লোকটি শিশুটিকে কোলে তুলে আদর করে চুমু খেল এবং বলল-

"এটা খুব ভালো যে এই ছোট্ট শিশুটি আর আমি একে অপরকে ভালোবাসি, মাকুমাজান। কারণ সে আমার বংশের শেষ ব্যক্তি। এখানে বাকি যে বাচ্চারা আছে তারা সবাই সেই সব লোকের সন্তান যারা আমার আশ্রয়ে থাকতে এসেছে।"

তাদের বাবা কোথায়? আমি জিজ্ঞেস করলাম এবং বাচ্চাটির গালে হাত বুলিয়ে দিলাম। তার মা আমাকে বলল বাচ্চাটির নাম সিনালা। আমার আদর করাটা তার পছন্দ হলো না।

"কাজের জন্য বাইরে গেছেন,' সংক্ষেপে উত্তর দিল মাগেপা। আর আমি অন্য প্রসঙ্গ শুরু করলাম।"
এরপর আমরা পুরনো দিনের কথা বলতে শুরু করলাম। আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম তার কাছে বিক্রি করার মতো কোনো ষাঁড় আছে কিনা। আমি বললাম যে এই কারণেই আমি ক্রালে এসেছিলাম।
"না মাকুমাজান,' সে একটু অন্য সুরে উত্তর দিলেন। এ বছর সব গরু রাজার সম্পত্তি।"

আমি মাথা নেড়ে বললাম যেহেতু এটাই নিয়ম, আমার বরং চলে যাওয়াই ভালো। তখন যেমনটা আমি আশা করছিলাম, মাগেপা ঘোষণা করল যে সে আমাকে নিরাপদে নদীর ধার পর্যন্ত পৌঁছে দেবে। তাই আমি তার স্ত্রীদের এবং বিধবা মেয়েটির কাছ থেকে বিদায় নিলাম এবং রওনা হলাম। ক্রালের এলাকা ছাড়তেই মাগেপা আমার কাছে মন খুলে কথা বলতে শুরু করল।

"মাকুমাজান, সে আমার দিকে অর্থপূর্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, যুদ্ধ হবে। আমি ঘোড়ার উপর বসে ছিলাম এবং সে আমার ঘোড়ার পাশে হাঁটছিল। সে বলল, কেপ থেকে আসা মহান শ্বেতাঙ্গ প্রধানের (স্যার বার্টল ফ্রেরের কথা বলছিল) দাবি সেটওয়ায়ো মানবে না। সে ইংরেজদের সঙ্গে লড়বে। তবে সে ইংরেজদেরই আগে শুরু করতে দেবে। সে ইংরেজদের জুলুল্যান্ডের ভেতরে টেনে আনবে এবং তারপর তার বাহিনী (ইম্পি) দিয়ে তাদের ঘিরে ফেলবে। তাদের মাটির সাথে মিশিয়ে দেবে আর শেষ করে দেবে। আর আমি যেহেতু ইংরেজদের ভালোবাসি, তাই খুব খারাপ লাগছে। হ্যাঁ, আমার বুক ফেটে যায়। এটা যদি বোয়ারদের সাথে হতো, আমি খুশি হতাম। কারণ আমরা জুলুরা বোয়ারদের ঘৃণা করি। কিন্তু ইংরেজদের ঘৃণা করি না। এমনকি সেটওয়ায়োও তাদের পছন্দ করে। তবুও, তারা যদি তাকে আক্রমণ করে, সে তাদের শেষ করে দেবেই।"

তাই নাকি, আমি উত্তর দিলাম। এরপর আমি আমার দায়িত্ব অনুযায়ী তার কাছ থেকে যত সম্ভব তথ্য বের করার চেষ্টা করলাম। এবং অনেক তথ্য পেয়েছি। যদিও সবটা বিশ্বাস করিনি, কারণ আমার সন্দেহ হয়েছিল যে মাগেপা যে খবরগুলো দিচ্ছে তা হয়তো তাকে ছড়িয়ে দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
ঠিক সেই সময়েই আমার মনে হলো পেছনের ঘন সবুজ ঝোপের ভেতর থেকে একটা শব্দ শুনতে পেলাম। শব্দটা এমন যেন কেউ কাশি চাপার চেষ্টা করছে। আমি ভয় পেয়ে গেলাম। কারণ কোনো গুপ্তচর যদি আমাদের কথা শুনে ফেলত তাহলে মাগেপার আর বাঁচা হতো না, আর আমি যত তাড়াতাড়ি নদী পার হতে পারতাম ততই ভালো হতো।

