.....
- Back to Home »
- কৃষি জিজ্ঞাসা , চিত্তাকর্ষক সংবাদ »
- নার্সারি গ্রাম বুড়িয়ারডাঙ্গা
খুলনা জেলার ফুলতলা উপজেলার একটি ছোট গ্রাম বুড়িয়ারডাঙ্গা। গ্রামটি যশোর-খুলনা মহাসড়ক লাগোয়া। এ মহাসড়কের পাশেই রয়েছে গাছের চারা বিক্রির সারি সারি দোকান। চমৎকার তাদের নাম।
নানা প্রকার গাছ-গাছালির ঘেরাটোপে বন্দি গ্রামটি। এদেশের আর দশটি গ্রামের মতোই চিরসবুজ চিরশান্ত। বাইরে থেকে বোঝার উপায় নেই গ্রামটির বিশেষত্ব। গ্রামে ঢোকার পথ রয়েছে বেশক'টি। তার যে কোনও একটি দিয়ে প্রবেশ করলে চোখে পড়বে গ্রামটির বৈশিষ্ট্য। এ গ্রামের প্রতিটি বাড়ির উঠানে, আঙিনায় ও ক্ষেত-খামারে গড়ে উঠেছে নার্সারি। এ পথ দিয়ে যতদূর যাওয়া যায়, যতদূর দেখা যায় চোখে পড়ে শুধু নার্সারি আর নার্সারি। আরও দেখা যায়, কোনও কোনও নার্সারির মাঝখানে গোলপাতার তৈরি ঘরের নিচে বসে কৃষি মজুররা বিশ্রাম নিচ্ছে, কেউ কেউ জমি নিড়াচ্ছে। গ্রামটির নাম বুড়িয়ারডাঙ্গা। স্থানীয় লোকজন বলে নার্সারি গ্রাম। এ বিচিত্র গ্রামের বেশিরভাগ লোকই কোনও না কোনওভাবে নার্সারি পেশার সঙ্গে যুক্ত। নার্সারির কারণেই এ গ্রামের সব মানুষের ভাগ্য বদলে গেছে। গ্রামটিও ব্যাপক পরিচিতি পেয়েছে।
খুলনা জেলার ফুলতলা উপজেলার একটি ছোট গ্রাম বুড়িয়ারডাঙ্গা। গ্রামটি যশোর-খুলনা মহাসড়ক লাগোয়া। এ মহাসড়কের পাশেই রয়েছে গাছের চারা বিক্রির সারি সারি দোকান। চমৎকার তাদের নাম। এসব দোকানের পেছনেই রয়েছে গ্রামটি। এ গ্রামের লোকজনের যার যতটুকু জমি আছে, তার মধ্যে তারা গড়ে তুলেছে নার্সারি। যারা চাকরি বা অন্য পেশার সঙ্গে যুক্ত তারাও অবসর সময়ে নার্সারি পরিচর্যা করে। এ গ্রামে নার্সারি গড়ার পেছনে রয়েছে ছোট এক ইতিহাস। শেখ আবু বক্কর নামের এ গ্রামের এক লোক ব্রিটিশ আমলে কলকাতায় চাকরি করতেন। তিনি একবার বাড়ি ফেরার সময় শখ করে কলকাতা থেকে গোলাপ ফুল গাছের একটি চারা এনে বাড়ির উঠানে লাগান। কিছুদিন পরই গাছটিতে অভাবনীয় ফুল ধরে। এতে তিনি ভীষণ উৎসাহিত হন এবং প্রতিবার ছুটিতে বাড়ি ফিরে আসার সময় নানা জাতের ফুল, ফল ও ঔষধি গাছের চারা এনে লাগিয়ে একই ফল পান। শেখ আবু বক্করের এ সাফল্যের কথা সারা গ্রামে ছড়িয়ে পড়ে। তার প্রতিবেশী এবং আত্দীয়স্বজন এসে তার কাছ থেকে চারা ও বীজ সংগ্রহ করে নিজেদের উঠানে ও বাগানে লাগিয়ে ব্যাপক সাফল্য পায়। তবে প্রথমদিকে সবাই শখের বশেই ফুল-ফল গাছের চারা লাগাত। কিন্তু দিন দিন এসব গাছের চারা ও বীজের চাহিদা বেড়ে গেলে কেউ কেউ বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদন শুরু করে। গাছের চারা উৎপাদন লাভজনক হওয়ায় বুড়িয়ারডাঙ্গা গ্রামের প্রায় সবাই এ ব্যবসার সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে। যার যতটুকু জমি আছে, তার মধ্যেই নার্সারি গড়ে তোলে। ধীরে ধীরে পুরো গ্রামের চেহারা যায় পাল্টে।
