.....
- Back to Home »
- আমার লেখা , ভ্রমন কাহিনী »
- লঞ্চ ভ্রমন
এখন বর্ষাকাল। যার ফলে ট্রলারে করে ভ্রমনের মধ্যে আলাদা একটা আনন্দ আছে। তাছাড়া আমাকে লঞ্চঘাটে যাবার জন্য ট্রলারে করেই যেতে হবে। বিকল্প কোন ব্যবস্থা নেই। ট্রলার ঘাট খুজতে গিয়েই লাগল বিপত্তি। কর্তৃপক্ষ তিন তিনটা ট্রলার ঘাটের সূচনা করেছে। যাক অবশেষে পাওয়া গেল কাঙ্খিত ট্রলার ঘাটটি। আমার প্রথম গন্তব্য হচ্ছে কালিরবাজার। যেখানে লঞ্চঘাট অবস্থিত। আমি যে ট্রলারে করে কালিরবাজার যাব সেটি দেখতে অনেকটা ইন্ডিয়ান ছোট আকৃতির ক্যানুর ন্যায়। যার দু মাথা চোখা মধ্যখান স্ফিত। তো উঠে বসলাম তাতে। আর হ্যা ট্রলারের কিন্তু কোন ছাউনি নেই। কী কারনে এ ব্যবস্থা বুঝতে পারলাম না । এটা কতৃপক্ষের নীর্বুদ্ধিতা নাকি ভুল, ঠিক বুঝতে পারলাম না। এটা বলছি এ কারনে যে, ভোরের দিকেই এক পশলা বৃষ্টি হয়ে গেছে। আর আকাশ মেঘলা থাকায় যেকোন মুহূর্তে বৃষ্টির আশংখা করা অমূলক কিছু নয়।
যাই হোক ঠিক সাড়ে দশটায় সাতাশ জন যাত্রী নিয়ে আমাদের ট্রলারটি রওনা দিল। যার ধারন ক্ষমতা ছিল মাত্র বিশ জন। তাও সর্বোচ্চ। এই অতিরিক্ত যাত্রী বহনের কুফল আমরা শীঘ্রই টের পেলাম। ট্রলারের বিভিন্ন স্থান থেকে পানি উঠতে লাগল। আসলে ঠিক কয়টা যায়গা থেকে পানি উঠেছিল সেটা আমি নির্ণয় করতে না পারলেও নিজের চোখে তিন চারটি উৎস থেকে প্রত্যক্ষ করলাম। একজন পানি সেচতে সোচ্চার হল। এই কাজটির জন্যই হয়ত পরবর্তীতে আমরা ট্রলার ডুবির হাত থেকে রেহাই পেলাম। সবই মহান আল্লাহ তা'আলার কুদরত। পানি কেটে কেটে চলছে আমাদের ট্রলার।
আশেপাশের গ্রাম্য-প্রাকৃতিক দৃশ্যগুলোর বর্ণনা না দিলেই নয়। আকাশ মেঘলা। কোথাও কালো আবার কোথাও সাদা। চকের মাঝে দ্বীপের মত কয়েকটা বাড়ী দেখা যাচ্ছে। আশেপাশের অস্বচ্ছ ঘোলাটে পানিতে কচুরিপানার আধিক্য চোখে পড়ার মত। এই কচুরিপানার ফাঁকে ফাঁকে হাস নামক গৃহপালিত পাখিটি নিজের খাদ্য খুজছে অবিরাম ধারায়। একবার ডুব দেয় তো আবার ভেসে উঠে। আবার ডুব আবার ভেসে উঠা। ডুব-ভাসা, ডুব-ভাসা চলছেই। আমাদের ট্রলার চালককে কিছুটা অদক্ষ বলতে হবে। বর্ষাকাল বিধায় তিনি আসল দিক নির্দেশনা ভুলে গেছেন। একজন দক্ষ চালকের ক্ষেত্রে যা কখনও কল্পনাই করা যায় না। তো তিনি এখানে সেখানে আবোল তাবোল ট্রলার ঘুরিয়ে অনেক বিলম্ব করে কালিরবাজারে পৌছালেন। আমরাও ট্রলারের মটরের একটানা গর-গর আওয়াজ থেকে রক্ষা পেলাম।