"ওটা কীসের শব্দ?' আমি জিজ্ঞেস করলাম"

"ঝোপের হরিণ, মাকুমাজান। এখানে অনেক আছে।"

আমি সন্তুষ্ট হতে পারলাম না। যদিও এটা সত্যি যে হরিণ এভাবে কাশে, আমি আমার ঘোড়াটাকে ঝোপের দিকে ঘোরালাম, ভেতরে ঢোকার জায়গা খুঁজতে লাগলাম। তখনই কিছু একটা শব্দ করে সরে গেল এবং লম্বা ঘাসের ভেতর অদৃশ্য হয়ে গেল। ঐ ছায়ায় যদিও আমি দেখতে পাইনি ওটা কী ছিল, কিন্তু যেটুকু আলো ছিল তাতে এমন কিছুর ডগায় আলো ঠিকরে পড়ল যা হয়তো একটা হরিণের শিংয়ের চকচকে ডগা অথবা একটা বর্শার ফলা হতে পারত।

"আমি তো বলেই ছিলাম ওটা একটা হরিণ, মাকুমাজান,' মাগেপা বলল। তবুও যদি বিপদের গন্ধ পান চলুন আমরা ঝোপের কাছ থেকে সরে যাই। যদিও এখনো কোনো শ্বেতাঙ্গকে স্পর্শ না করার নির্দেশ আছে।"

তারপর আমরা নদীর অগভীর অংশটির দিকে হেঁটে চললাম। কাফ্রিরা যেমনটি করে তেমনি মাগেপা খুব বিস্তারিতভাবে বলল কীভাবে সে তার মেয়ে আর নাতীকে আমার দায়িত্বে তুলে দেওয়ার ব্যবস্থা করবে। আমি তাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম কেন সে পরদিন সকালে না পাঠিয়ে তার পরের দিন সকালে পাঠাতে চাইছে। সে উত্তর দিল কারণ তার ধারণা ছিল সেদিন রাতে তার গ্রামে সেনাদলের একদল স্কাউট আসবে। তারা হয়তো পরদিন এবং তার চেয়ে বেশি সময় সেখানে থাকবে। তারা গ্রামে থাকা অবস্থায় গীতা আর তার ছেলেকে বাইরে পাঠানো তার জন্য কঠিন হবে, এমনকি অসম্ভবও হতে পারে।
নদীর ধারের কাছে আমরা আলাদা হয়ে গেলাম। আমি আমাদের অস্থায়ী ক্যাম্পে ফিরে এলাম এবং যা যা জেনেছিলাম তার উপর ভিত্তি করে একটি বিস্তারিত রিপোর্ট লিখলাম। যদিও এই রিপোর্টের উপর কেউ একটুও গুরুত্ব দিল না।

সকালের সময় গীতা ও ছেলেটির সাথে নদীর ধারে আমার দেখা করার কথা ছিল, তার আগের দিন ভোর হওয়ার একটু আগে আমি নদীতে গিয়েছিলাম মুখ ধুতে। ডুব দেওয়া হয়ে গেলে পোশাক পরার জন্য একটা চ্যাপ্টা পাথরের উপর উঠলাম। ঘন কুয়াশা নদীর সুন্দর মুক্তোর মতো ঢেউগুলো ঢেকে রেখেছিল। আমি সেই গভীর নীরবতার কথা ভাবলাম – প্রায় যেন শুনতে পাচ্ছিলাম সেই নীরবতা। তখনও কোনো জীবন্ত প্রাণী নড়াচড়া করছিল না।

ওহ! যদি আমি জানতাম সেই ভয়ানক দৃশ্য আর আওয়াজগুলো খুব তাড়াতাড়িই শোনা যাবে এই একই শান্তিময় জায়গায়! সত্যি বলতে, ঠিক সেই মুহূর্তে একটা আভাস যেন ভেসে এল। হঠাৎ সেই সম্পূর্ণ নীরবতা ভেঙে চূর্ণ হয়ে গেল একটি বুক কাঁপানো আর্তনাদে। তারপর আরও কিছু আর্তনাদ আর চিৎকার শোনা গেল। দূরে হলেও পরিষ্কার শোনা যাচ্ছিল। তারপর আবার নীরবতা নেমে এল।

তখন আমার মনে হলো, ঐ শব্দটা হয়তো মাগেপার ক্রাল থেকেই এসেছিল। তবে কুয়াশার মধ্যে শব্দের উৎস বোঝা কঠিন। যাই হোক শেষ পর্যন্ত আমি সূর্য ওঠা পর্যন্ত সেখানে অপেক্ষা করলাম। সূর্যের উজ্জ্বল আলো প্রথমে পড়ল যেখানে মাগেপার ক্রালটি ছিল সেখান থেকে আকাশের দিকে ওঠা এক বিশাল ধোঁয়ার কুণ্ডলীর উপর!