ফুলতলার বুড়িয়ারডাঙ্গা গ্রামে নার্সারি গড়ে ওঠার মূল কারণটি হচ্ছে এখানকার মাটি। এ গ্রামের মাটির গুণ এমনই যে, যে কোনও গাছের চারা লাগালেই তা কিশোরীর শরীরের ন্যায় লকলকিয়ে বেড়ে ওঠে। আর ভালো জাতের বীজ বা চারা রোপণ করলে তার ফলন হয় আরও বেশি। এ গ্রামের মাটির বৈশিষ্ট্য হচ্ছে দো-আঁশযুক্ত এবং উঁচু। বন্যা অথবা অতিবৃষ্টির কারণে জমিতে পানি জমে না। বৃষ্টির পানিতে এখানকার মাটি পিচ্ছল বা কাদা হয় না। আবার প্রচণ্ড খরায় মাটির রস শুকিয়ে যায় না। মাটির এতসব গুণের কারণেই এখানে সব ধরনের গাছের কলম ভালো হয়।
এ গ্রামের নার্সারিগুলোতে এখন সব ধরনের গাছের চারা উৎপাদন হয়। সাধারণ ও হাইব্রিড উভয় জাতের ফুল, ফল, বনজ ও ঔষধি গাছের চারা পাওয়া যায়। তবে সবচেয়ে বেশি বিক্রি হয় ফুল গাছের চারা। ফুল গাছের চারার মধ্যে রয়েছে গোলাপ, ডালিয়া, শিউলি, রক্তজবা, সাদা জবা, নীলকণ্ঠ, মালতি, রক্তকরবী, পলাশ, জিনিয়া, কনকচাঁপা, গাঁদা, রজনীগন্ধা, গন্ধরাজ, নাইট কুইন, চন্দ্র মল্লিকা, শিমূল, বকুল প্রভৃতি। এখানকার নার্সারিগুলোতে শুধু শতাধিক প্রকারের গোলাপ ফুল গাছের চারা উৎপাদন হয়। বিশ্বের প্রায় সব দেশের গোলাপই এখানকার নার্সারিগুলোতে পাওয়া যায়।
নানা রকমের ফল গাছের চারা উৎপাদনের জন্যও এ গ্রামটি বিখ্যাত। আম, জাম, কাঁঠাল, নিচু, আঙ্গুর, খেজুর, নারিকেল, বরই, আমড়া, সফেদা, কামরাঙ্গা, জলপাই, লটকন প্রভৃতি জাতের ফলের গাছের চারা এখানে পাওয়া যায়। সবচেয়ে বেশি বিক্রি হয় আম গাছের চারা। বিভিন্ন জাতের ও নামের আম গাছের চারাই উৎপাদন হয় দু'ডজনের উপরে। এরপর বিক্রি হয় নারিকেল গাছের চারা। বিভিন্ন প্রকার ঔষধি ও বনজ গাছের চারাও এখানে উৎপাদন হয়। এসব গাছের মধ্যে রয়েছে আমলকী, হরিতকী, বহেরা, নিম, তুলসী, বাসক, নিসিন্দা, অজুর্ন, অশোক ইত্যাদি। বনজ গাছের চারার মধ্যে আছে ঝাউ, বট, মেহগনি, শিরিষ, দেবদারু, গোলপাতা, পাতাবাহার, করই, হিজল, তমাল, হেতাল ইত্যাদি। একাধিক প্রকার বটগাছের চারা এখানে উৎপাদন হয়। এসব গাছের চারা ছাড়াও লেবু, বাতাবি লেবু, নাশপাতির চারাসহ বহু বিচিত্র গাছের চারাও এখানকার নার্সারিগুলোতে উৎপাদন হয়।