কালিরবাজার পা রেখে সবাই হাফ ছেড়ে বাচল যেন। নির্ধারিত দশ টাকা ভাড়া দিলাম ট্রলারের চালকের হাতে। এবার অপেক্ষা লঞ্চ আসার। লঞ্চ টার্মিনালে দেখলাম দুজন পুলিশ তাদের নির্ধারিত বা নির্দেশিত দায়িত্ব পালন করছে। নাহ্ দেশটাকে এখন দেশ বলা যায়। অবশেষে দীর্ঘ একঘন্টা পর লঞ্চ এল তার জন্য নির্ধারিত সময়ের পনের মিনিট বিলম্ব করে। লঞ্চ দেখে তো চক্ষু চড়কগাছ। কথা ছিল আসবে বড় লঞ্চ। যার টাইটেল এম.ভি.......... এরকম টাইপের। কিন্তু একি! এযে একেবারেই ছোট লঞ্চ।
বড় লঞ্চ ভ্রমনের আশা আজকের জন্য আমার ত্যাগ করতে হল। লঞ্চে উঠলাম। লঞ্চ দোতলা। নীচে সাধারন যাত্রীদের আসন আর উপরে বিলাস। বিলাসে ঢুকলাম। কাঠের ফ্রেমে লেখা "বিলাসের ভাড়া দেড়গুন"। হ্যা, এই তাহলে বিলাসের নমুনা ! সাধারনত আমরা স্কুলে যে বেঞ্চিতে বসতাম অনেকটা সেরকম বেঞ্চিই এখানে সাড়িবদ্ধভাবে সাজানো। এক বেঞ্চে দুজন। নিজের ব্যাগ বা লাগেজ ফ্লোরে রাখতে হয় অথবা পায়ের উপর রাখতে হয়। ফ্লোর নোংরা। আমি আমার ব্যাগটা পায়ের উপরেই রাখলাম। আমাদের লঞ্চ চালকের বয়স আনুমানিক পয়ষট্টি। যৌবনকালে দেহের চামড়া সাদাই ছিল। কালে কালে রোদের তাপে তা তামাটে রূপ ধারন করেছে। চেহারায় রূক্ষতার ছাপ স্পষ্ট। তিনি দৃঢ়ভাবে চালকের আসনে বসে আছেন। মনে হচ্ছে তিনি অনেক বড় একটি জাহাজের নাবিক।
লঞ্চ ছাড়া হল। এগিয়ে চলছি আমরা। আশেপাশের প্রকৃতিক দৃশ্যাবলী মুগ্ধ করার মত। যার বর্ণনা আমি দেব না কারন লঞ্চে বসে এত কথা লেখা যায় না। আশেপাশের হকারদের চিত্কার, যাত্রীদের কথোকপোথনের ফলে বারবারই চোখ তুলে তাকাতে হয়। যার ফলে মনোযোগে ছেদ পড়ে। লঞ্চ এতক্ষনে চলে এসেছে প্রথম স্টেশনে। ও হ্যা, বলাই হয়নি। মতলব যেতে হলে একে একে ৯টি লঞ্চ টার্মিনাল অতিক্রম করতে হয়। লঞ্চ একে একে অতিক্রম করল (প্রথম থেকে) শ্রীরায়েরচর, দূর্গাপুর, নন্দলালপুর, নায়েরগাঁও, শাহপুর, শ্যামপুর, টরকী, লক্ষীপুর ও এনায়েতনগর। তার পরেই মতলব (জেলা - চাঁদপুর)। মানে আমার গন্তব্যস্থল।
আশেপাশের দুপাড়ের প্রাকৃতিক দৃশ্যাবলী শুধু উপভোগই করা যায়। হালকা সবুজ আর গাঢ় সবুজের কারসাজি। সূর্যের আলোতে প্রখরতা নেই কারন আকাশ মেঘলা। পাখিদের আনাগোনাও তেমন লক্ষ্যনীয় নয়। তবে সবকিছু ছাপিয়ে সর্ব প্রথমেই দৃষ্টিগোচর হয় টাওয়ারগুলো। হ্যা, মোবাইল কোম্পানীগুলোর টাওয়ার। আশেপাশের সকল গাছপালাকে ছাড়িয়ে এসকল টাওয়ারগুলো অনেক উপরে উঠে গেছে। লঞ্চ যখন মতলব টার্মিনালে ভিড়ল তখন ঘড়িতে সময় দুপুর আড়াইটা। তারপর আমি কিভাবে কোথায় গেলাম সেটা বলছি না। কারন অজানাই থাক। আর হ্যা, তারিখটি ছিল ২৪শে জুলাই ২০০৭।
জুলাই ২৪, ২০০৭। লঞ্চে বসে লেখা হয়েছে।