আমি মর্মাহত হয়ে ওয়াগনগুলোর কাছে ফিরে গেলাম। এত কষ্ট লাগছিল যে নাস্তা খেতে পারছিলাম না। হেঁটে আসার সময় খুব করে ভাবছিলাম এক কি দু'রাত আগে সেই সবুজ ঝোপের জায়গায় যেখানে মিষ্টি গন্ধের সাদা ফুল ফোটে, সেখানে কি আলোটা একটা হরিণের শিংয়ের ডগায় ঠিকরে পড়েছিল? নাকি হয়তো আমার গতিবিধি লক্ষ্য করা কোনো গুপ্তচরের বর্শার ফলার উপর পড়েছিল? যদি তাই হতো, তাহলে ঐ ধোঁয়ার কুণ্ডলী আর তার আগের সেই ভয়ংকর চিৎকারগুলো বোঝা সহজ। কারণ আমি আর মাগেপা একসাথে গোপন কথা বলেছিলাম, তাও আবার জুলু ভাষায়!

পরদিন সকালে ভোরবেলা আমি নদীর ধারে গেলাম ক্ষীণ আশা নিয়ে যে গীতা আর তার ছেলে হয়তো ব্যবস্থা মতো সেখানে এসে পৌঁছাবে। কিন্তু কেউ আসেনি। আর এটা অবাক করার মতো ছিল না। কারণ গীতা মৃত অবস্থায় পড়ে ছিল, তাকে বর্শা দিয়ে গেঁথে ফেলা হয়েছিল, যেমনটা আমি পরে দেখেছিলাম। সে বাচ্চাটাকে বাঁচানোর জন্য খুব লড়াই করেছিল। আর তার আত্মা চলে গিয়েছিল যেখানে সাহসী মানুষের আত্মা যায়, সে সাদা হোক বা কালো। শুধু নদীর অন্য পাড়ে কিছু জুলু স্কাউট দেখলাম। মনে হচ্ছিল তারা আমার উদ্দেশ্য জানে। তারা আমাকে ঠাট্টা করে ডেকে জিজ্ঞেস করছিল সেই সুন্দরী মহিলা কোথায় যার সাথে দেখা করতে এসেছিলাম?

এরপর আমি এই ব্যাপারটা মন থেকে বের করে দেওয়ার চেষ্টা করলাম। আমার মন তখন নানা চিন্তায় ভরা ছিল। কারণ ততক্ষণে যুদ্ধের জন্য স্পষ্ট নির্দেশ চলে এসেছিল। আর তার সাথে এসেছিল অনেক সৈন্য আর অফিসার।

ঠিক সেই সময়েই জুলুরা নদীর অন্য পাড় থেকে গুলি চালাতে শুরু করল আমাদের লোকদের দিকে। যদিও তারা নিশানা করে মারছিল, কিন্তু কারোর গায়েই লাগেনি। আমার অভিজ্ঞতা বলে, রাইফেল হাতে আনাড়ি লোক তখনই বিপজ্জনক যখন সে কিছু নিশানা করে না, কারণ তখন গুলি নিজেই নিজের পথ খুঁজে নেয় এবং গায়ে লেগে যেতে পারে। এই ঝামেলা বন্ধ করতে আমাদের পক্ষের স্থানীয় লোকজনের একটি রেজিমেন্টকে – সংখ্যায় হয়তো কয়েকশো হবে – নির্দেশ দেওয়া হলো নদী পার হয়ে গিরিপথ ও পাথরের আড়াল থেকে জুলুদের সরিয়ে দিতে। আমি দেখলাম তারা সুন্দরভাবে চলে গেল। আর বিকেলে নদীর অন্য পাড়ে প্রচুর চিৎকার আর বন্দুকের আওয়াজ শুনতে পেলাম।