বুড়িয়ারডাঙ্গা গ্রামের নার্সারির মালিকরা নানা উৎস থেকে ভালো জাতের ফুল, ফল ও ঔষধি গাছের বীজ সংগ্রহ করেন। তারা প্রয়োজনে ইউরোপ, আমেরিকা, চীন, ভারত, থাইল্যান্ড প্রভৃতি দেশ থেকে ভালো জাতের ফুল ও ফল গাছের বীজ সংগ্রহ করেন। মাটি ভালোমতো পরিচর্যা করে সার ও খৈল মিশিয়ে তারপর বীজ রোপণ করা হয়। বীজ ও চারাকে যাতে পোকামাকড় থেকে মুক্ত রাখা যায় তার জন্য কীটনাশক ওষুধ ব্যবহার করা হয়। প্রত্যেক জাতের ফুল ও ফল গাছের জন্য আলাদা আলাদা বীজতলা তৈরি করা হয়। চারা একটু বড় হলেই বিক্রি শুরু হয়। যশোর-খুলনা মহাসড়কের পাশে প্রত্যেক নার্সারির বিক্রয় কেন্দ্র আছে। সেখানেই চারা বিক্রি করা হয়। সবচেয়ে বেশি চারাগাছ বিক্রি হয় বর্ষকালে। তাই এখন নার্সারিগুলোতে সাজসাজ রব। তবে এখানকার নার্সারিগুলোতে সারাবছরই চারা উৎপাদন ও বিক্রি হয়।
দেশের দক্ষিণাঞ্চলীয় জেলা খুলনার এই ছোট শ্যামল গ্রামটিতে রয়েছে দু'শতাধিক নার্সারি। প্রত্যেক নার্সারিতে গড়ে ৫-৭ জন কৃষি মজুর কাজ করে। কিছু মজুর এ গ্রামের অধিবাসী। বাকিরা বিভিন্ন স্থান থেকে আসা মজুর। তিনবেলা খাবার দিয়ে প্রত্যেক মজুরকে দৈনিক ১২০ থেকে ১৫০ টাকা পর্যন্ত পারিশ্রমিক দিতে হয়। তারপরও নার্সারিগুলো ভালো ব্যবসা করে। পাইকারি ও খুচরা উভয়ভাবে এখানে চারা বিক্রি হয়। গাছের চারা ১০ থেকে ৫০০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হয়। গ্রামটির অবস্থানগত কারণে খুব সহজে এখান থেকে দেশের যে কোনও স্থানে ট্রাকে করে চারা পাঠানো যায়। এখানকার নার্সারি থেকে ব্যবসায়ীরা চারা কিনে দক্ষিণবঙ্গ ও উত্তরবঙ্গের হাটবাজার এবং মেলায় বিক্রি করে। এ পথ দিয়ে যাতায়াতকারী বিভিন্ন পেশার মানুষ গাড়ি কিংবা ভ্যানে করে চারা কিনে নিয়ে যায়।
বুড়িয়ারডাঙ্গা গ্রামের মানুষের একান্ত নিজস্ব উদ্যোগে এ নার্সারি শিল্প গড়ে উঠেছে। দেশে পরিবেশ রক্ষায় ও বৃক্ষায়নে এ গ্রামের নার্সারিগুলো ব্যাপক অবদান রেখে চলেছে। কোনও কোনও নার্সারির মালিক সরকার কতৃর্ক পুরস্কারও পেয়েছেন। বাবুল হাসান, মনিরুল, ওহিদুলের মতো বেকার যুবকরা নিঃস্ব অবস্থা থেকে নার্সারির বিনিময়ে আজকে লাখোপতি হয়েছে। এ গ্রামে কোনও বেকার নেই। কোনও নিরক্ষর লোকও নেই। এ গ্রামের মানুষ অন্য গ্রামে আত্দীয়স্বজনের বাসায় বেড়াতে গেলে ফুল বা ফলের গাছের চারা সঙ্গে করে নিয়ে যান। আত্দীয়স্বজনরা একবাঙ্ মিষ্টির চেয়ে এ গ্রামের একটি ফুল বা ফল গাছের চারা উপহার পেলে বেশি খুশি হয়।
তথ্য সূত্র: দৈনিক যুগান্তর