.....


ব্রিটিশ আমলে এ দেশে নীল চাষ বলতেই ছিল আতঙ্ক। ইংরেজদের জুলুমে বাধ্য হয়ে ফসলের জমিতে নীল চাষ করতেন কৃষকেরা। দুবেলা দুমুঠো ভাতের আশা জলাঞ্জলি দিয়ে বেনিয়াদের হাতে তাঁরা তুলে দিতেন কাপড় রাঙানোর উপকরণ। অনেক আগেই সেই দুর্দিনের অবসান ঘটেছে।
কৃষকেরা এখন নীল চাষ করেন লাভের আশায়। তাঁদেরই একজন রংপুরের গঙ্গাচড়া উপজেলার যুবক নিখিল রায়। তিনি শুধু নীল চাষই করেন না, নীল তৈরির পর তা বিক্রিও করেন। গঙ্গাচড়ায় বাণিজ্যিকভাবে নীল উত্পাদনের পথিকৃত্ তিনি। তাঁর কারখানায় কাজ করে স্থানীয় অনেক দুস্থ পরিবার খুঁজে পেয়েছে জীবিকার পথ।

নিখিলের সংগ্রাম: ১৯৮০ সালে গঙ্গাচড়ার হরকলি ঠাকুরপাড়া গ্রামের মধ্যবিত্ত এক পরিবারে নিখিলের জন্ম। তিন ভাইয়ের মধ্যে তিনি সবার বড়। ২০০২ সালে নিখিল পল্লী চিকিত্সক হিসেবে গ্রামের মানুষের চিকিত্সা শুরু করেন। এ সময় অনেক অভাবী মানুষকে খুব কাছ থেকে দেখার সুযোগ হয় তাঁর। তাদের জন্য কিছু করার তাগিদ অনুভব করেন নিখিল। ২০০৩ সালে নিখিল বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের অধীনে পাট বহুমুখীকরণ প্রকল্পে পাট পণ্যের বিভিন্ন ব্যাগ তৈরির ওপর ২০ দিনের প্রশিক্ষণ নেন। এরপর অভাবী মানুষকে নিয়ে নিজের জমির ওপর ঘর তুলে সেখানে হস্ত কুটিরশিল্প প্রশিক্ষণ ও কল্যাণকেন্দ্র চালু করেন। সেখানে অভাবী লোকদের কুটিরশিল্পের বিভিন্ন বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া শুরু হয়। গ্রামের প্রতিবন্ধীদের পুনর্বাসনে তিনি চালু করেন প্রতিবন্ধী আবাসন প্রকল্প। প্রশিক্ষণ দিয়ে তাদের মোমবাতি, আগরবাতিসহ বিভিন্ন জিনিস তৈরির কাজে লাগান নিখিল।

২০০৬ সালে এমসিসি বাংলাদেশ নামের একটি দাতা সংস্থার অধীনে নীল তৈরির ওপর প্রশিক্ষণ নেন নিখিল। গ্রামের কিছুসংখ্যক নারীও এ প্রশিক্ষণ নেন। এরপর সংস্থার আর্থিক ও কারিগরি সহায়তায় নীলগাছের পাতা থেকে নীল উত্পাদন শুরু করেন নিখিল।
নিজের দেড় একর জমিতে এখন নীল চাষ করছেন নিখিল। অন্যের জমি থেকেও তিনি নীলের পাতা কিনে নীল তৈরি করেন। বিক্রি করেন ঢাকার বিভিন্ন সুতা ও কাপড় তৈরির কারখানায়। প্রতি কেজি নীল উত্পাদনে শ্রমিকের মজুরিসহ খরচ পড়ে প্রায় এক হাজার টাকা। উত্পাদিত প্রতি কেজি নীল বিক্রি করে তিনি পান দেড় হাজার টাকা। বছরের জুলাই থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত পাঁচ মাসে প্রায় ১২ লাখ টাকার নীল উত্পাদন করে বিক্রি করা হয়। এতে লাভ হয় প্রায় তিন লাখ টাকা। মুনাফার টাকা থেকে দুস্থ শ্রমিকদের তিনি সহায়তা করেন বলে শ্রমিকেরা জানান।
নিখিলের স্ত্রী কণিকা রানী বলেন, ‘লোকজন যখন আমার স্বামীর প্রশংসা করেন, তখন খুব ভালো লাগে।’