সন্ধ্যার দিকে একজন এসে আমাকে বলল যে আমাদের 'ইম্পি' (সেনাদল) জয়ী হয়ে ফিরছে। তখন আমার অন্য কিছু করার ছিল না। আমি নদীর ধার দিয়ে হেঁটে গেলাম এমন এক জায়গায় যেখানে পানি গভীর ছিল আর পাড় উঁচু ছিল। এখানে আমি পাথরের স্তূপের উপর উঠলাম। সেখান থেকে আমার দূরবীন দিয়ে জুলুল্যান্ডের দিকের বিস্তীর্ণ সমভূমি দেখতে পাচ্ছিলাম, যা দূরে পাহাড় আর ঝোপঝাড়ের সঙ্গে মিশে গিয়েছিল।

কিছুক্ষণ পর আমাদের কিছু স্থানীয় লোককে দেখলাম। তারা দলছুট আর অগোছালোভাবে বাড়ির দিকে ফিরছিল কিন্তু স্পষ্টতই নিজেদের নিয়ে খুব গর্বিত দেখাচ্ছিল। তারা নিজেদের বর্শা নাড়াচ্ছিল আর যুদ্ধের গান গাইছিল। কয়েক মিনিট পর প্রায় এক মাইল দূরে একজন লোককে দৌড়াতে দেখলাম।
দূরবীন দিয়ে তাকে দেখতে দেখতে আমি তিনটি জিনিস লক্ষ্য করলাম।

প্রথমত, সে লম্বা ছিল।
দ্বিতীয়ত, সে অসাধারণ দ্রুত গতিতে দৌড়াচ্ছিল।
আর তৃতীয়ত, তার পিঠের উপর কিছু একটা বাঁধা ছিল। তার দৌড়ানোর কারন বোঝা গেল। কারণ তাকে তাড়া করছিল আমাদের এখানকার অনেক লোক। তাদের মধ্যে আরও বেশি লোক এই তাড়া করার দলে যোগ দিচ্ছিল। সব দিক থেকে তারা তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ছিল। চেষ্টা করছিল তার পথ আটকে তাকে মেরে ফেলতে। তারা যত কাছে আসছিল আমি দেখতে পাচ্ছিলাম তাদের ছোঁড়া বর্শাগুলো সূর্যের আলোয় ঝলকে উঠছিল।

খুব তাড়াতাড়িই আমি বুঝলাম লোকটা একটি নির্দিষ্ট উদ্দেশ্যে এবং একটি নির্দিষ্ট জায়গার দিকে দৌড়াচ্ছিল। সে নদীতে পৌঁছানোর চেষ্টা করছিল। এতগুলো লোক মিলে একটা বেচারাকে তাড়া করে মেরে ফেলছে – দৃশ্যটা আমার কাছে খুবই নিদারুন মনে হলো। এছাড়াও আমি ভাবছিলাম কেন সে পিঠের বোঝাটা ফেলে দিচ্ছে না। মনে হলো সে একজন ওঝা হবে, আর বোঝাটার ভেতর হয়ত তার মূল্যবান তাবিজ বা ওষুধপত্র আছে।

সে তখনও অনেক দূরে ছিল। কিন্তু যখন সে আরও কাছে এল প্রায় তিন-চারশো গজের মধ্যে, হঠাৎ করেই তার মুখের আদল চিনতে পারলাম। বুঝতে পারলাম সেটা মাগেপার মুখ!

‘হায় আল্লাহ! আমি মনে মনে বললাম। এটা সেই বুড়ো মাগেপা হরিণ, আর পিঠের মাদুরের ভেতরের বোঝাটা হবে ওর নাতী, সিনালা।’

"হ্যাঁ, তখন আমি প্রায় নিশ্চিত ছিলাম যে সে বাচ্চাটাকে পিঠের উপর বয়ে নিয়ে যাচ্ছে।"

তখন আমার কী করার ছিল? আমার পক্ষে ঐ জায়গায় নদী পার হওয়া সম্ভব ছিল না। আর অগভীর জায়গা দিয়ে ঘুরে আসতে অনেক দেরি হয়ে যেত। আমি পাথরের উপর উঠে চিৎকার করে বললাম ঐ অসভ্য স্থানীয় লোকগুলোকে যেন বৃদ্ধকে ছেড়ে দেয়। তারা এতটাই উত্তেজিত ছিল যে আমার কথা শুনতে পায়নি। অন্তত তারা পরে শপথ করে বলেছিল যে তারা ভেবেছিল আমি নাকি লোকটাকে তাড়া করতে উৎসাহ দিচ্ছিলাম।

