.....


লেখক: দিলীপ কুমার সাহা
স্ত্রীর এক ভরি ওজনের স্বর্ণের হার বিক্রি করে ৫০টি হাঁস কিনে পালন শুরু করেন কাঞ্চন মিয়া। এসব হাঁসের ডিম বিক্রি করে জমানো ২০ হাজার টাকায় পরে তিনি সিলেটের মারকুলি থেকে ৩০০ হাঁস কেনেন। হাঁস পালনের জন্য গ্রামের সোয়াইজনি নদীর পারে গড়ে তোলেন অস্থায়ী খামার। এটি ১৯৯০ সালের কথা।

আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি কিশোরগঞ্জের হাওরবেষ্টিত উপজেলা নিকলীর নগর গ্রামের বাসিন্দা কাঞ্চন মিয়াকে। হাঁস পালন ভাগ্য বদলে দিয়েছে তাঁর। বর্তমানে তাঁর খামারে হাঁসের সংখ্যা দুই হাজার। আট হাজার টাকা মূলধন নিয়ে শুরু করা কাঞ্চনের এখন প্রতিদিন ডিম বিক্রি করেই আয় আট হাজার টাকা। তাঁকে দেখে উৎসাহিত হয়ে আরও অনেকে নদীর পারে অস্থায়ী খামার করেছেন। বদলেছেন দিন। অভাব দূর করে হয়েছেন সচ্ছল। অভাবের কারণে একসময় বিষন্ন থাকা মুখে এসেছে হাসি।

বর্তমানে নিকলীর ওপর দিয়ে বয়ে চলা নরসুন্দা, সোয়াইজনি, ঘোড়াউত্রা ও ধনু নদীর পারে হাঁসের অস্থায়ী খামার রয়েছে চার শতাধিক, যা কয়েক শ পরিবারকে করেছে সচ্ছল। এসব খামারকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা হাঁসের খাদ্য শামুক এবং হাঁসের ডিম বিক্রির ব্যবসা উপার্জনের পথ করেছে আরও কয়েক শ মানুষের।

যেভাবে শুরু: সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ১৯৮৫ সালে উপজেলার মঞ্জিলহাটি গ্রামের রহিম, নগর গ্রামের ইসরাইল ও আলী হোসেন তাঁদের বাড়িতে ৪০-৫০টি করে হাঁস পালন শুরু করেন। হাঁসের ডিম বিক্রি করে তাঁদের আয়ও হচ্ছিল ভালোই। হঠাৎ ‘ডাকপ্লেগ’ রোগে হাঁসগুলোর মৃত্যু তাঁদের হতাশ করে। কিন্তু তাঁদের হাঁস পালন উৎসাহিত করে কাঞ্চন মিয়াকে। তাঁর সাফল্যে অনুপ্রাণিত হয়েছেন অন্যরা। কাঞ্চন মিয়া বলেন, একসময় মানুষের জমিতে কামলা দিয়ে সংসার চালাতে হতো। এখন আমি সচ্ছল। আমি পড়াশোনা করতে পারিনি। কিন্তু তিন ছেলেমেয়েকে স্কুলে পড়াচ্ছি।

নিকলীতে নদীর পারে গেলে দেখা যায় হাঁসের অসংখ্য অস্থায়ী খামার। কোনো খামারে ৫০০টি, কোনোটিতে এক হাজার এবং কোনোটিতে এর চেয়ে বেশি হাঁস রয়েছে। খামারগুলোর হাঁস দিনে নদীতে থাকে, নদী থেকে খাবার সংগ্রহ করে খায়। ছোট ছোট নৌকায় করে একজন বা দুজন হাঁসগুলোর ওপর নজরদারি করে। খামারিরা জানান, সন্ধ্যা হলে খামারের লোকজন হাঁসগুলোকে তাড়িয়ে বাঁশের বেড়ায় তৈরি অস্থায়ী খামারে নিয়ে যান। হাঁস ও ডিম চুরি ঠেকাতে রাতে কাছাকাছি তৈরি করা মাচায় থাকে খামারের লোকজন। দেখাশোনার জন্য প্রতিটি খামারে দু-তিনজন লোক রয়েছে।

খামারিরা জানান, অন্য এলাকার খামারগুলোতে হাঁসের খাবারের পেছনেই লাভের বড় একটা অংশ চলে যায়। নদীতে পর্যাপ্ত খাবার পাওয়া যায় বলে তাঁদের হাঁসের জন্য খাবার প্রায় কিনতেই হয় না। মাঝেমধ্যে তাঁরা শামুক কিনে হাঁসকে খাওয়ান। উন্মুক্ত পরিবেশে থাকায় ও প্রাকৃতিক খাবার পাওয়ায় এসব হাঁস অন্য এলাকার হাঁসের চেয়ে বেশি দিন ধরে ও বেশি ডিম দেয়। তাই তাঁদের খামারে লাভ বেশি। তাঁরা জানান, নদীর এক স্থানে খাবার ফুরিয়ে গেলে তাঁরা হাঁস ও অস্থায়ী খামারসহ নদীর অন্য স্থানে চলে যান। বর্ষাকালে নদীর পার পানিতে তলিয়ে গেলে খামারিরা হাঁসগুলো নিজেদের বাড়ি ও আশপাশে নিয়ে আসেন। এ সময় হাঁসের পুরো খাবার কিনতে হয় বলে খামারিদের লাভ কমে যায়। বদ্ধ পরিবেশের কারণে হাঁসের ডিম দেওয়ার ক্ষমতাও কমে যায়। বর্ষার পানি কিছু কমলেই খামারিরা হাঁস নিয়ে আবার নদীর পারে অস্থায়ী খামারে চলে যান। খামারিদের তথ্যানুযায়ী, এক হাজার হাঁসের একটি খামারে প্রতিদিন গড়ে ৯০০ ডিম হয়। এতে সব খরচ বাদ দিয়ে দৈনিক কমপক্ষে চার হাজার টাকা আয় হয়।