কারখানায় একদিন:রংপুর-দিনাজপুর মহাসড়কের পাশে খলেয়া ইউনিয়নের হরকলি ঠাকুরপাড়া গ্রাম। এখানেই গড়ে উঠেছে নিখিল রায়ের নীল ও অন্যান্য পণ্য তৈরির কারখানা। উপজেলা সদর থেকে ২২ কিলোমিটার দূরে ওই কারখানায় যাওয়ার পথে সড়কের দুই ধারে অনেক নীলক্ষেত চোখে পড়ে।
সম্প্রতি কারখানায় গিয়ে দেখা যায়, একটি ঘরে কয়েকজন নারীশ্রমিক নীল তৈরির কাজে ব্যস্ত। আরেকটি ঘরে প্রতিবন্ধী কয়েকজন যুবক তৈরি করছেন মোমবাতি, আগরবাতি, হাতপাখা, রুমাল, নকশিকাঁথা, খেলনা প্রভৃতি। অনেকে পাট দিয়ে বিভিন্ন ধরনের ব্যাগ তৈরিতে ব্যস্ত। একটি কক্ষে কাজের মান উন্নয়নে কিছুসংখ্যক কর্মীকে প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন নিখিল। কারখানার শ্রমিকদের সন্তানদের বিনামূল্যে লেখাপড়া শেখাচ্ছেন নিখিলের স্ত্রী কণিকা রানী। কয়েকজন শ্রমিক বলেন, ‘নিখিলের এখানে কাজ করে আমরা আগের চেয়ে ভালো আছি। আমাদের সন্তানেরাও পড়াশোনা করতে পারছে।’

নীল তৈরির পদ্ধতি:নিখিল জানান, প্রথমে নীলগাছের পাতা জোগাড় করা হয়। পাতাগুলো ১২ ঘণ্টা ড্রামের পানিতে ভিজিয়ে রাখা হয়। পানির রং হালকা সবুজ হলে তা আরেকটি ড্রামে ঢালা হয়। ৩০ মিনিট ধরে ঝাঁকুনি দেওয়ার পর ড্রামের পানিতে প্রচুর ফেনা হয়। ফেনাসহ পানি ড্রাম থেকে নল বা বালতির সাহায্যে পাতলা কাপড় বিছানো বাঁশের ঝুড়িতে ঢালা হয়। ১০-১২ ঘণ্টার মধ্যে পানি কাপড় ভেদ করে বের হয়ে যায়। তখন কাপড়ের ওপর এক ধরনের তরল তলানি পড়ে। চামচের সাহায্যে তলানি সংগ্রহ করে তা রোদে শুকানো হয়। দুই-তিন দিন রোদে শুকালে এটি কঠিন হয়ে যায়। এই কঠিন জিনিসটি পিষে নীল তৈরি করা হয়। নীলের সঙ্গে হরিতকীর গুঁড়া মেশালে তা সোনালি রং ধারণ করে। কলার মোচা পিষে মেশালে নীলে কালচে আভা পড়ে। প্রতিবছর জুলাই থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত নীল তৈরি করা হয়।

নীলগাছের আরও গুণ: নিখিল রায় জানান, বিনামূল্যে বীজ বিতরণসহ চাষিদের উদ্বুদ্ধ করার কারণে এলাকায় এখন ব্যাপকভাবে নীল চাষ হচ্ছে। নীলচাষির সংখ্যা এর মধ্যে এক হাজার ছাড়িয়েছে।
নীলগাছ উন্নতমানের সবুজ সার তৈরির উপকরণ। এলাকাবাসীর কাছে নীলগাছ ‘মালগাছ’ নামে পরিচিত। নীলগাছ সাধারণত পাঁচ-ছয় ফুট লম্বা হয়। পাতা খুব সরু ও ছোট। গরু-ছাগল নীলগাছের পাতা খায় না। গাছ উত্পাদনে রাসায়নিক বা গোবর সারের প্রয়োজন হয় না।
ঠাকুরপাড়া গ্রামের কৃষক শামসুল হক জানান, কচি নীলগাছ মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দিলে তা উন্নতমানের সবুজ সারে পরিণত হয়। এ ছাড়া গাছ উঠিয়ে গর্তে পচিয়েও সবুজ সার তৈরি করা হয়।
শলেয়াশাহ গ্রামের সাদেকুল ইসলাম বলেন, আলু ও তামাক চাষের আগে জমিতে সবুজ সার হিসেবে নীল চাষ করলে ফলন বাড়ে। জ্বালানি হিসেবে এ অঞ্চলে নীলগাছের প্রচুর চাহিদা রয়েছে।
গঙ্গাচড়া উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা আব্দুল লতিফ বলেন, উন্নতমানের সবুজ সার পাওয়া যায় বলে এ অঞ্চলের অনেক কৃষক এখন নীল চাষের দিকে ঝুঁকেছেন। নীল চাষ ও উত্পাদনে নিখিলের উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়ে তিনি বলেন, ‘তাঁর এ উদ্যোগ প্রশংসার দাবিদার।’


তথ্যসূত্র: দৈনিক প্রথম আলো

Leave a Reply

Subscribe to Posts | Subscribe to Comments

ই-মেইল সাবস্ক্রিপশন

Enter your email address:

Delivered by FeedBurner

ক্যাটাগরীসমূহ

পৃষ্ঠাসমূহ

Creative Commons License
This work is licensed under a Creative Commons Attribution 3.0 Unported License.
Protected by Copyscape

ব্লগটি মোট পড়া হয়েছে

বাঙলা ব্লগ. Powered by Blogger.

- Copyright © মেহেদী হাসান-এর বাঙলা ব্লগ | আমার স্বাধীনতা -Metrominimalist- Powered by Blogger - Designed by Mahedi Hasan -