কিন্তু মাগেপা আমার কথা শুনতে পেল। সেই মুহূর্তে মনে হচ্ছিল সে আর পারছে না কিন্তু আমাকে দেখে মনে হলো যেন সে নতুন শক্তি পেল। সে নিজেকে সামলে নিল এবং সত্যি অবাক করা গতিতে সামনে ঝাঁপিয়ে পড়ল। এখন নদীটা তার থেকে তিনশো গজের বেশি দূরে ছিল না। আর প্রথম দুশো গজ সে তার তাড়াকারীদের থেকে এগিয়ে ছিল, যদিও তাদের বেশিরভাগই যুবক ছিল এবং তুলনামূলকভাবে শক্তিশালী ছিল। তারপর আবার তার শক্তি কমতে শুরু করল।

দূরবীন দিয়ে দেখতে দেখতে আমি বুঝতে পারছিলাম তার মুখ পুরোপুরি খোলা ছিল। আর ঠোঁটের উপর লালচে ফেনা। পিঠের বোঝাটা তাকে নিচে টেনে ধরছিল। একবার সে বোঝাটা খুলে ফেলার জন্য হাত তুলল যেন। তারপর একটা পাগলের মতো ইশারা করে হাত আবার নামিয়ে ফেলল।

যারা তাড়া করছিল তাদের মধ্যে দুজন যারা বাকিদের চেয়ে এগিয়ে ছিল, তারা তার কাছে এগিয়ে এল। তারা ছিল লম্বা, রোগা লোক, বয়স তিরিশের বেশি নয়। তাদের হাতে ছিল বর্শা। তাদের একজন অন্যজনের চেয়ে একটু এগিয়ে গেল। তখন মাগেপা নদীর ধার থেকে পঞ্চাশ গজের বেশি দূরে ছিল না। প্রথম লোকটি ছিল তার প্রায় দশ কদম পেছনে এবং দ্রুত এগিয়ে আসছিল। মাগেপা কাঁধের উপর দিয়ে তাকিয়ে দেখল। তারপর তার শেষ শক্তিটুকু দিয়ে চল্লিশ গজ তীরের মতো ছুটল। যারা তাড়া করছিল তাদের থেকে সোজা দূরে দৌড়ে গেল। নদীর ধার থেকে কয়েক ফুটের মধ্যে এসে সে হোঁচট খেল আর পড়ে গেল।

'এই শেষ,' আমি বললাম। আমার হাতে যদি রাইফেল থাকত, তাহলে আমি ঐ রক্তপিপাসু লোকগুলোর এক বা দুজনকে গুলি করে থামিয়ে দিতাম আর যা হওয়ার হতো, সেটা মেনে নিতাম।

কিন্তু না! ঠিক যখন প্রথম লোকটা তার চওড়া বর্শাটা তার পিঠে গেঁথে দেওয়ার জন্য তুলল, যার উপর বোঝাটা ছিল, মাগেপা লাফিয়ে উঠে ঘুরে দাঁড়াল বুকের উপর আঘাত নেওয়ার জন্য। স্পষ্টতই, একটি বিশেষ কারণে সে পিঠে বর্শার আঘাত নিতে চায়নি। নিশ্চিতভাবে আঘাতটা লাগল। তবু এটা মাগেপাকে এফোঁড়-ওফোঁড় করতে পারেনি। হয়তো কোনো হাড়ে লেগেছিল। সে বর্শাটা টেনে বের করল এবং লোকটার দিকে ছুড়ে মেরে তাকে আহত করল। তারপর টাল খেতে খেতে পেছনের দিকে গেল ছোট্ট খাড়া পাড়টার ধার পর্যন্ত। অবশেষে পৌঁছাল।

‘আমাকে বাঁচাও, মাকুমাজান!’ বলে চিৎকার করে ঘুরে দাঁড়াল, আর অন্য লোকটা তাকে বর্শা মারার আগেই সোজা গভীর পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়ল। সে ভেসে উঠল। হ্যাঁ, সেই সাহসী বুড়ো ভেসে উঠল আর অন্য পাড়ের দিকে সাঁতার কাটতে শুরু করল। তার পেছনে রক্তের একটা ছোট্ট রেখা দেখা গেল।

আমি ছুটে গেলাম বা বলা ভালো লাফিয়ে আর গড়িয়ে নিচে নামলাম নদীর ধার পর্যন্ত। যেখানে নুড়িপাথরের একটা অংশ পানিতে ঢুকে গিয়েছিল। এটা ধরে এগিয়ে গেলাম আর এর পরেই কোমর পর্যন্ত পানিতে নামলাম। এখন মাগেপা আমার গা ঘেঁষে ভেসে যাচ্ছিল। আমি তার বাড়ানো হাতটা ধরলাম এবং তাকে পাড়ে টেনে তুললাম।

ছেলেটা! সে কষ্টে শ্বাস নিতে নিতে বলল। ও কি মরে গেছে?