ভাগ্য বদলেছে যাঁদের: মহরকোনা গ্রামের জিল্লু মিয়ার (৩৫) চলতে হতো ধারদেনা করে। ১০ বছর আগে স্বজনদের কাছ থেকে ঋণ নিয়ে ৩৫০টি হাঁস দিয়ে খামার শুরু করেন তিনি। বর্তমানে তাঁর খামারে তিন হাজার হাঁস রয়েছে। এই খামারের আয় দিয়ে তিনি হাওরে ১৫ একর জমি কিনেছেন। তিনি বলেন, ‘হাঁস পালনই আমাকে সুদিন এনে দিয়েছে।’ হাঁসের খামার করে তাঁর মতো দারিদ্র্যকে জয় করেছেন আয়ুব আলী (৬৫), আবু কালাম (৩৫), সাইফুল (৩০), গিয়াস উদ্দিন (৫০), আলী ইসলাম (৪০), নূরু ইসলাম (৪২), নাসু মাঝি (৩৮), সোনালী (৩৫), করম আলী (৩০), উসমান (৩২), কুদ্দুস মিয়াসহ (৩৬) আরও অনেকে।
তিন বছর আগে ১৮ জন হাঁসের খামারি নিকলী নতুন বাজারে গড়ে তোলেন ‘হাঁস সমিতি’। উপজেলা প্রাণিসম্পদ কার্যালয়ের সহযোগিতা না পাওয়ার অভিযোগ করে সমিতির সাধারণ সম্পাদক করম আলী বলেন, খামারে হাঁসের রোগ দেখা দিলে টাকা দিয়ে চিকিৎসক আনতে হয়। ওষুধও পাওয়া যায় না।

হাঁসের খাবারের জন্য খামারিরা প্রতি খাঁচা শামুক কেনেন ১০ টাকা করে। নদী থেকে এই শামুক ধরে খামারিদের কাছে বিক্রি করে সংসারের অভাব দূর করেছেন হারুন, দেনু, মাহবুব ও বাহার উদ্দিনসহ অনেকে। তাঁরা জানান, নিকলীতে শামুক শিকার করা দুই শতাধিক নৌকা রয়েছে। প্রতি নৌকায় থাকে তিনজন।
নিকলীর খামারগুলোর ডিম স্থানীয় বাজারের চাহিদা মিটিয়ে রাজধানীতে যায়। ডিম ব্যবসায়ী করিম, বিল্লাল, নাছির, আলাউদ্দিন ও করম আলী জানান, তাঁরা প্রতিদিন ঢাকার ঠাটারীবাজারের বিভিন্ন আড়তে প্রায় দুই লাখ ডিম বিক্রি করেন। এতে তাঁদের কর্মসংস্থান হয়েছে।

জনপ্রতিনিধি ও প্রশাসনের বক্তব্য: নিকলী উপজেলার সদর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান কারার বুরহান উদ্দিন বলেন, ‘নিকলীর নদীর পারগুলোতে যেভাবে হাঁসের খামার গড়ে উঠেছে তা দেখে খুব ভালো লাগে। শুধু সদর ইউনিয়নেই খামার আছে দুই শতাধিক।’ উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা এম এ জলিল বলেন, ওষুধের সরবরাহ কম থাকায় খামারিদের ওষুধ দিতে পারি না। লোকবল কম থাকায় ঠিকমতো খামারগুলো পরিদর্শন করাও সম্ভব হয়ে ওঠে না।
নিকলী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) বলেন, উপজেলা প্রাণিসম্পদ কার্যালয়ের পর্যাপ্ত ওষুধ না থাকায় খামারিদের অসুবিধার বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের জানানো হয়েছে।


সূত্র : এগ্রোবাংলা

Leave a Reply

Subscribe to Posts | Subscribe to Comments

ই-মেইল সাবস্ক্রিপশন

Enter your email address:

Delivered by FeedBurner

ক্যাটাগরীসমূহ

পৃষ্ঠাসমূহ

Creative Commons License
This work is licensed under a Creative Commons Attribution 3.0 Unported License.
Protected by Copyscape

ব্লগটি মোট পড়া হয়েছে

বাঙলা ব্লগ. Powered by Blogger.

- Copyright © মেহেদী হাসান-এর বাঙলা ব্লগ | আমার স্বাধীনতা -Metrominimalist- Powered by Blogger - Designed by Mahedi Hasan -