আমি মাদুরের বাঁধনগুলো কেটে দিলাম। এর ভেতরে ছিল ছোট্ট সিনালা। পানিতে ভিঝে গিয়েছিলো, কিন্তু স্পষ্টতই সে জীবিত এবং অক্ষত ছিল। কারণ কিছুক্ষণ পরেই সে চিৎকার করে উঠল।

"না, আমি বললাম। সে বেঁচে আছে, আর বাঁচবে।"

তাহলে সব ঠিক আছে, মাকুমাজান। ঝোপের ভেতর গুপ্তচরই ছিল, হরিণ নয়। সে আমাদের কথা শুনে ফেলেছিল। রাজার ঘাতকরা এসেছিল। গীতা কুঁড়েঘরের দরজা ধরে রেখেছিল, আর আমি বাচ্চাটাকে নিয়েছিলাম। আমার বর্শা দিয়ে খর বা চালের ভেতর একটা গর্ত করলাম এবং পেছনের দিক দিয়ে সরে পড়লাম। মারা যাওয়ার আগে গীতার শরীরে অনেক বর্শা গেঁথে দেওয়া হয়েছিল, কিন্তু আমি ছেলেটাকে নিয়ে সরে পড়তে পেরেছিলাম। আপনার এখানকার কাফ্রিগুলো আমাকে খুঁজে পাওয়ার আগে পর্যন্ত আমি ঝোপের ভেতর লুকিয়ে ছিলাম নাটাল পালিয়ে যাওয়ার আশা নিয়ে। তারপর নদীর দিকে দৌড় দিলাম আর অন্য পাড়ে আপনাকে দেখতে পেলাম। হয়তো আমি নিজে বেঁচে যেতে পারতাম, কিন্তু বাচ্চাটা ভারী ছিল।

'ওকে খেতে দিন, মাকুমাজান, ওর নিশ্চয়ই খিদে পেয়েছে।
(কিছুক্ষণ চুপ থেকে) বিদায়।
আপনার সেই কথাটা ভালো ছিল – দ্রুত দৌড়ানো লোকটা শেষ পর্যন্ত ধরা পড়ে যায়। আহ! তবুও আমার দৌড়ানো বৃথা যায়নি। তারপর সে এক হাতের উপর ভর দিয়ে উঠল। অন্য হাত দিয়ে প্রথমে সিনালাকে আর তারপর আমাকে অভিবাদন করল। বিড়বিড় করে বলল, 'আপনার প্রতিজ্ঞা মনে রাখবেন, মাকুমাজান।

এভাবেই মাগেপা হরিণ মারা গিয়েছিল। বোঝা নিয়ে ওর মতো ভালো দৌড়াতে পারত এমন কাউকে দেখিনি, এই বলে কোয়াটারমেইন মুখ ঘুরিয়ে নিলেন। মনে হলো ঘটনাটার কথা মনে করে তিনি কিছুটা প্রভাবিত হয়েছিলেন।

"বাচ্চা সিনালার কী হলো? কিছুক্ষণ পর আমি জিজ্ঞেস করলাম।"

ওহ! আমি তাকে নাটালের একটি প্রতিষ্ঠানে পাঠিয়ে দিয়েছিলাম। আর পরে তার কিছু সম্পত্তি ফেরত এনে দিতে পেরেছিলাম। আমার বিশ্বাস, সে এখন অনুবাদক হিসেবে প্রশিক্ষণ নিচ্ছে।

ই-মেইল সাবস্ক্রিপশন

Enter your email address:

Delivered by FeedBurner

ক্যাটাগরীসমূহ

পৃষ্ঠাসমূহ

Creative Commons License
This work is licensed under a Creative Commons Attribution 3.0 Unported License.
Protected by Copyscape

ব্লগটি মোট পড়া হয়েছে

বাঙলা ব্লগ. Powered by Blogger.

- Copyright © মেহেদী হাসান-এর বাঙলা ব্লগ | আমার স্বাধীনতা -Metrominimalist- Powered by Blogger - Designed by Mahedi Hasan -